সাশ্রয় নিউজ ডেস্ক ★ স্টকহোম : নরওয়ে নোবেল কমিটি ঘোষণা করেছে, ২০২৫ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার (Nobel Peace Prize 2025) পেয়েছেন ভেনেজুয়েলার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মুখ, সাহসী রাজনীতিক মারিয়া কোরিনা মাচাদো (Maria Corina Machado)। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার রক্ষা ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে স্বৈরশাসন থেকে মুক্তির নিরন্তর সংগ্রামের জন্য তাঁকে এই বিশেষ স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি জানিয়েছে, ‘মারিয়া কোরিনা মাচাদো সাম্প্রতিক লাতিন আমেরিকার ইতিহাসে এক অসাধারণ উদাহরণ, তিনি একাই লক্ষ মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছেন। তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে সাহস, সততা ও জনগণের প্রতি অঙ্গীকার একত্রে স্বৈরাচারকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে।’

একক নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক ঐক্য
দীর্ঘদিন ধরে বিভক্ত ভেনেজুয়েলার বিরোধী শিবিরে ঐক্য আনতে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলেন মাচাদো। বিভিন্ন দল, মত ও শ্রেণির মানুষকে একত্রিত করে তিনি গড়ে তুলেছিলেন গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, যার প্রধান লক্ষ্য ছিল মুক্ত ও সুষ্ঠু নির্বাচন। নোবেল কমিটির বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘গণতন্ত্রের প্রকৃত চেতনা হল, একে অপরের মতবিরোধ সত্ত্বেও জনগণের শাসনের নীতিকে রক্ষা করা। মারিয়া কোরিনা মাচাদো এই নীতির এক উজ্জ্বল প্রতীক।’ উল্লেখ্য, দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দমননীতির শিকার এই দেশ আজ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ডুবে আছে। এক সময়ের সমৃদ্ধ রাষ্ট্র এখন মানবিক বিপর্যয়ের মুখে। প্রায় ৮০ লাখ নাগরিক দেশ ছেড়ে বিদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। বাকি জনগণ ভুগছেন তীব্র দারিদ্র্য ও মৌলিক অধিকারবঞ্চনায়।
গণতন্ত্রের পথে বুলেট নয়, ব্যালট
মাচাদো ২০০২ সালে ‘সুমাতে (Sumate)’ নামের একটি নাগরিক সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন, যা ভেনেজুয়েলায় গণতান্ত্রিক বিকাশ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের পক্ষে কাজ করে। সেই সময় থেকেই তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা বন্দুক নয়, ব্যালটকেই বেছে নিয়েছি (a choice of ballots over bullets)।’
রাজনৈতিক নিপীড়ন, কারাবাস ও হুমকির মধ্যেও তিনি একটিবারও পিছিয়ে যাননি। তাঁর ভাষায়, ‘গণতন্ত্রের সংগ্রাম মানে কেবল ভোট নয়, মানুষের মর্যাদার জন্য লড়াই।’ বিগত দুই দশক ধরে মারিয়া অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং জনগণের প্রতিনিধিত্বমূলক অধিকার রক্ষায়।

২০২৪ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে বিরোধী জোট তাঁকেই প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছিল। কিন্তু শাসকগোষ্ঠী তাঁর প্রার্থীপদ বাতিল করে দেয়। তবুও তিনি পিছিয়ে যাননি; বরং তাঁর জায়গায় সমর্থন করেন অ্যাডমুন্ডো গনসালেস উরুতিয়াকে (Edmundo Gonzalez Urrutia), তিনি শেষ পর্যন্ত বিরোধী শিবিরের প্রতীক হয়ে ওঠেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, দেশজুড়ে লাখো স্বেচ্ছাসেবক তাঁর নেতৃত্বে নির্বাচনী পর্যবেক্ষক হিসেবে কাজ করেন। নিপীড়ন, গ্রেফতার, নির্যাতনের ভয় না পেয়ে তাঁরা ভোটকেন্দ্রে পাহারা দেন এবং ফলাফল রেকর্ড করেন। এই সাহসিকতার মধ্য দিয়েই ভেনেজুয়েলার নাগরিকেরা বিশ্বকে দেখিয়ে দেয়, গণতন্ত্র এখনও জীবিত। আন্তর্জাতিক মহল পরবর্তীতে বিরোধীদের প্রকাশিত ভোটগণনা সমর্থন করে জানায়, নির্বাচনে বিরোধী প্রার্থীই আসলে জয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু শাসক দল ফলাফল মানতে অস্বীকার করে ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকে।

গণতন্ত্রই শান্তির শর্ত
নোবেল কমিটির বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, ‘গণতন্ত্রই দীর্ঘস্থায়ী শান্তির পূর্বশর্ত। অথচ আজ বিশ্বজুড়ে স্বৈরাচারী সরকারগুলো আইন ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করছে। এই পরিস্থিতিতে মারিয়া কোরিনা মাচাদোর সংগ্রাম কেবল ভেনেজুয়েলার নয়, পুরো বিশ্বের গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতীক।’
বর্তমানে মাচাদো আত্মগোপনে আছেন, তবুও দেশ ছাড়েননি। জীবনহানির হুমকির মধ্যেও তিনি নিজের জনগণের পাশে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁর এই অবস্থান লক্ষ মানুষের কাছে প্রেরণা হয়ে উঠেছে। নোবেল কমিটি কমিটি বলেছে, ‘যখন স্বৈরাচার ক্ষমতা দখল করে, তখন মুক্তচেতা মানুষের সাহসই গণতন্ত্রের প্রাণশক্তি। মারিয়া কোরিনা মাচাদো সেই সাহসের নাম।’ নোবেল শান্তি পুরস্কারের ঘোষণায় বলা হয়, আলফ্রেড নোবেলের তিনটি মূল শর্তই মাচাদোর মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে :
১. জনগণের ঐক্য গঠন
২. সামরিকীকরণের বিরোধিতা
৩. শান্তিপূর্ণ উপায়ে গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের আহ্বান
তাঁর আন্দোলন প্রমাণ করেছে, গণতন্ত্রের হাতিয়ারই শান্তির হাতিয়ার। যেখানে নাগরিকের অধিকার সুরক্ষিত, সেখানে যুদ্ধ নয়, সহাবস্থানই সম্ভব। নরওয়ের নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান বার্গিট রেইস-আন্ডারসেন (Berit Reiss-Andersen) বলেন, ‘মারিয়া কোরিনা মাচাদো আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন, স্বাধীনতা কখনও স্থায়ীভাবে অর্জিত হয় না, তাকে রক্ষা করতে হয় সাহস ও কণ্ঠে।’ অন্যদিকে,
বিশ্বের রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই পুরস্কার কেবল একজন ব্যক্তির স্বীকৃতি নয়, এই পুরস্কার সেই লক্ষাধিক নাগরিকের জয় যারা শান্তিপূর্ণ পথে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়ছেন। আবার, লাতিন আমেরিকার মানবাধিকার সংগঠনগুলির মতে, এই পুরস্কার পুরো অঞ্চলের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মনোবল বাড়াবে। ভেনেজুয়েলার প্রবাসী সম্প্রদায়ের অনেকে সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, ‘আজ আমাদের আশা ফের জেগে উঠল। মাচাদো আমাদের সাহসের প্রতীক।’
মারিয়া কোরিনা মাচাদো বর্তমানে আত্মগোপনে থাকলেও তাঁর বার্তা দেশের প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে পড়েছে, স্বাধীনতা কেবল দাবি নয়, এটি মানুষের জন্মগত অধিকার।’ নোবেল কমিটি জানায়, ‘তিনি কেবল নিজের দেশের নয়, গোটা বিশ্বের জন্য আশার আলো।’ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মারিয়া কোরিনা মাচাদোর এই অর্জন আবারও প্রমাণ করল, শান্তি ও গণতন্ত্রের সংগ্রাম কখনও পৃথক নয়। নরওয়ের নোবেল কমিটি এই ঘোষণার মাধ্যমে একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে, অস্ত্র নয়, সাহসী কণ্ঠই পরিবর্তনের মূল শক্তি। এক সময় বলেছিলেন মাচাদো, ‘আমরা বন্দুক নয়, মানুষের বিশ্বাস নিয়ে লড়ি। কারণ গণতন্ত্রের পথে হেঁটে যাওয়াটাই আমাদের একমাত্র অস্ত্র।’ আজ সেই লড়াইয়ের স্বীকৃতি পেল সারা বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কারে।
ছবি : সংগৃহীত
আরও পড়ুন : Nobel Prize Literature 2025, Laszlo Krasznahorkai | সাহিত্যে নোবেল ২০২৫ পেলেন হাঙ্গেরীয় লেখক লাসজলো ক্রাজনাহোরকাই




