



‘পশ্চিমবঙ্গের ভোট রাজনীতির কড়চা’ -এর সপ্তম পর্ব। কলম ধরলেন বাংলার রাজ্য রাজনীতি নিয়ে সাশ্রয় নিউজ এর পক্ষে প্রতিবেদক অগ্নি প্রতাপ
১৪৮৫ (মতান্তরে) ১৪৮৬ খ্রীস্টাব্দে দোল পূর্ণিমার দিনে নবদ্বীপের মায়াপুর পল্লীতে শ্রী চৈতন্যদেবের জন্ম হয়।
বাঙালি হিন্দু সমাজে গৌড়ীয় বৈষ্ণব আন্দোলনের প্রাণপুরুষ শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর স্মৃতি বিজড়িত। ১৭৮৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্বকালে নদীয়া জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ।
নদীয়া জেলার অন্যতম লোকসভা কেন্দ্র হল কৃষ্ণনগর। এটি মূলত কৃষি নির্ভর এবং ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের জন্য বিখ্যাত। কৃষ্ণনগর কেন্দ্রটি বেশিরভাগ মানুষ জাতীয়তাবাদীর পক্ষে রায় দিয়েছেন।
২০০৯ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দুইবার এই কেন্দ্রের সাংসদ ছিলেন তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী তাপস পাল। তার বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য সমাজের সর্বস্তরের মানুষ থেকে সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলি প্রতিবাদে সমালোচনার ঝড় তুলেছিলেন।
মহুয়া মৈত্র প্রথমবার ২০১৬ সালে করিমপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে জয়ী হন এবং ২০১৯ সালে কৃষ্ণনগর লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য বিধানসভা থেকে পদত্যাগ করেন।
২০১৯ সাল লোকসভা নির্বাচনে কৃষ্ণনগর কেন্দ্র থেকে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী মহুয়া মৈত্র ৪৫ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ভারতীয় জনতা দল প্রার্থী কল্যান চৌবে ৪০.৫ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন।
এই লোকসভা কেন্দ্রে তপশিলি জাতি ও তপশিলি উপজাতি ৩২.৬ শতাংশ, মুসলিম সংখ্যালঘু ২৬.৭৬ শতাংশ।
সাংসদ মহুয়া মৈত্র একজন উচ্চ শিক্ষিতা এবং সুবক্তা। তার বিলাসবহুল লাইফ স্টাইলের জন্য বিতর্ক সর্বদা তাড়া করে বেড়ায়। সনাতন ধর্মে মা কালি সম্বন্ধে কুরুচি কথা বলে বিরোধীরা একযোগে সনাতন বিরোধী প্রশ্ন তুলে তোপ দাগতে থাকেন। ২০২০ সালে একবার দলীয় সভায় মেজাজ হারিয়ে এক সাংবাদিককে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকেন “কে এই দু পয়সার সাংবাদিক”। এই মন্তব্যের জেরে তীব্র নিন্দার ঝড় ওঠে। তার এই মেজাজের জন্য তৃণমূলের “ফায়ার ব্র্যান্ড’ বলা হত।
২০২৩ সালে ডিসেম্বর মাস ক্যাশ- ফর-কোয়েরি মামলায় লোকসভা থেকে বহিষ্কার করা হয় কৃষ্ণনগরের সাংসদ মহুয়া মৈত্র তথা তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থীকে।
ভারতীয় জনতা পার্টি কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পরিবারের রাজ বধু বর্তমানে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির রাজমাতা শ্রীমতী অমৃতা রায়কে লোকসভা আসনের প্রার্থী ঘোষণা করেন। বিরোধী দলনেতা মাননীয় শুভেন্দু অধিকারী মহাশয়ের বক্তব্য ছিল, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মাননীয় নরেন্দ্র মোদি জি, রাজমাতা শ্রীমতী অমৃতা রায় কে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছেন।
রাজমাতা শ্রীমতী অমৃতা রায় প্রার্থী হবার পর শুরু হয় শাসকের আক্রমণ। উঠে আসে ইতিহাসের কথা। শুরু হয় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পলাশীর যুদ্ধের ভূমিকা নিয়ে। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী নবাব সিরাজদোল্লার পরাজয়ের জন্য রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে বেইমান বলে জনসভা থেকে আক্রমণ করেন।
কৃষ্ণনগর লোকসভা কেন্দ্রে শাসকের গোষ্ঠী কোন্দল প্রকাশ্যে চলে আসায় বারবার বিব্রত হতে হচ্ছে। বিরোধীদের আক্রমণ দিনে দিনে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে। বিরোধী দলনেতা মাননীয় শুভেন্দু অধিকারী মহাশয় এবং অন্যান্য বিরোধীরা বারংবার তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী এবং শাসক তৃণমূল কংগ্রেসকে টাকার বিনিময়ে দেশের সংসদের লগইন পাসওয়ার্ড বিদেশে দেওয়ার জন্য প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন।
গত ১৩ই মে ২০২৪ চতুর্থ দফা কৃষ্ণনগর লোকসভা নির্বাচন তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী মহুয়া মৈত্র ও বিজেপি প্রার্থী রাজমাতা অমৃতা রায়-এর মধ্যে মূলত রাজনৈতিক লড়াই। এই লড়াই যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ এবং মর্যাদার লড়াই। রাজনৈতিক বিশ্লেষণ শেষ পর্যন্ত বিজেপি প্রার্থী রাজমাতা অমৃতা রায় জয়ী হবার ইঙ্গিত স্পষ্ট।
রানাঘাট লোকসভা
নদীয়া জেলায় চূর্ণী নদীর তীরে অবস্থিত একটি প্রাচীন জনপদ হচ্ছে রানাঘাট। জেলার একটি শহর ও সমৃদ্ধশালী পৌরসভা। এশিয়ার মধ্যে প্রথম রবীন্দ্র ভবন তৈরি হয়েছিল এই শহরে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম সহ বিশিষ্ট মনীষীদের পদধূলিতে ধন্য হয়েছে এই শহর।
২০০৯ সালে রানাঘাট লোকসভা গঠন হবার আগে পর্যন্ত সরাসরি জাতীয় কংগ্রেস এবং সিপিআই (এমে)-এর মধ্যে রাজনৈতিক ভীষণ লড়াই ছিল।
তৃণমূল কংগ্রেস প্রথম বার রানাঘাট লোকসভা গঠন হওয়ায় এই কেন্দ্র থেকে জয়লাভ করে।
রানাঘাট লোকসভা কেন্দ্রে তপশিলি জাতি ও তপশিলি উপজাতি ৩২.৬ শতাংশ এবং মুসলিম সংখ্যালঘু ২৬.৭৬ শতাংশ। এই কেন্দ্রে মতুয়া সম্প্রদায়ের ভোট শতাংশ নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে।
২০১৯ সালে মুকুটমণি অধিকারীর মনোনয়ন প্রত্যাখ্যান হওয়ার পরে জগন্নাথ সরকার বিজেপি প্রার্থী হিসেবে লোকসভা নির্বাচনে মনোনীত হন।
রানাঘাট লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি প্রার্থী জগন্নাথ সরকার ৫২.৭৫ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী রূপালী বিশ্বাস ৩৭.০৩ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন।
২০২১ সালে রানাঘাট দক্ষিণ বিধানসভা নির্বাচন কেন্দ্র থেকে বিজেপি প্রার্থী হিসেবে মুকুটমণি অধিকারী জয়লাভ করেন। ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের আগে মুকুটমণি অধিকারী বিজেপি দলত্যাগ করে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেন এবং রানাঘাট লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেস মনোনীত প্রার্থী হন।
রানাঘাট লোকসভা কেন্দ্রে প্রচুর শরণার্থীর বসবাস।
কেন্দ্রীয় সরকার সি এ এ (CAA) চালু করার ফলে শরনার্থী ও মতুয়াদের ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়া নিয়ে কোনও সংশয় আর থাকল না। যদিও তৃণমূল কংগ্রেস প্রথমদিকে সিএএ নিয়ে বিভ্রান্তিকর প্রচার করলেও পরবর্তীকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনসভা থেকে রাজ্য সরকারকে বিরোধিতা এবং বিভ্রান্তিমূলক প্রচারের জন্য তীব্র ভাষায় আক্রমণ করায় তৃণমূল কংগ্রেস বিরোধিতা থেকে সরে দাঁড়ান।
এই লোকসভা কেন্দ্রে মুসলিম সংখ্যালঘু ভোটের বড় অংশ সিপিআই (এম) প্রার্থী অলকেশ দাসের দিকে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
গত ১৩ ই মে ২০২৪ চতুর্থ দফা রানাঘাট লোকসভা কেন্দ্র বিজেপি প্রার্থী জগন্নাথ সরকার এবং তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী মুকুটমনি অধিকারীর সম্মুখ লড়াইয়ে বিজেপি প্রার্থীর জয়ী হওয়া সম্ভাবনা প্রবল।
ছবি : আন্তর্জালিক
আরও পড়ুন : Loksabha Election 2024 : পশ্চিমবঙ্গের ভোট রাজনীতির কড়চা-
