পলাশ গোস্বামী, সাশ্রয় নিউজ ★ কলকাতা : আষাঢ়ের বৃষ্টিভেজা দুপুর। চারপাশে থমকে থাকা হাওয়া। নরম শব্দে টুপটাপ বৃষ্টির ফোঁটা। সেই আবহেই থেমে গেল সাহিত্যের দীর্ঘ চলা পথ। সাহিত্যিক প্রফুল্ল রায় (Prafulla Roy)। বাংলা সাহিত্যের একটি স্তম্ভ। তিনি বৃহস্পতিবার চির ঘুমে ঢলে পড়লেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। সূত্রের খবর, বৃহস্পতিবার দুপুর তিনটে নাগাদ নিজের বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই কিংবদন্তী সাহিত্যিক। প্রফুল্ল রায় দশকের পর দশক ধরে বাংলার পাঠককে চিনিয়েছেন মাটির গন্ধ, দেশের নানা প্রান্তের অসংখ্য চরিত্র, তাদের হৃদয়স্পর্শী কাহিনি। তিনি যেন আপন করে নিয়েছিলেন সাধারণ জীবনের অসাধারণতা। তাঁর প্রয়াণে সাহিত্যপ্রেমী থেকে লেখক, পাঠক থেকে গবেষক সবাই শোকস্তব্ধ।
১৯৩৪ সালে জন্ম, ঢাকার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে। তখনও পূর্ব পাকিস্তান হয়নি। দেশভাগের আগেই, জীবনের কৈশোরকাল পেরিয়ে তিনি ভারতে চলে আসেন ১৯৫০ সালে। তারপর থেকেই শুরু এক বিশাল সাহিত্যযাত্রা। বাংলাভাষায় যাঁরা সামাজিক বাস্তবতার নির্যাস থেকে গল্প বুনতেন, সেই ধারার তিনি অন্যতম কাণ্ডারী হয়ে উঠেছিলেন। বিশেষ করে বিহারের জনজীবন, অন্তর্দ্বন্দ্ব ও অন্তর্গত সৌন্দর্য তাঁর লেখায় বারবার উঠে এসেছে। দেশ পত্রিকায় তাঁর ধারাবাহিক উপন্যাস ‘পূর্ব-পার্বতী’ যখন প্রকাশিত হচ্ছিল, তখনই বোঝা গিয়েছিল, বাংলা সাহিত্যে এক নতুন কণ্ঠস্বর প্রবেশ করেছে। মধ্যবিত্ত জীবনের সংগ্রাম, অভিমান, ভালবাসা আর অব্যক্ত আবেগ তাঁর কলমে ধরা পড়ত এক অনন্য বুননে। সাহিত্যবোদ্ধাদের মতে, প্রফুল্ল রায় ছিলেন সেই বিরল লেখকদের একজন, যাঁরা শব্দকে শ্রুতিমধুর রেখেও বাস্তবতাকে অস্বীকার করেননি। তাঁর লেখা উপন্যাস ‘কেয়া পাতার নৌকো’, ‘শতধারায় বয়ে যায়’, ‘উত্তাল সময়ের ইতিকথা’ ও ‘নোনা জল মিঠে মাটি’ প্রভৃতি পুস্তক পাঠকের হৃদয়ে আজও গেঁথে রয়েছে। মোট প্রায় দেড় শতাধিক পুস্তকের প্রণেতা। তার মধ্যে রয়েছে ১৩টি বিহারকেন্দ্রিক উপন্যাস ও ২০টির বেশি ছোটগল্পগ্রন্থ। এককথায় ভারতের আঞ্চলিক বাস্তবতাকে কেন্দ্র করে এক বিশ্বজনীন সাহিত্য নির্মাণের চেষ্টার নজির।সাহিত্যে তাঁর অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। প্রফুল্ল রায়ের সবচেয়ে বড় পুরস্কার ছিল তাঁর পাঠকের ভালবাসা। একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমি বিশ্বাস করি, গল্প তখনই সফল হয় যখন পাঠক নিজেকে খুঁজে পায় চরিত্রের ভিতর।” হয়ত এই আত্মসমর্পণ তাঁকে করে তুলেছিল সকলের ‘নিজের মানুষ’।
তাঁর প্রয়াণে শোকপ্রকাশ করেছেন বাংলার বিশিষ্ট সাহিত্যিক, প্রকাশক ও শিল্পীমহলের বহু মানুষ। সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেন, “প্রফুল্লদার লেখায় যে বাস্তবতা আর আবেগের সংমিশ্রণ, সেটা আর দেখা যাবে না। বাংলা সাহিত্য এক অতুলনীয় লেখককে হারাল।” অন্যদিকে সাহিত্য গবেষক সুমন্ত চক্রবর্তীর মন্তব্য, “ওঁর উপন্যাসগুলিতে ছিল তীব্র মানবিক চেতনা। একটা অদ্ভুত প্রজ্ঞা ও সহানুভূতির মিশেল। প্রফুল্ল রায়ের মৃত্যু আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসে এক শূন্যস্থান তৈরি করল, যা সহজে পূরণ হওয়ার নয়।” তাঁর সম্পদ সাধারণ পাঠকও মর্মাহত। বইপাড়ার এক দোকানদার বললেন, “প্রফুল্ল রায়ের বইয়ের আলাদা একটা চাহিদা সবসময় ছিল। যাঁরা নতুন প্রজন্ম, তাঁরাও খুঁজে নিয়েছেন ওঁর গল্পে নিজেদের।” উল্লেখ্য, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে যখন বাংলা সাহিত্যে আত্মজীবনীমূলক বা চটকদার লেখার প্রবণতা প্রবল, তখন প্রফুল্ল রায়ের মতো নিবেদিতপ্রাণ একজন লেখক আমাদের মনে করিয়ে দেন সাহিত্য কেমন হতে পারে, ও কীভাবে তা যুগের পর যুগ ধরে মানুষের অন্তর ছুঁয়ে যেতে পারে। সূত্রর খবর, তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে কেওড়াতলা মহাশ্মশানে। শেষবারের মতো সাহিত্যিকের নিঃশব্দ বিদায় জানাবে শহর কলকাতা। বাইরের বৃষ্টি থামবে, কিন্তু প্রফুল্ল রায়ের লেখার বৃষ্টিধারা যে কখনওই থামবে না। তা নিশ্চিত করে বলতে পারে বাংলা সাহিত্য। আজ অশ্রুসিক্ত প্রিয় সাহিত্যিকের অজস্র পাঠক।
ছবি : সংগৃহীত
আরও পড়ুন : Alia Bhatt : দ্বিতীয়বার মা হচ্ছেন আলিয়া!




