Old man and old Woman : ‘ছেলে-মেয়ের ঘরে নয়, একাকীত্বেই শেষ বেলা’ : ছোট পরিবার, বড় সমস্যার মুখে বহু প্রবীণরা
Sasraya News
Listen
একটা সময় ছিল, যখন এক ছাদের তলায় তিন-চার প্রজন্ম একসঙ্গে বাস করত। যৌথ পরিবারের বন্ধনে আবদ্ধ ছিল সমাজ। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলেছে পরিবার গঠনের ধরন। এখন বেশিরভাগ পরিবারই নিউক্লিয়া। মা-বাবা ও এক বা দুই সন্তান। এই পরিবর্তিত চিত্র সামাজিক বিকাশের দিক থেকে যতই আধুনিকতার প্রতীক হোক না কেন বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা হয়ে উঠছে ভয়াবহ এক মানসিক সঙ্কটের উৎস। ভারতের কোটি কোটি প্রবীণ মানুষ আজ পরিবারে থেকেও একা। সন্তানেরা কর্মসূত্রে দূরে। কেউ কেউ বিদেশে। বৃদ্ধ মা-বাবা থেকে যাচ্ছেন একা। একাকীত্বের সঙ্গে একত্রবাস করেই কাটছে তাঁদের জীবনের শেষ অধ্যায়। লিখলেন : শ্রেয়সী মজুমদার
ছবি : প্রতীকী
ছোট পরিবার, দ্রুত সমস্যা
নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির এই চল বাড়ছে হু-হু করে। ২০১১ সালের সেনসাস অনুযায়ী, ভারতের ৫৪ শতাংশ পরিবার ছিল নিউক্লিয়ার। ২০২১-এর অনুমানভিত্তিক তথ্য বলছে, তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭১ শতাংশে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে এই প্রবণতা আরও প্রকট। বাবা-মায়ের একান্ত ইচ্ছা সন্তান যেন ভাল শিক্ষা ও প্রতিষ্ঠা পায়। সেই পথ ধরেই ছেলে-মেয়েরা ছড়িয়ে পড়ছে ভারতের ছোট বড় শহরে, এমনকী বিদেশেও। কর্মসংস্থান, উচ্চশিক্ষা বা বিয়ের পরেও তারা অনেকেই আর ফিরে আসে না আগের মতো। ফলে বৃদ্ধ মা-বাবার জীবন থেকে সন্তানদের দৈনন্দিন উপস্থিতি হয়ে দাঁড়ায় কেবল ফোনকল বা ভিডিওচ্যাটে সীমাবদ্ধ।
ছবি : প্রতীকী
দিল্লির এক বেসরকারি গবেষণা সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে এমন প্রায় ৪.৫ কোটি ভারতীয় রয়েছেন, যাঁরা একাকী বা তাঁদের সঙ্গী ছাড়া আর কোনও পরিবারের সঙ্গে থাকেন না। এর মধ্যে ৬৭ শতাংশ মা-বাবা জানিয়েছেন, তাঁরা জীবনের এই পর্যায়ে মানসিক দিক থেকে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ছেন। ডিপ্রেশন, অ্যানজাইটি, নিদ্রাহীনতা সহ বহু স্নায়ুজনীত সমস্যা বেড়ে চলেছে এই বয়সে।
ছবি : প্রতীকী
স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা দুইয়ের সঙ্কট
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের যত্ন, ওষুধপত্র, নিয়মিত চিকিৎসা এসব প্রয়োজন হয়ে ওঠে অনিবার্য। কিন্তু যাঁরা একা থাকেন। তাঁদের পক্ষে এ সমস্ত কাজ সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। বার্ধক্যে পায়ের, হাঁটুর, কোমরের ব্যথা, ডায়াবেটিস, হাই ব্লাড প্রেসার, হার্টের সমস্যা এমনিতেই বেড়ে যায়। তার উপর যদি পাশে কেউ না থাকেন তাহলে একটি জরুরি অবস্থাও হয়ে উঠতে পারে প্রাণঘাতী। তবে শুধু স্বাস্থ্য নয়, সমস্যার বড় অংশ জুড়ে রয়েছে নিরাপত্তাও। একাকী বসবাসরত প্রবীণদের বাড়িতে হামলা, প্রতারণা, এমনকী হত্যার ঘটনাও ঘটে চলেছে বারবার। ২০২৩ সালে NCRB-এর তথ্য অনুযায়ী, প্রবীণদের বিরুদ্ধে অপরাধের হার আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে ১৮ শতাংশ। অনেক প্রবীণ দম্পতি অভিযোগ করেছেন, বাড়ির পরিচারক বা নিরাপত্তারক্ষীরাই হুমকি দিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে কিছু শহরে প্রবীণদের জন্য হেল্পলাইন চালু করা হয়েছে। কিছু বেসরকারি সংস্থা ‘সিনিয়র কেয়ার সার্ভিস’ দিয়ে থাকেন, যেখানে নিয়মিত কেয়ারগিভার বা ভিজিটিং নার্স পাঠানো হয়। শহরতলি বা গ্রামে এই পরিষেবাগুলোর অভাব আরও বেশি।
ছবি : প্রতীকী
একাকীত্ব যখননীরব আত্মহত্যা
মানবসম্পদ মন্ত্রকের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতে প্রতি পাঁচজন প্রবীণ মানুষের মধ্যে একজন মানসিক অবসাদের শিকার। এর মূল কারণ পরিবারে গুরুত্ব কমে যাওয়া, সঙ্গী হারানো ও সন্তানদের অনুপস্থিতি। অনেক প্রবীণ আবার সন্তানদের উপর বোঝা হয়ে যেতে চান না বলেই নিজে থেকে দূরে সরে যান। একা থাকতে শুরু করেন। কেউ কেউ বৃদ্ধাশ্রম বেছে নেন, আবার কেউ বিষণ্নতা নিয়ে মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকেন। এই মানসিক অবসাদ বহুক্ষেত্রে আত্মহত্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ২০২২ সালে প্রবীণদের আত্মহত্যার হার ছিল প্রায় ১২.৫ শতাংশ, যা উদ্বেগজনক। বিশেষজ্ঞদের মতে, একাকীত্ব একপ্রকার ‘নীরব আত্মহত্যা’। যেখানে মানুষ নিজে থেকে ধীরে ধীরে জীবনের ইচ্ছা হারিয়ে ফেলেন।
ছবি : প্রতীকী
সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই পরিস্থিতি শুধুমাত্র সরকার বা সামাজিক সংস্থার দায় নয়, বরং সন্তানদেরও মানবিক দায়বদ্ধতা রয়েছে। কাজের প্রয়োজনে দূরে থাকলেও প্রযুক্তির সাহায্যে নিয়মিত যোগাযোগ, অনুভূতির আদানপ্রদান, এবং সুযোগ পেলেই ঘরে ফিরে আসা…।এই ছোট ছোট কাজই অনেকটা মনোবল ফিরিয়ে দিতে পারে মা-বাবাদের।
ছবি : প্রতীকী
নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির খাঁচায় ঢুকে প্রবীণরা যেন ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছেন নিজেদের অস্তিত্ব। সন্তানেরা কর্মব্যস্ত, সমাজ দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে। তথাপি একটি জীবনের মূল ভিত্তি, ভালবাসার কাঠামোটাই যেন ভেঙে যাচ্ছে। সমাজকে আরও মানবিক হতে হবে। মা-বাবা শুধু জন্মদাতা নন, জীবনের প্রথম শিক্ষকও। সেই শিক্ষকেরা যেন জীবনের শেষ অধ্যায়ে শুধুই অবহেলার পাঠ না পান। পরিবার ছোট হোক কিন্তু হৃদয়ের দরজাগুলো যেন সবসময় খোলা থাকে। তাহলেই হয়ত একাকীত্বের ভিতরে একটু করে আলো ফুটবে।