Sasraya News

Friday, March 28, 2025

Micheal Focault : মিশেল ফুকো : একটি প্লাবনের নাম

Listen

গদ্য 🦋

মিশেল ফুকো (Micheal Focault) পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় এক ফরাসি মানসিক হাসপাতালে মনোরোগ চিকিৎসা পর্যবেক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। এখানেই শুরু হয় তার অনুসন্ধিৎসার অভিযান। একসময় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হিসেবেও কাজ করেছেন। কিন্তু মতবিরোধের কারণে ১৯৫১ খ্রীস্টাব্দে দল ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। লিখেছেন : কেয়া চ্যাটার্জী

 

মিশেল ফুকো… 

 

যা প্রচলিত তা কি প্রশ্নাতীত? যে নিয়ম চলে আসছে আদি অনন্তকাল ধরে তার মধ্যে কি নেই এতটুকুও ফাঁক? প্রশ্ন তুলেছিলেন মিশেল ফুকো। প্রচলিত ধ্যান ধারণার মূলে আঘাত করে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন সমাজের প্রতিটি বিষয়ের প্রতি, প্রতিটি নিয়ম, আইন, পদ্ধতি তাঁর প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। সমাজের চিরাচরিত ‘সিস্টেম’ যে ভুলের উর্ধ্বে নয় তা তিনি প্রমাণ করেছিলেন তাঁর গবেষণার মাধ্যমে। কাজও হয়েছিল। তাঁর প্রশ্নবাণের জেরে পরিবর্তন ঘটেছে চিকিৎসা, আইন, শিক্ষা, ইতিহাস, বিচার ব্যবস্থা ও সমাজনীতির।

প্রশ্ন উঠতে পারে, কে এই ফুকো? ফ্রান্সের পোয়েশিয়ায় ১৯০৬ খ্রীস্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ফুকো ছিলেন একাধারে দার্শনিক ও ঐতিহাসিক। যদিও বিশেষজ্ঞরা তাঁর ইতিহাসকে বিশুদ্ধ ইতিহাস হিসেবে নামাঙ্কিত করতে নারাজ। সেই ইতিহাসকে বলা যায় ইতিহাসে ধারণা বা প্রত্নতত্ব। কিন্তু ফুকো সেসবে আমল দেননি। কারণ, যা প্রথাগত তারই তিনি বিরোধী।

 

মিশেল ফুকো। ছবি : আন্তর্জালিক

 

দর্শন নিয়ে লেখাপড়া শুরু করলেও দর্শনের চিরাচরিত ভাবধারা ও গতানুগতিকতায় বিরক্ত হয়ে তিনি মনস্তত্ত্ব ও মনসমীক্ষা নিয়ে পড়া শুরু করেন। পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় এক ফরাসি মানসিক হাসপাতালে মনোরোগ চিকিৎসা পর্যবেক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। এখানেই শুরু হয় তার অনুসন্ধিৎসার অভিযান। একসময় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হিসেবেও কাজ করেছেন। কিন্তু মতবিরোধের কারণে ১৯৫১ খ্রীস্টাব্দে দল ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। জীবনের সিংহভাগ সময় অতিবাহিত করেছেন সুইডেন, পোল্যান্ড, জার্মানির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনার কাজে। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ থেকে তিনি ইতিহা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে ভিনসেনের দর্শন বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে ‘কলেজ অফ দ্য ফ্রান্সে’ চিন্তাপ্রণালীর ইতিহাসে ওপর অধ্যাপনা শুরু করেন এবং সেখানেই আমৃত্যুকাল কর্মরত ছিলেন।
তাঁর রচিত গ্রন্থগুলি হল— Madness and Civilisation, The Order of Things, The Archaeology of Knowledge, The History of Sexuality, The Birth of the Clinic, Mental Illness and Psychology, Histories of Madness and Medicine ইত্যাদি।

কোনও একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর ফুকো তার লেখনী ও মননকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তাই তাঁর গ্রন্থগুলি কোন একটি বিষয়ের ওপর লেখা নয়। বরং সমাজের প্রতিটি বিষয় যা তাঁর কাছে অযৌক্তিক মনে হয়েছে তিনি সেইসব বিষয়ের দিকে আঙ্গুল তুলেছেন, ব্যাখ্যা চেয়েছেন ও নিজের মননশীলতা, জ্ঞান ও গবেষণার মাধ্যমে বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর গবেষণা ও তত্ত্ব প্রচলিত ধ্যানধারণার বাইরে গিয়ে নতুন থিওরির ভিত্তি স্থাপনা করেছে। বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন, শিক্ষা, ভাষা সবক্ষেত্রেই ফুকো অবাধ বিচরণ করেছেন। যদিও তাঁর এই ভিন্ন ধারার চিন্তাধারার জন্য তিনি ঋণ স্বীকার করেছেন লুই আলথু্সার, জাঁক লাকাঁ, মার্সেল মস, ডুমজেল প্রমুখ অগ্রজ চিন্তাবিদদের।

মানসিক হাসপাতালে কাজ করতে করতেই তাঁর মন জেগে ওঠে নানান প্রশ্ন। মানসিক রোগীদের এই যে বন্দীত্বের মাধ্যমে চিকিৎসা দান এই পদ্ধতির প্রনেতা কারা? কে-ই বা এই পদ্ধতিকে স্বীকৃতি দান করেছেন? এই ব্যবস্থার গভীরে কি প্রথিত নেই কোনও গূঢ় সমাজতাত্ত্বিক রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক কারণ? ফুকো এই বিষয়টি নিয়ে ত্রিস্তরীয় ব্যাখ্যা করেন। প্রকাশিত হয় তাঁর Madness and Civilisation গ্রন্থটি। তিনি প্রমাণ করেন পাগল ও অপরাধীরা যেহেতু সমাজের একটি অন্ধকার দিক বা রাষ্ট্রের বিকাশের পথে একটি অন্তরায় তাই রাষ্ট্র সর্বদা চেয়েছে এদের জন্য স্বল্পপুঁজি ব্যয় করে এদের স্বাভাবিক জীবনে ধীরে ধীরে ফিরিয়ে আনতে। এই প্রক্রিয়ার জন্য বন্দীদশাই একমাত্র সুলভ পন্থা।

ফুকো মানসিক চিকিৎসাকে রোগ বলতে নারাজ। মানসিক রোগীদের হিংস্রতা ও বন্দীত্বের মাধ্যমে সুস্থ করার পদ্ধতি তিনি অস্বীকার করেন। তাঁর Birth of the Clinic গ্রন্থে তিনি আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত অভিজ্ঞতা নির্ভর চিকিৎসা ব্যবস্থার অবতারণা করেন। হাসপাতালকে জেলখানার পরিবর্তে মুক্তাঙ্গনে পরিবর্তিত করার সূত্রপাত ফুকোর হাত ধরেই হয়। তার পরবর্তী গ্রন্থ Order of Things অন্যান্য বিষয়গুলির থেকে আলাদা। আগে তিনি গবেষণা করেছেন বৈসাদৃশ্য নিয়ে। এখানে গবেষণা করলেন সাদৃশ্য নিয়ে। চিকিৎসা বা আইনের মারপ্যাঁচের বাইরে গিয়ে তিনি ভাষার অস্তিত্ব নিয়ে ডুব দিলেন জ্ঞান সমুদ্রে। মানব সভ্যতার আদিকাল থেকে মানুষের যোগাযোগের অন্যতম পথ হল ভাষা। তাঁর এই গবেষণায় তিনি খুঁজে পেলেন বস্তু ও শব্দের সাদৃশ্য। ভাষা ছাড়া যেমন মানব জগতের অস্তিত্ব নেই তেমনি জড়জগৎও ভাষা ব্যতিত অচল। একে অপরের পরিপূরক। একটি বস্তু যেমন ভাষার মাধ্যমেই অর্থপূর্ণ ও বর্ণনাধর্মী হয়ে ওঠে তেমনি আবার বস্তু ছাড়া শব্দেরাও এলোমেলো ধূলোর মতো ঘুরে বেড়ায়। শব্দের আশ্রয়স্থল হল বস্তু।

১৯৭৫-এ প্রকাশিত Discipline and পানিসহ গ্রন্থে তিনি শাস্তির নিয়মাবলী সম্পর্কে আলোচনা করেন। প্রাচীন শতাব্দীর বিভিন্ন সাম্রাজ্য ও আইনব্যবস্থার উদাহরণ টেনে তিনি শাস্তি প্রদানকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরস্থ গঠনের বর্ণনা করেন। ব্যক্তি রাষ্ট্রের কাছে একটি গিনিপিগের ন্যায়। রাষ্ট্র নির্ধারিত নিয়মাবলী আদৌ কোনও ব্যক্তিকে শৃঙ্খলায়িত করতে পারছে কিনা তা পরীক্ষা করার জন্যই শাস্তি ব্যবস্থার প্রণয়ন। শাস্তির মাধ্যমেই যে ব্যক্তিকে সৎ পথে টেনে আনা যায় এই ধারণা ভ্রান্ত ও যুক্তিহীন তা ফুকো প্রমাণ করেন। The Uses of Pleasure ফুকোর জীবনের সবথেকে উল্লেখযোগ্য গবেষণাপত্র যা সারা বিশ্বের মননজগতে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। যদিও এটি তাঁর মৃত্যুর জন্য অসমাপ্ত থেকে যায়।

ফুকোর চিন্তা সর্বগ্রাসী। যা কিছু প্রচলিত ও সর্বজন স্বীকৃত তাকেই অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে তার সত্যাসত্য যাচাই করেছেন তিনি। সেই যাচাই করার কাজে ব্যবহার করেছেন ইতিহাস, যুক্তি ও তাঁর শাণিত মস্তিষ্ক। প্রচলিত নিয়মের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে তার সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গের বিশ্লেষণ করে তিনি সত্যকে তুলে ধরতে চেয়েছেন পৃথিবীবাসীর কাছে। যুক্তি ব্যতিত যেকোনো ধারণাই ভ্রান্ত, ভিত্তিহীন — এই ভাবনা মানুষের মনে নিঃসংশয়ে প্রথিত করে বিশ্বের মননশীলতাকে এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছেন মিশেল ফুকো। যা কিছু প্রচলিত তা স্বাভাবিক নয়। সেটি স্বাভাবিক মনে হয় কারণ সেটিকে বলপূর্বক বা আইন প্রণয়ন করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে যুগ যুগ ধরে। উত্তরাধিকার সূত্রে হাত বদল হয়েছে ভ্রান্ত ধারণা। যুক্তির কষ্টিপাথরে না যাচাই করে কোনও নিয়মই যেন পরবর্তী প্রজন্ম মেনে না নেয়।

ফুকো একটি বিদ্রোহের নাম। যেভাবে ফরাসি বিদ্রোহ পৃথিবীর ইতিহাসে পরিবর্তন এনেছিল সেভাবে ফুকোও তাঁর অপ্রতিরোধ্য কলম ও যুক্তির জোরে ভেঙে ফেলেছেন যুক্তিহীন সমাজতত্ব ও রাষ্ট্রনীতির অচলায়তন। ফুকোকে এক কথায় বা কয়েকটি বাক্যে সংজ্ঞায়িত করা ভীষণ দূরূহ। তার চিন্তা ও কর্ম নিয়ে আলোচনা করতে গেলে কেটে যাবে সারা জীবন। শুধু এইটুকুই বলা যায়, মিশেল ফুকো একটি প্লাবনের নাম।

ছবি : আন্তর্জালিক 

আরও পড়ুন : Life Style : প্রকৃত জীবন : উন্নত জীবনচর্চা 

Sasraya News
Author: Sasraya News

Leave a Comment