



“বিগত ৪০ হাজার বছর মানব ইতিহাসে বেশ অনন্য, কারণ ঐ সময়ে আমরাই হলাম পৃথিবীতে বসবাসকারী মানুষের একমাত্র রূপ।”…
তাঁর নোবেল পুরস্কার পাওয়ার খবর শোনার পরপরই রেকর্ড করা এই টেলিফোন কথোপকথনে, ২০২২ সালের মেডিসিন বিজয়ী এসভান্তে পেবো বিলুপ্ত প্রজাতি হোমিনিনের সাথে আমাদের সম্পর্ক এবং কীভাবে তাদের জেনেটিক্সের অনুসন্ধান আমাদের নিজেদের প্রতি এবং সেই সঙ্গে প্রকৃতিতে আমাদের স্থান সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রভাবিত করতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি সেই সঙ্গে আরও জানিয়েছেন, গত কয়েক দশক ধরে এই রিসার্চ চালিয়ে যাওয়ার আত্মবিশ্বাস তিনি কোথা থেকে পেয়েছিলেন। তাঁর ওপর তাঁর মা এবং নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বাবা সুন বার্গস্ট্রমের প্রভাবের কথাও আমরা এই আলোচনায় জানতে পারি। তিনি প্রতিবেদক অ্যাডাম স্মিথকে বলেন যে একজন নোবেলজয়ী পিতার ছত্রছায়ায় থেকে তিনি জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ শিখেছেন: “এই ধরনের লোকেরাও সাধারণ মানুষ।” সাক্ষাৎকারটি ভাষান্তর করলেন : রাখী নাথ কর্রকার
অ্যাডাম স্মিথ: হ্যালো, আমি অ্যাডাম স্মিথ। নোবেল পুরস্কারের জন্যে আপনাকে অভিনন্দন জানাই।
এসভান্তে পেবো: আপনাকে ধন্যবাদ।
অ্যাডাম স্মিথ: আপনাকে অত্যন্ত শান্ত এবং নিরুদ্বেগ লাগছে।
এসপি: [হাসি] ওহ, হ্যাঁ, অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, আমি ইতিমধ্যে আমার স্ত্রীর সাথে এটি নিয়ে আলোচনা করেছি।
অ্যাডাম স্মিথ: মনে হচ্ছে আপনার ওপর আপনার স্ত্রী গভীর প্রভাব রয়েছে।
এসপি: হ্যাঁ, অবশ্যই।
অ্যাডাম স্মিথ: খবরটি কীভাবে পেলেন?
এসপি: আমি তখন আমার চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিচ্ছিলাম যাতে আমি তাড়াতাড়ি বেরিয়ে মেয়েকে তার ন্যানির কাছ থেকে নিয়ে আসতে পারি। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই আমি সুইডেন থেকে এই ফোন কলটি পাই, আমি তো ভেবেছিলাম ফোনটি নিশ্চয়ই সুইডেনে আমাদের ছোট্ট গ্রীষ্মকালীন বাড়িটা ব্যাপারেই হবে। আমি ভেবেছিলাম ‘ওহ, ঘাস কাটার যন্ত্রটি ভেঙে গেছে বা অন্য কিছু একটা হয়েছে!’
অ্যাডাম স্মিথ: আপনি কি আপনার মেয়েকে নিয়ে আসতে পেরেছেন?
এসপি: এই তো আমি এখন যাচ্ছি।
অ্যাডাম স্মিথ: আজকে বোধহয় জার্মানিতে ছুটির দিন।
এসপি: হ্যাঁ, আজ জার্মান একীকরণের দিন, তাই এখানে এখন সব শান্ত, সবকিছু বন্ধ।
অ্যাডাম স্মিথ: এই সুখবরটা পাওয়ার ব্যাপারে এটা একটা অদ্ভুত দিন কারণ, অন্য দিন হলে আপনি এই সময়ে ইনস্টিটিউটে থাকতেন, এবং আমার মনে হয়, তখন চারদিকে শ্যাম্পেন পপিংএর সঙ্গে সঙ্গে উৎসাহী জনতা আপনাকে ঘিরে থাকত।
এসপি: হ্যাঁ, হ্যাঁ। এবং আগামীকাল সকালে দোকান খুললে আমি বাইরে গিয়ে কিছু শ্যাম্পেন কিনতে পারি এবং ইনস্টিটিউটে উপস্থিত হতে পারি।
অ্যাডাম স্মিথ: আমি ভাবতে পারছি না যে এত বড় সুখবরের উদযাপন সত্যিই ২৪ ঘন্টা বিলম্বিত হবে, তবে আমি নিশ্চিত যে তা হবে! আচ্ছা, আপনার কাজ ছিল এই প্রাথমিক হোমিনিনগুলির সিকোয়েন্সিংয়ের উপর। ঐ প্রজাতির জেনেটিক গঠনবিন্যাস নিয়ে আপনার জ্ঞান তাদের সাথে আমাদের কীরকম সম্পর্কের কথা বলে?
এসপি: আসলে, এটা আমাদের বলে যে আমরা খুব ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। প্রথমত, এবং আমরা আসলে এতটা ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত যে তারা ৫০/৬০ হাজার বছর আগেই তাদের ডিএনএ আজকের বেশিরভাগ মানুষের পূর্বপুরুষদের কাছে সরাসরি ছড়িয়ে দিয়েছে, বিশেষ করে তারা যারা আফ্রিকার বাইরের মানুষ। এবং সেই বৈচিত্র্যগুলির অবশ্যই একটি প্রভাব রয়েছে এবং বর্তমানে আমাদের শরীরবিদ্যায় অনেক কিছুকেই তা প্রভাবিত করে।
অ্যাডাম স্মিথ: আপনি কি মনে করেন যে এটি জেনে আমাদের নিজেদের সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাবে?
এসপি: কিছু অর্থে, আমি মনে করি এটি তাই করে, এই ধরণের উপলব্ধি যে কিছুকাল আগে পর্যন্ত, সম্ভবত চোদ্দশত প্রজন্ম বা তার আগেও চারপাশে মানুষের অন্যান্য রূপ ছিল এবং তারা আমাদের পূর্বপুরুষদের সাথে মিশেছে এবং আজ আমাদের ডিএনএতে তাদের অবদান রেখেছে। গত ৪০ হাজার বছর মানব ইতিহাসে একেবারেই অনন্য যে ইতিহাসে চারপাশে মানুষের রূপ বলতে একমাত্র আমরাই।
অ্যাডাম স্মিথ: এটি বিশ্বে আমাদের অবস্থান সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করবে, তাই কি?
এসপি: হ্যাঁ, আমি তাই মনে করি। আমার তো মাঝে মাঝে এটা ভাবতেও অবাক লাগে যে, আচ্ছা, নিয়ান্ডারথালরা যদি আরও ৪০ হাজার বছর বেঁচে থাকত তবে তা আমাদের কীভাবে প্রভাবিত করত? আমরা কি নিয়ান্ডারথালদের সঙ্গে হওয়া আরও খারাপ কিছু বর্ণবিদ্বেষ দেখতে পেতাম, কারণ তারা সত্যিই কিছু অর্থে আমাদের থেকে আলাদা? নাকি আমরা এই জগতে আমাদের স্থানকে ভিন্নভাবে দেখতাম যখন সেখানে মানুষের অন্যান্য রূপও থাকত যারা আমাদের মতো হলেও কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে ভিন্ন। তখন আমরা প্রাণী এবং মানুষের মধ্যে এই খুব স্পষ্ট পার্থক্য করতে পারতাম না যা আমরা আজ এত সহজে করে থাকি।
অ্যাডাম স্মিথ: প্রেস রিলিজ আপনার এই কাজের জন্য ‘আপাতদৃষ্টিতে-অসম্ভব’ শব্দটি ব্যবহার করেছে। আমি ভাবছিলাম…
এসপি: ওহ সত্যিই তাই? আচ্ছা। [হাসি]
অ্যাডাম স্মিথ: আমি ভাবছিলাম কী আপনাকে এতটা আত্মবিশ্বাস দিয়েছে, যা একটি আপাত-অসম্ভব গবেষণা করার সাহস জুগিয়েছে?
এসপি: আচ্ছা, এটি অবশ্যই একটি ধাপে ধাপে প্রক্রিয়া যা আশির দশকে শুরু হয়েছিল। আমি এমন কিছু জিনিস থেকে কিছুটা ডিএনএ পুনরুদ্ধার করার জন্য সংগ্রাম করছিলাম যা ছিল সংখ্যায় সামান্য … শুধু কিছু শুকনো টিস্যু দিয়ে শুরু করেছিলাম যেগুলি মাত্র কয়েক মাস পুরনো ছিল, সময়ের সাথে সাথে অতীতে ফিরে গিয়ে প্রযুক্তিগত সমস্যাগুলির সাথে লড়াই করছিলাম কয়েক দশক ধরে। তারপরে নিয়ান্ডারথালদের মতো একই সময়ে বসবাসকারী ম্যামথ বা গুহা ভাল্লুকের মতো জিনিসগুলি থেকে ডিএনএ পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল। এবং তারপরে আমি ভাগ্যক্রমে জার্মানিতে একটা চাকরি পেয়ে যাই, যেখানে অবশ্যই নিয়ান্ডারথালদের একটি বড় উপস্থিতি ছিল আমাদের মধ্যে, মানুষের কল্পনাতে, তাই এই রিসার্চ শুরু করার চেষ্টা করা তখন একটি সুস্পষ্ট পদক্ষেপ ছিল।
অ্যাডাম স্মিথ: আপনার কথা শুনে অবশ্যই মনে হচ্ছে তা যুক্তিসম্মত, কিন্তু আমি মনে করি সেখানে একটি ছোটো বক্তব্যও আছে। আপনার বংশে অবশ্যই নোবেল পুরস্কার জয়ের ইতিহাস আছে, এবং আপনার বাবা একজন নোবেল বিজয়ী ছিলেন। পুরস্কার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এটি কি আপনার কাছে কোন পার্থক্যের সৃষ্টি করেছিল?
এসপি: কিছু পরিমাণে আমি নিশ্চিত, হ্যাঁ এটা করে। আমি মনে করি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রভাব ছিল নিশ্চিতভাবে আমার মা, যার ছত্রছায়ায় আমি বড় হয়েছি। এবং কিছু অর্থে আমার খুব কষ্ট হয় এটা ভেবে যে মা এই দিনটি দেখে যেতে পারলেন না। তিনি বিজ্ঞানের এক অনুরাগী ছিলেন, এবং বছরের পর বছর ধরে আমাকে খুব উদ্দীপিত এবং উৎসাহিত করেছিলেন। আমার বাবার সাথে অবশ্যই আমার কিছু যোগাযোগ ছিল এবং তিনি আমার কাজে খুব আগ্রহ দেখিয়েছিলেন, কিন্তু সেটা আমার মায়ের সঙ্গে আমার সম্পর্কের মতো এতটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল না।
অ্যাডাম স্মিথ: আমি শুধু ভাবছিলাম যে এমন কোনও ব্যাপার আছে কি যে সুনে বার্গস্ট্রোম বা অন্যান্য বিজয়ী বা মহান বিজ্ঞানীরা আপনাকে আবার সেই ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি, বা এই ধরনের বড় চ্যালেঞ্জগুলি গ্রহণ করার জন্য আত্মবিশ্বাস অর্জনে সহায়তা করেছেন?
এসপি: এটা হয়ত একজনের কাছে এমন একটা উপলব্ধিও যে এই ধরনের লোকেরাও সাধারণ মানুষ, এবং এটি এমন কোনও আশ্চর্যজনক জিনিস নয়, যে তা আপনার মধ্যে বিশাল আত্মবিশ্বাসের জন্ম দেবে নিজের মতো করে চ্যালেঞ্জিং জিনিসগুলি চেষ্টা করার জন্য।
অ্যাডাম স্মিথ: এটা সত্যিই একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট, একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ পাঠ। লোকেরা এখন সকলকেই বেদীতে বসাতে উঠেপড়ে লেগেছে, তবে অবশ্যই…। যাই হোক এবার আমার আর আপনাকে আটকে রাখা উচিৎ হবে না কারণ আপনার মেয়েকে নিয়ে আসতে যেতে হবে। এবং সেই সঙ্গে এই দিনটিকেও উপভোগ করতে দিতে হবে…যা তুলনামূলকভাবে একটা শান্ত দিন বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু…যাইহোক, আপনার সাথে কথা বলতে পেরে আমার বড় ভাল লেগেছে, এবং আরও একবার অভিনন্দন জানাই। সেই সঙ্গে জানাই একটি চমৎকার দিনের শুভেচ্ছা এবং আপনাকে ধন্যবাদ।
এসপি: ধন্যবাদ।
ছবি : প্রেস রিলজ থেকে
