



পশ্চিমবঙ্গের ভোট রাজনীতির কড়চা
কলম ধরলেন বাংলার রাজ্য রাজনীতি নিয়ে সাশ্রয় নিউজ এর পক্ষে প্রতিবেদক অগ্নি প্রতাপ
পশ্চিমবঙ্গ ★ সাশ্রয় নিউজ : ২০২৪ সালের লোকসভা পশ্চিমবঙ্গে এক নতুন ইতিহাস তৈরি করতে যাচ্ছে। কারণ জাতীয় স্তরে ভোট হলেও বর্তমান বঙ্গের ভোটের প্রধান ইস্যু বলতে খালি দুর্নীতি। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস বিভিন্নভাবে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় বিরোধীরা এক জোট হয়ে সবাই আক্রমণ সানাচ্ছে। তৃণমূল কংগ্রেসের হাতিয়ার হচ্ছে বিভিন্ন সামাজিক খাতে উন্নয়ন এবং মহিলাদের জন্য লক্ষ্মীর ভাণ্ডার। কিন্তু তাতে বিরোধীরা মানতে নারাজ। কারণ যদি উন্নয়ন হয়েই থাকে তাহলে স্বাভাবিক ভোট প্রক্রিয়া একমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই করা হচ্ছে না যেখানে অন্যান্য রাজ্যে এই লোকসভা ভোটকে কেন্দ্র করে কোনও হিংসা বা সন্ত্রাসের অভিযোগ নেই। প্রতিটি জনসভা থেকে তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো তথা মুখ্যমন্ত্রী মাননীয়া মমতা ব্যানার্জি মহাশয়া এবং দলের সাধারণ সম্পাদক মাননীয় অভিষেক ব্যানার্জি মহাশয় অভিযোগ করেই চলেছেন, যদি অন্য দলকে ভোট দিলে বা বিজেপিকে ভোট দিলে সমস্ত লক্ষ্মীর ভাণ্ডার বন্ধ হয়ে যাবে। তার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় জনতা পার্টি পক্ষ থেকে এবং বিধানসভার বিরোধী দলনেতা মাননীয় শ্রী শুভেন্দু অধিকারী মহাশয় এর বিরোধিতা করে বলেন যে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার হচ্ছে সরকারি প্রকল্প এখানে কারোর ব্যক্তিগত অর্থ কোনও পশ্চিমবঙ্গবাসীকে দেওয়া হচ্ছে না। তাই বন্ধ করার কোনও কারণ নেই।
উল্টে তাদের দাবি ৩০টির বেশি লোকসভা আসন পেলে এবং পশ্চিমবঙ্গে সরকার পরিবর্তন হলে অন্নপূর্ণা নামক যোজনা চালু করবেন যাতে করে মহিলারা মাসিক ৩০০০ টাকা করে পান। এবার দেখে নেওয়া যাক, বর্তমান রাজনৈতিক সমীকরণ কি বলছে।
______________________________________________
২০২২ সালেই শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতার হন এবং তার বান্ধবীর বাড়ি থেকে কোটি কোটি টাকা উদ্ধার হয়। এরপর ২০২৩ সাল পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাসের মাত্রা ছাড়িয়ে যায় এবং বিরোধীদের কন্ঠ রোধ করে এবং সমস্ত নীতি বিসর্জন দিয়ে গণতন্ত্রের উৎসবের নামে তৃণমূল কংগ্রেস সমস্ত জায়গাতেই বলপূর্বক লুট করে। ২০২৩ সালেই রেশন দুর্নীতি কাণ্ডে বর্তমান বনমন্ত্রী এবং প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক গ্রেপ্তার হন। যেখানে হাজার হাজার কোটি টাকা সাধারণ মানুষের এক কথায় গরিব মানুষের টাকা আত্মসাৎ এর যে অভিযোগ ছিল সেটা আস্তে আস্তে মানুষের কাছে সত্যি হতে লাগে।
______________________________________________
এই লোকসভা ভোটের কোন দল কত আসন পেতে পারে তার বিশ্লেষণ যখন করা হচ্ছে তাতে মানুষের সাথে কথা বলে যেটা জানা যাচ্ছে তার ওপরেই এই বিশ্লেষণ।
২০১১ সালে ১৩ মে পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর মানুষ কংগ্রেস এবং তৃণমূল কংগ্রেস জোটকে ক্ষমতায় নিয়ে আসে। ২০১১ সালে যখন এই জোট ক্ষমতায় আসে তখন শুধুমাত্র কংগ্রেস এবং তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থকরাই ভোট দিয়েছেন তা নয় বামফ্রন্টের একটা অংশও চেয়েছিল পরিবর্তন আসুক। যাতে করে পশ্চিমবঙ্গবাসীর সমস্ত শ্রেণীর মানুষের ভালো হয় এবং সন্ত্রাসমুক্ত হয়।
২০১১ সালে সরকার পরিবর্তন হবার আগে যেখানে অত্যাধিক লোডশেডিং হত আজ কিন্তু সেই দিনের পরিবর্তন হয়েছে। হ্যাঁ, এটা ঠিক বিদ্যুতের দামও অন্যান্য রাজ্যের থেকে আমাদের পশ্চিমবঙ্গে ইউনিট কিছু অনেকটাই বেশি। বর্তমানে ভোট চলাকালীন এই জিনিসটি সামনে আসে এবং সাধারণ মানুষ এর তীব্র প্রতিবাদ করছেন।
পশ্চিমবঙ্গে পরতে পরতে যেখানে দুর্নীতি আজ তৃণমূল কংগ্রেসের একনিষ্ঠ সৈনিকরাও তা বুঝতে পেরেছে আর বুঝতে পেরেছে বলেই এই দলের থেকে তারা দূরত্ব বাড়িয়ে রয়েছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষণ হচ্ছে এটাই যে দলের কর্মী অসন্তোষ তৈরি হয় সেই দলে দল পরিচালনা করা এবং দলের কাজকর্ম বা কর্মসূচিকে সাফল্যমণ্ডিত করা তা ভীষণ কঠিন হয়ে ওঠে।
২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা ভোটে তা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। যেখানে অনেক নামিদামি তৃণমূল নেতারা ভারতীয় জনতা পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন এবং যেভাবে হাজার হাজার তাদের অনুগামীরা ঠিক একই ভাবে বিজেপিকে সমর্থন করেছিলেন ঠিক তখনই এই দলের হয়ে সমস্ত দায় দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন কোনও কিছু চিন্তা ভাবনা না করে সেই একনিষ্ঠ কর্মীরাই। রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রশান্ত কিশোরের সংস্থা আই প্যাক এর সঙ্গে বিশাল টাকার বিনিময়ে চুক্তি হয় রাজনৈতিক লড়াই। শুরু হয় দিদিকে বল। সাধারণ মানুষ থেকে দলের একনিষ্ঠ কর্মীরা ভেবেছিল বোধহয় এবার হয়ত তৃণমূল কংগ্রেস দলটা নিজেদের অবস্থান পাল্টে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত নেতা-নেত্রীদের তাদের দলের বাইরে করে দেবেন। বর্তমান বিরোধী দলনেতা মাননীয় শ্রী শুভেন্দু অধিকারী মহাশয় এবং তার অনুগামী তৃণমূল কংগ্রেসের অনেক বিধায়কই দল পরিবর্তন করে ভারতীয় জনতা পার্টিতে যোগদান করেন কিন্তু এখানে একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে যায়। বিরোধী দলনেতার অভিযোগ হল যে, দলে যে-কোনও দলীয় পদে বা জন প্রতিনিধি টিকিট পেতে দলকে অর্থ প্রদান করতে হয় আর সেই কারণেই দলের বেশিরভাগ পদাধিকারী এবং জনপ্রতিনিধিরা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিভিন্ন প্রকল্প খাতে টাকা নিয়ে থাকেন।তিনি ২০২১ সালে যে কথাগুলো প্রতিটি জনসভায় বা মিটিংয়ে বলেছিলেন তা বাস্তবে ধীরে ধীরে সত্যি হতে যাচ্ছে আর এখানেই সাধারণ মানুষ থেকে আরম্ভ করে সবাই একটু হলেও নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিজের ভোট নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেন।
২০২২ সালে পৌরসভা নির্বাচনের সময় দেখা যায় সেই একই ছবি এবং আগের থেকে যা তীব্রতা অনেকটাই বেড়ে যায় মানুষের নিজেদের অধিকার তাদের নিজের ভোট নিজে দেওয়ার উপর আসে চরম আঘাত। সমস্ত জায়গাতেই শাসক দলের পক্ষে ভোট লুট করা হয় যা বিরোধীরা ২০২৪ লোকসভা ভোটেও তৃণমূল কংগ্রেসকে প্রতিটি সভা থেকে আক্রমণ করে চলেছেন।
২০২২ সালেই শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতার হন এবং তার বান্ধবীর বাড়ি থেকে কোটি কোটি টাকা উদ্ধার হয়। এরপর ২০২৩ সাল পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাসের মাত্রা ছাড়িয়ে যায় এবং বিরোধীদের কন্ঠ রোধ করে এবং সমস্ত নীতি বিসর্জন দিয়ে গণতন্ত্রের উৎসবের নামে তৃণমূল কংগ্রেস সমস্ত জায়গাতেই বলপূর্বক লুট করে।
২০২৩ সালেই রেশন দুর্নীতি কাণ্ডে বর্তমান বনমন্ত্রী এবং প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক গ্রেপ্তার হন। যেখানে হাজার হাজার কোটি টাকা সাধারণ মানুষের এক কথায় গরিব মানুষের টাকা আত্মসাৎ এর যে অভিযোগ ছিল সেটা আস্তে আস্তে মানুষের কাছে সত্যি হতে লাগে।
২০২৪ সালে সন্দেশখালির ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের শাসকের কফিনে পেরেক মারার মত। এছাড়াও কয়লা, গরু পাচার, বালি এবং আরো অনেক কিছু দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত চলছে যা সাধারণ মানুষ মেনে নিতে পারছেন না। যোগ্য শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা দিনের পর দিন রোদ বৃষ্টি শীত উপেক্ষা করে রাস্তায় বসে রয়েছে। আর যোগ্য অযোগ্য নিয়ে সরকারের দায় সারা ভাব সাধারণ মানুষ ও ভালো চোখে নেয়নি। তাই ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে মানুষ নির্বিঘ্নে নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিঃশব্দে প্রয়োগ করে যাচ্ছেন। যার ফলস্বরূপ আগামী দিন ৪ জুন অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাবে।
২০২৪ লোকসভা ভোট পশ্চিমবঙ্গে বর্তমানে মূলত লড়াই হচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস এবং ভারতীয় জনতা পার্টির মধ্যে। তার মধ্যে কিছু আসনে কংগ্রেস এবং বামফ্রন্ট জোট আর আইএসএফ অনেকটাই এই পরিবর্তনের একটা মেজর রোল হতে যাচ্ছে।
পরিবর্তনের কারণগুলি কিসের উপরে বিশ্লেষণ করা হয়েছে তা নিয়ে আমরা আলোচনা করছি-
১. বর্তমানে জাতীয় স্তরে একদিকে এনডিএ জোট এবং আরেক দিকে ইন্ডিয়া জোট।
২. এনডিএ জোটের তৃতীয় বার প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী মাননীয় নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদীজি যেখানে ইন্ডিয়া জোটের এখনও পর্যন্ত কোনও প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নির্বাচন করা যায়নি।
৩. ২০১৪ সাল থেকে বিজেপি সরকার থাকাকালীন কোনও দুর্নীতির অভিযোগ এখনও পর্যন্ত সামনে আসেনি।
৪. ইন্ডিয়া জোটের প্রতিটি দলের নেতা নেত্রীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে এবং এই জোটের বড় শরিক জাতীয় কংগ্রেস বিভিন্ন ইস্যুতে জর্জরিত।
৫. রাষ্ট্রপতি নির্বাচন এসসি এবং এসটি ভোটব্যাঙ্ক এটি একটি বড় ফ্যাক্টর।
৬. ২০১৪ এবং ২০১৯ এ দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভারতীয় জনতা পার্টি ভারতকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী ভারত বানানো, তিন তালাক বাতিল থেকে কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিল এবং সর্বশেষ রাম মন্দির নির্মাণ যা সাধারণ মানুষের কাছে অনেকটাই গ্রহণযোগ্য।
৭. দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন আগামী দিন প্রতিষ্ঠা করা।
৮. দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে করা ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৯. পশ্চিমবঙ্গের যত সরকারি শূন্য পদ আছে তা সঠিক এবং স্বচ্ছভাবে নিয়োগের মাধ্যমে পূর্ণ করা থেকে সরকারি কর্মীদের বকেয়া ডিএ প্রদান করা।
১০. সবকা সাথ সবকা বিকাশ সাধারণ মানুষের কাছে পজিটিভ দিক।
১১. পশ্চিমবঙ্গের দীর্ঘদিন ধরে কর্মসংস্থানের অভাব বাংলায় বিরোধীদের অনেক এগিয়ে রেখেছে।
১২. নতুন করে বিদ্যুতের মাসুল বৃদ্ধি পাওয়ায় সাধারণ মানুষের মনে ক্ষোভের সঞ্চার।
১৩. মূলত মানসিক এবং সাংগঠনিক ভাবে তৃণমূল কংগ্রেস আত্মনির্ভর না হবার ফলে পুলিশের উপর বাড়তি ভরসা বিরোধীদের লাভের আরেকটি কারণ।
১৪. সর্বক্ষেত্রে বলপূর্বক বিরোধী শক্তিকে বিরোধীশূন্য করার লক্ষ্য যা শাসক কেই দুর্বল করে।
১৫. কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট জোট এবং আইএসএফের উপস্থিতি এই নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের আগের বারের বহু আসন হারিয়ে যাবার সম্ভাবনা প্রবল।
১৬. শাসকের দিনে দিনে কর্মী অসন্তোষ বিরোধীদের লাভের কারণ।
১৭. সন্দেশখালির নারী ও জমি কেন্দ্রীক প্রতি রাজ্যের শাসকদল আশ্রিতদের সন্ত্রাস।
১৮. রাজ্যের শাসকদলের অন্তর্রদলীয় কোন্দল।
সর্বশেষে পশ্চিমবঙ্গে এই ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে ভোটের ফলাফল শতাংশ বিচারে-
১) ভারতীয় জনতা পার্টি ৪৭ শতাংশের বেশি ভোট পেতে পারে।
২) তৃণমূল কংগ্রেস সর্বোচ্চ ৩৪ শতাংশ ভোট পেতে পারে।
৩) কংগ্রেস এবং বামফ্রন্ট জোট সর্বোচ্চ ১৬ শতাংশ ভোট পেতে পারে।
৪) আইএসএফ সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ ভোট পেতে পারে যা তৃণমূল কংগ্রেস এবং কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট জোটের মোট শতাংশ থেকে কাটতে পারে।
৫) কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট জোট এবং আইএসএফের সংখ্যালঘু ভোট শতাংশ এই নির্বাচন নির্ণায়ক হবে।
সম্ভাব্য ২০২৪ লোকসভা নির্বাচন পশ্চিমবঙ্গের ফলাফল –
বিজেপি ২৭ – ৩০, তৃণমূল কংগ্রেস ১৪-১১ কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট জোট ০২
ছবি ঋণ : আন্তর্জালিক
