Sasraya News

Love, sex and Ancient India : প্রাচীন ভারতে প্রেম যৌনতায় ধর্মীয় ও সামাজিক প্রেক্ষাপট 

Listen

প্রাচীন ভারত : প্রেম ও যৌনতা 

মিলন দত্ত : প্রাচীন ভারতে যৌনতার (Love, sex and Ancient India) ধর্মীয় কাঠামো বিশ্লেষণ করতে হলে, আমাদের ক’য়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক সম্পর্কে আলোচনা করতে হবে। যেমন, প্রাচীন ভারতীয় ধর্মীয় গ্রন্থ, সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশেষ করে হিন্দু ধর্মের মধ্যে যৌনতা কীভাবে দেখা হত! ভারতে যৌনতা ও ধর্মের সম্পর্ক বহুকাল ধরেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং বিভিন্ন ধরণের ধর্মীয় গ্রন্থ, দর্শন এবং সামাজিক রীতির মাধ্যমে তা প্রকাশিত হয়েছে।

যেমন, কামসূত্র ও যৌনতার কথা এখানে বলা যায়।
প্রাচীন ভারতে যৌনতার ধর্মীয় এবং সামাজিক কাঠামোকে বোঝার জন্য “কামসূত্র” একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। এটি লেখা হয়েছিল ২য় শতাব্দী খ্রিস্টাব্দে, বাৎসায়ন নামে এক পণ্ডিতের তা লিখেছিলেন। লেখক এখানে মূলত যৌন সম্পর্কের শৈলী ও উপকরণ নিয়ে আলোচনা করেছেন। তবে এতে মানবিক সম্পর্কের গুরুত্ব এবং কামনা (কাম) বিষয়টিও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

ছবি : সংগৃহীত

কামসূত্র-এ উল্লেখ যে, কামনা (অর্থাৎ যৌনতা) শুধু শারীরিক তৃপ্তি নয়। বরং এক ধরনের সামাজিক ও আধ্যাত্মিক অভিব্যক্তি হিসেবে দেখানো হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে, কামনা একটি মানবিক অনুভূতি।  যা ঠিকভাবে পরিচালিত হলে মানুষের জীবনে আনন্দ এবং প্রশান্তি আনতে পারে। তবে, তা সর্বদা সতর্কতার সঙ্গে ও আত্মসংযমের মধ্যে থাকা উচিত। এছাড়াও ধর্মীয় গ্রন্থে ভারতীয় হিন্দু ধর্মের প্রাচীন গ্রন্থগুলির মধ্যে, “ব্রাহ্মণ গ্রন্থ” এবং “উপনিষদ”-এ যৌনতা এবং কাম সম্পর্কিত কিছু আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ পাওয়া যায়। এখানে যৌনতা শুধু শারীরিক সম্পর্ক হিসেবে নয়। এটি আত্মা ও শরীরের মিলনের একটি প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। যেমন, উপনিষদ-এ বলা হয়েছে— মানুষের জীবনে প্রেম, কামনা এবং যৌনতা ঐশ্বরিক শক্তিরই একটি অংশ। যেমন, “প্রকৃতির কামনা” বা “কাম দেব” (কামদেব) হলেন যে ঈশ্বরীয় শক্তি। যিনি পৃথিবীজুড়ে প্রাকৃতিক জগতের সমস্ত জীবের মধ্যে কামনা ও প্রেমের সৃষ্টি করেন।

 

যৌনতা ও প্রেমের ক্ষেত্রে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে বলা যায়, প্রাচীন ভারতে প্রথাগত সমাজ কাঠামোতে যৌনতা এবং প্রেমের অনেকটাই ধর্মীয়, সামাজিক, এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করা হত। এই শ্রেণী বিভাজনগুলি সরাসরি সংযুক্ত ছিল ক্ষমতা, সম্পদ, এবং সামাজিক অবস্থানের সঙ্গেই। অনেক সময়, প্রেম বা যৌন সম্পর্ক শুধুমাত্র ব্যক্তি বা শ্রেণীর ইচ্ছার ওপর নির্ভর করত না। বরং সমাজের ও ধর্মীয় বিধির ওপরেও নির্ভর অনেক বেশি নির্ভরশীল ছিল।

আবার ধর্মীয় আচার এবং সংস্কৃতি— যেমন, প্রাচীন ভারতীয় সমাজে ধর্মীয় আচারে যৌনতার স্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অনেক পুরাণে ও মন্দিরের ভাস্কর্যগুলোতে যৌনতা বা কাম ব্যাপারটি পূর্ণ মর্যাদায় উপস্থাপিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, খাজুরাহ মন্দির (Khajuraho Temple) এবং কোনার্ক সর্য মন্দির (Konark Sun Temple)-এর ভাস্কর্যগুলিতে যৌনতার দৃশ্যাবলী রয়েছে। যা ধর্মীয় আচার এবং আধ্যাত্মিকতা সঙ্গেই সম্পর্কিত। এই ভাস্কর্যগুলোতে দেখানো হয়েছে, যৌনতা ও রূপকথার মধ্যে গভীর আধ্যাত্মিক এএকাত্মবোধ রয়েছে।

আবার আলোচ্য বিষয়ে সামাজিক ধারণা ও ধর্মীয় বিধি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করলে দেখা যায়, সমস্ত পুরাণ এবং ধর্মীয় গ্রন্থে যৌনতা মোটেও মুক্তভাবে অনুমোদিত ছিল না। প্রচলিত ধর্মীয় বিধি, যেমন ধর্মশাস্ত্র-এ যৌনতা শুধুমাত্র বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।

প্রাচীন ভারতে যৌন রীতি: প্রাচীন ভারতে যৌন রীতির ওপর কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করা যেতেই পারে। যেগুলি সমাজের সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে উদ্ভূত ছিল। প্রাচীন ভারতে যৌনতা এবং সম্পর্ককে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এক ধরনের পবিত্রতা ও দায়িত্বশীলতা হিসেবে দেখা হত। বিভিন্ন ধর্মীয়, সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে তা গুরত্বপূর্ণ ছিল। এখানে ফের  আমাদের ফিরে যেতে হয় প্রাচীন গ্রন্থ ‘কামসূত্র’-এ (Kamasutra)।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, প্রাচীন ভারতীয় যৌন রীতির সবচেয়ে পরিচিত গ্রন্থ হল বাৎসায়ন রচিত কামসূত্র। এটি মূলত যৌনতা, প্রেম, সম্পর্ক এবং মানবীয় অনুভূতিগুলির আধারিত হয়েছে বললে ভুল বলা হবে না। কামসূত্র-এর মধ্যে শুধু যৌন কৌশলই নয়, বরং সম্পর্কের মানসিকতা, সামাজিক নৈতিকতা, শিষ্টাচার ও জীবনের আরও গভীর দিকগুলিরও আলোচনা করা হয়েছে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল, মানব জীবনের সঠিক ভারসাম্য বজায় রাখা—যাতে কাম, অর্থ, ধর্ম এবং মোক্ষ একত্রে পালন করা যায়।

এখানে কামসূত্রের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করতেই হয়। যেমন
সামাজিক সম্পর্ক: কামসূত্র শুধুমাত্র যৌনতার বিশ্লেষণ করে না। এটি প্রেম, পারস্পরিক সম্পর্ক এবং পরিবারের দায়িত্বের সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত। এছাড়াও শিল্প ও সৌন্দর্য চেতনার এক একটি দরজাও উন্মোচন করে গ্রন্থটি। প্রাচীন ভারতে যৌনতা এবং শারীরিক সম্পর্ককে এক ধরনের শিল্প ও শৈলী হিসেবে দেখা হয়েছে। যেখানে সৌন্দর্য ও যৌনতার আঙ্গিকও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলেই প্রাচীন গ্রন্থগুলি আজও সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।

প্রাচীন ভারতে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ: ভারতের প্রাচীন ধর্ম গ্রন্থগুলি, বিশেষত হিন্দুধর্ম, যৌনতা এবং সম্পর্কের মধ্যে পবিত্রতা ও ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধা রাখার গুরুত্ব মানবসমাজকে প্রদান করে গিয়েছে। হিন্দু ধর্মে কাম (যৌনতা) এক একটি ধন ও জীবনের চারটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যের মধ্যে অন্যতম। অন্যান্য ধর্মীয় ও দার্শনিক গ্রন্থ যেমন ‘অর্থশাস্ত্র’ এবং মনু সংহিতা’-এর মধ্যে বিভিন্ন সামাজিক আচরণ ও যৌনতা সম্পর্কিত বিধি-নিষেধ পাওয়া যায়। যা মূলত সামাজিক ও ধর্মীয় শৃঙ্খলার অংশ হিসেবেই তৎকালীন সমাজে গৃহীত হত বলে জানা যায় গ্রন্থগুলি থেকে।

সামাজিক কাঠামো ও রীতিনীতি: প্রাচীন ভারতে  যৌন সম্পর্কগুলি সাধারণত সামাজিক শৃঙ্খলাও  পারিবারিক কাঠামোর মধ্যে আবদ্ধ ছিল। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র— ভারতীয় সমাজের প্রাচীন ধর্মীয় ও সামাজিক স্তরের সঙ্গে ভীষণভাবে সম্পর্কিত। এই স্তরগুলি যথাক্রমে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, এবং শূদ্র— হিন্দু ধর্মে চারটি প্রধান জাতিভিত্তিক শ্রেণী। আলোচ্য বিষয় যেহেতু যৌনতা ও প্রেম, সেটা সামাজিক সম্পর্ক ও ক্ষমতার দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ছবি : সংগৃহীত

ব্রাহ্মণ (Brahmin): ব্রাহ্মণ শ্রেণী হিন্দু ধর্মে সবচেয়ে উচ্চতর সামাজিক স্তর হিসেবে পরিচিত। এবং সমাজে তাদের মূল কাজ ছিল ধর্মীয় কাজকর্ম, পৌরহিত্য ও শিক্ষা প্রদান করা। প্রেম ও যৌনতা এই শ্রেণীর ভেতরে অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত ছিল, কারণ ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের মধ্যে তারা সাধারণত সতীত্ব, পবিত্রতা ও আধ্যাত্মিকতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। মনে রাখতে হবে, সমাজের মধ্যে পারিবারিক বিয়ের ব্যবস্থা শক্তিশালী ছিল। সেহেতু প্রেমের বিষয়টিও সাধারণত সীমিত স্তরেই সীমাবদ্ধ ছিল। এবং তা প্রথাগত সামাজিক বৃত্তের ভেতরেই থাকত। তবে কিছু ক্ষেত্রে, আধ্যাত্মিক চর্চা বা গুরু-শিষ্য সম্পর্কেও গভীর অনুভূতি বা সম্পর্কের ধারণা পাওয়া যায়। সেগুলি সাধারণত আধ্যাত্মিক স্তরেই সীমাবদ্ধ ছিল। ক্ষত্রিয় (Kshatriya): ক্ষত্রিয়রা রাজা, সেনাপতি, ও সামরিক নেতাদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তাদের জীবনে বীরত্ব, ক্ষমতা, এবং রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যৌনতা ও প্রেমের ক্ষেত্রে, ক্ষত্রিয় শ্রেণী অন্যান্য শ্রেণী থেকে কিছুটা আলাদা ছিল। তার কারণ তাদের মধ্যে বেশি সামাজিক স্বাধীনতা ছিল। তারা প্রাসাদে বা রাজকীয় পরিবেশে অনেক দৃষ্টিকোণ থেকে বেশি জনপ্রিয় ছিলেন। যেহেতু তারা রাষ্ট্র পরিচালনা এবং সেনা বাহিনীর নেতৃত্ব দিতেন, তাই তাদের যৌন সম্পর্ক বা প্রেমের ক্ষেত্রেও অনেক বেশি সানন্দভাবে একাধিক স্ত্রীর ধারণা প্রচলিত ছিল (যেমন, রাজা বা রাজপুত্ররা)। তাদের জীবনধারায় প্রেমের অনেকটাই প্রাতিষ্ঠানিক এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকত।
বৈশ্য (Vaishya): বৈশ্যরা ব্যবসায়ী, কৃষক এবং ব্যবসা সংক্রান্ত কাজকর্মে নিয়োজিত ছিলেন। তাদের মধ্যে প্রেম এবং যৌনতা অনেকটা সামাজিক ও আর্থিক অবস্থার ওপর নির্ভর করত। বৈশ্য শ্রেণী সমাজে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের পরিবারকে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এবং সামাজিক অবস্থান প্রদান করতে চেয়েছিল, এবং তাই তাদের মধ্যে বিয়ে এবং সম্পর্কের ব্যাপারে বেশ কিছু সামাজিক এবং আর্থিক নিয়ম ছিল। যদিও তারা সাধারনত একাধিক স্ত্রীর ধারণা মেনে চলতে পারতেন, তবে তাদের জীবনধারা কিছুটা বেশি আড়ালেই থাকত। এবং সম্পর্কের ক্ষেত্রে আদর্শগুলি আরও প্রথাগত হত। বিশেষত প্রেম বা যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাদের সামাজিক অবস্থান অনেকটাই প্রভাবিত করত।
শূদ্র (Shudra): শূদ্ররা মূলত শ্রমিক শ্রেণীভুক্ত ছিলেন। তারা সমাজের বাকি তিনটি শ্রেণীর অধীনস্থ ও তাদের জন্য তুলনামূলকভাবে কম সামাজিক অধিকার ছিল। প্রেম ও যৌনতা এই শ্রেণীতে সাধারণত সামাজিক ও অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে খুবই প্রথাগত ছিল। তাদের ওপর অনেক সময়ই শোষণ, বৈষম্য, এবং নিপীড়নের ঘটনাও ঘটত। এখানে মনে রাখতে হবে, প্রেম ও যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এক ধরনের নিগৃহীত অবস্থা থাকত। কারণ শূদ্রদের অধিকাংশ সময়ই নিজের ইচ্ছার বাইরে কর্তৃত্বশীল সমাজের নিয়মের মধ্য দিয়েই চলতে হত।

যৌনতা ও প্রেমের ক্ষেত্রে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে বলা যায়, প্রাচীন ভারতে প্রথাগত সমাজ কাঠামোতে যৌনতা এবং প্রেমের অনেকটাই ধর্মীয়, সামাজিক, এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করা হত। এই শ্রেণী বিভাজনগুলি সরাসরি সংযুক্ত ছিল ক্ষমতা, সম্পদ, এবং সামাজিক অবস্থানের সঙ্গেই। অনেক সময়, প্রেম বা যৌন সম্পর্ক শুধুমাত্র ব্যক্তি বা শ্রেণীর ইচ্ছার ওপর নির্ভর করত না। বরং সমাজের ও ধর্মীয় বিধির ওপরেও নির্ভর অনেক বেশি নির্ভরশীল ছিল।যদিও প্রেমের জন্য নির্দিষ্ট সামাজিক বিধিনিষেধ ছিল। তবে প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে (যেমন কামসূত্র এবং গীতা), বিভিন্ন ধরনের প্রেম, যৌনতা এবং সম্পর্কের আলাদা আলাদা রূপ ফুটে উঠেছে। এখানে সাধারণত দু’টি মূল দৃষ্টিভঙ্গি পরিলক্ষিত হয়: একদিকে আধ্যাত্মিক প্রেমের ধারণা, এবং অন্যদিকে দৈহিক এবং শারীরিক সম্পর্কের প্রতি বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি। এমনকী প্রাচীন সমাজের মধ্যে “কাম” (যৌনতা) ও “ধর্ম” (ধর্মীয় বিধি) একে অপরকে পরিপূরক হিসাবেই ধরা হত।

ছবি : প্রতীকী ও সংগৃহীত
আরও পড়ুন : Mutton Curry : জামাইষষ্ঠীতে জামাইয়ের মন জিততে বানিয়ে ফেলুন সুস্বাদু মাটন কষা

Sasraya News
Author: Sasraya News

Leave a Comment

Also Read