



‘পশ্চিমবঙ্গের ভোট রাজনীতির কড়চা’ -এর আজ তৃতীয় পর্ব। কলম ধরলেন বাংলার রাজ্য রাজনীতি নিয়ে সাশ্রয় নিউজ এর পক্ষে প্রতিবেদক অগ্নি প্রতাপ
মালদা এক সময় গৌড়বঙ্গের রাজধানী ছিল। ছিল উত্তরবঙ্গের প্রবেশ দ্বার। এটি হচ্ছে একটি প্রাচীনতম ইতিহাসের সাক্ষী স্থল। এখানে গুপ্ত বংশ থেকে শুরু করে, কর্ণ সুবর্ণের রাজা, পাল রাজ বংশ পরে সেন রাজ বংশ রাজত্ব করেছেন, এবং ১২০৪ খ্রীস্টাব্দে বখতিকার খিলজী বাংলা দখল করা পর্যন্ত। সর্বশেষ ১৭৫৭ সালে বাংলার শেষ নবাব সিরাজ-উদৌল্লা পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে পরাজিত হওয়ার পর মুসলিম রাজত্বের অবসান ঘটে।
স্বাধীনতার পর থেকে মালদা ও মুর্শিদাবাদ জেলা রাজনৈতিকভাবে জাতীয় কংগ্রেসের একটি শক্তিশালী ঘাঁটি বলে পরিচিত ছিল। দীর্ঘ ক’য়েকশো বছর মুসলিম রাজত্বকালে এই দুই জেলায় মুসলিম সংখ্যালঘু বসবাস লক্ষ্যণীয়।
______________________________________________
২০২৪ লোকসভা নির্বাচন হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের দুর্নীতির বিরুদ্ধে বলে দাবী বিজেপির। যেখানে সামান্য পরিষেবা পেতে গেলে এই দলের জনপ্রতিনিধিদের এবং দলের পদাধিকারীদের কাঠমানি দিতে হয়। উন্নয়নের নামে মানুষের ট্যাক্সের টাকা খয়রাতী হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। মুখোশধারী সম্প্রীতির নামে চলছে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ানো।
______________________________________________
মালদা জেলা। অস্বীকার করার জায়গা নেই যে, জাতীয় কংগ্রেসের হয়ে ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত এবিএ গণি খান চৌধুরী যিনি সকলের কাছে বরকত দা বা বরকত সাহেব হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তিনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিধায়ক হিসেবে একটানা নির্বাচিত হয়েছিলেন। এবং ১৯৭২ সালেই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রাজ্যে পরিষদ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার পালন করেন। ১৯৮০ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত টানা আট বার তিনি মালদা লোকসভা আসনে জয়লাভ করে সংসদে জায়গা করে নিয়েছিলেন জানা যায়। ভারতের দুই প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী এবং শ্রী রাজীব গান্ধীর সরকারে রেলমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে গিয়েছেন।
বর্তমানে কলকাতা শহরের মেট্রো রেল ও সার্কুলার রেল তাঁরই প্রচেষ্টায় চালু হয় বিস্তার লাভ করে। পরবর্তীকালে মালদা টাউন রেলস্টেশনকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ রেল স্টেশন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন।
https://elections24.eci.gov.in/
বিভিন্ন উন্নয়ণমূলক কাজের সুবাদে আধুনিক মালদার স্থপতি হিসেবে তাঁকে সম্মান করা হয়ে থাকে আজও। এযাবৎ পর্যন্ত জানা যায়, তাঁর মৃত্যুর পর পরিবার সদস্যরা রাজনীতিতে পা রাখেন এবং সফল হন।
২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেস ও জাতীয় কংগ্রেস জোট সরকার গঠন করে। পরবর্তীকালে তৃণমূল কংগ্রেসের আগ্রাসন-নীতির ফলে মালদার উপর চাপ বাড়তে থাকে। যার পরিণতি ২০০৯ সালে ভাগ হওয়া মালদা উত্তর লোকসভা কেন্দ্র ২০১৯ সালে মৌসুম নূর তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী হয়ে ভারতীয় জনতা পার্টির প্রার্থী খগেন মুর্মুর কাছে পরাজিত হন। এই হারের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ হচ্ছে, পারিবারিক ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে জাতীয় কংগ্রেস এবং তৃণমূল কংগ্রেস বরকত সাহেবের দোহাই দিয়ে মালদার মানুষকে যেভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যে এবং সমস্ত শ্রেণীর বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের শিকার করতে চেয়েছিলেন তা সবাই মেনে নেননি। ঠিক যেমনটি ২০১৯ সালে মালদা দক্ষিণ লোকসভা কেন্দ্রে ভারতীয় জনতা পার্টির প্রার্থী শ্রীরুপা মিত্র চৌধুরী ৩৪ শতাংশ বেশি ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন।
অন্যদিকে মুর্শিদাবাদ জেলা। এই জেলার অন্তর্গত লোকসভা আসন তিনটি। মুর্শিদাবাদ, জঙ্গিপুর ও বহরমপুর। সংখ্যালঘু মুসলিম মেজরিটি এই জেলায় মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশের বেশি। ২০১৯ সালে মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রে ভারতীয় জনতা পার্টির প্রার্থী হুমায়ুন কবির তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী আবু তাহের খানের কাছে পরাজিত হন। এবং ভারতীয় জনতা পার্টি তৃতীয় স্থান অর্জন করে।
২০১৯ সালে জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্রে ভারতীয় জনতা পার্টির প্রার্থী মাফুজা খাতুন ২৪ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থান অধিকার করে। এবং তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী খলিলুল রহমানের কাছে পরাজিত হন।
২০১৯ সালে বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রে ভারতীয় জনতা পার্টির প্রার্থী কৃষ্ণ জোয়ারদার ১১ শতাংশ ভোট পেয়ে জাতীয় কংগ্রেস প্রার্থী অধীর রঞ্জন চৌধুরীর কাছে পরাজিত হন। এবং তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী সঙ্গীতশিল্পী ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছু জিনিসের পরিবর্তন হয়। ঠিক তেমনটাই এই ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনেও ছাপ ফেলতে চলেছে সময়। ২০২৪ লোকসভা নির্বাচন হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের দুর্নীতির বিরুদ্ধে বলে দাবী বিজেপির। যেখানে সামান্য পরিষেবা পেতে গেলে এই দলের জনপ্রতিনিধিদের এবং দলের পদাধিকারীদের কাঠমানি দিতে হয়। উন্নয়নের নামে মানুষের ট্যাক্সের টাকা খয়রাতী হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। মুখোশধারী সম্প্রীতির নামে চলছে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ানো।
১ আগস্ট ২০১৯ সাল সংসদে তিন তালাক শাস্তিযোগ্য সাংবিধানিক আইনে পরিণত করা হয়। ফল স্বরূপ সংখ্যালঘু শিক্ষিত শ্রেণী এবং সংখ্যালঘু মা-বোনেদের ওপর দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই সামাজিক অবক্ষয় অবসানের দিন। ফলে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসা ভারতীয় জনতা পার্টি এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদীজিকে শুধু সংখ্যালঘু শিক্ষিত শ্রেণী এবং সংখ্যালঘু মা-বোনেরাই নয় আপামর ভারতীয় সমস্ত শ্রেণীর মানুষ ও সংসদে উপস্থিত সাংসদরা (*বর্তমানে ইন্ডিয়া জোট বিশেষ করে জাতীয় কংগ্রেস এবং তৃণমূল কংগ্রেস বিরোধিতা করে বিভিন্ন রকমভাবে*) করতালি দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে খুশিতে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
ধীরে ধীরে নিজেদের অসাম্প্রদায়িক, কাছের বন্ধু, তারাই একমাত্র তাদের ভালো চান সেই সংখ্যালঘু ভোটের নোংরা রাজনীতি করা রাজনৈতিক দল জাতীয় কংগ্রেস, বামফ্রন্ট এবং তৃণমূল কংগ্রেস তাদের মিলিত জোট সরকার ২০১৪ সালের আগে পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের থেকেও কোনও দিনের জন্য সংখ্যালঘু মুসলিম শ্রেণীর কীভাবে তাঁদের সামাজিক সম্মান রক্ষা করা যায় তার চিন্তাভাবনা কোনওদিন মাথাতেই আনেননি, কারণ তাদের তো দরকার ভোট।
আরও পড়ুন : Loksabha Election 2024 : পশ্চিমবঙ্গের ভোট রাজনীতি কড়চা
রামনবমীকে কেন্দ্র করে তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো তথা বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মাননীয়া মমতা ব্যানার্জি মহাশয়া প্রতিটি জনসভা থেকে তিনি লাগাতার ভারতীয় জনতা পার্টির ওপর আক্রমণ করতে থাকেন দাঙ্গা লাগানোর অভিযোগ।
গত ১৭ই এপ্রিল ২০২৪ রামনবমীর মিছিলের উপর মুর্শিদাবাদ জেলা রেজিনগর বিধানসভার অন্তর্গত শক্তিপুরে ঘটে যায় এক ভয়ানক প্রাণঘাতী ঘটনা। আশপাশের বাড়ি ছাদ থেকে পড়তে থাকে বোমা, ইট, পাটকেল। অতর্কিত এই আক্রমণের ফলে মিছিলে হাজার হাজার উপস্থিত ভক্তের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায় প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে। ইট, পাটকেলের আঘাতে জখম হন ২০ জন। এই ঘটনায় সবাই হকচকিত হয়ে যান। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিম বাংলা তথা সমগ্র ভারতবর্ষে তীব্র ভাষায় নিন্দার ঝড় ওঠে যা একমাত্র এই রামনবমীকে কেন্দ্র করে এই বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলা ব্যতীত কোনও জায়গাতেই এইরকম কোনও আক্রমণ বা প্রাণ সংশয়ের কোনরূপ কোনও ঘটনা ঘটেনি সাথে সাথে কোনও আঘাত বা জখমের খবর পাওয়া যায়নি।
প্রশ্ন উঠে যায়, কে বা কারা এই আক্রমণের সঙ্গে যুক্ত? আক্রমণকারীদের উদ্দেশ্যই বা কি ছিল?
তাহলে কি কোনও কাউকে খুশি করার জন্য এই আক্রমণ?
না কি কোনও বৃহৎ ষড়যন্ত্র?
এতদিন ভারতীয় জনতা পার্টির বিরুদ্ধে বলা হতো তারা সাম্প্রদায়িক, তারা সংখ্যালঘু শ্রেণীকে মর্যাদা দেন না, শুধুমাত্র তাদেরকে ঘৃণার চোখে দেখা হয়, বিজেপি মানেই দাঙ্গাবাজ। তার উত্তর আজ সেই সংখ্যালঘু শিক্ষিত শ্রেণীর তরফ থেকে আওয়াজ উঠছে এবং প্রতিবাদও করছে। গত ২০১৪ সাল থেকে ভারতীয় জনতা পার্টি কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতায় রয়েছেন কোনও জায়গায় কোনও দাঙ্গা হয়নি, কোনও জায়গাতেই তাঁদের অমর্যাদা করা হয়নি, কোনও অবস্থাতেই তাদেরকে ঘৃণার চোখে দেখা হয়নি, কোনও মাদ্রাসাও বন্ধ হয়নি। এতদিন যাঁদের সাম্প্রদায়িক বলা হতো তাঁরাই তো প্রকৃত পথপ্রদর্শক। যদি তা না হতো তাহলে কীভাবে, কোন যোগে, কি লাভের আশায় অনেক সংখ্যালঘু ভাই বোন আজ ভারতীয় জনতা পার্টির সক্রিয় কর্মী? সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন “সবকা সাথ সবকা বিকাশ” মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মন্ত্র যা সমগ্র ভারতবাসীর কল্যাণের জন্য ডাক দেওয়া হয়েছে।
এই ২০২৪ লোকসভা নির্বাচন বহু ক্ষেত্রেই এই সংখ্যালঘু ভোট নির্ণায়কের অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। যার ফল স্বরূপ মালদা এবং মুর্শিদাবাদ এই দুই জেলায় অনেক কিছু সমীকরণ পাল্টে যেতে পারে। মুসলিম সংখ্যালঘু ভোট শতাংশ এই দুই জেলায় বেশি হওয়া সত্ত্বেও ভোট শতাংশ ভাগাভাগি এবং সংখ্যালঘু একটা অংশের ভোট ভারতীয় জনতা পার্টি পক্ষে যাওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
গত ৭ মে ২০২৪ তৃতীয় দফায় ভোট পর্বে মালদা উত্তর লোকসভা কেন্দ্রে দ্বিতীয় বার ভারতীয় জনতা পার্টির প্রার্থী খগেন মুর্মু, মালদা দক্ষিণ লোকসভা কেন্দ্রে জনতা পার্টির প্রার্থী শ্রীরুপা মিত্র চৌধুরী জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল। অন্যদিকে মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রে ভারতীয় জনতা পার্টির মনোনীত প্রার্থী গৌরীশংকর ঘোষ এবং জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্রে ভারতীয় জনতা পার্টির মনোনীত প্রার্থী ধনঞ্জয় ঘোষ জয়ী সম্ভাবনা ৫০ শতাংশ, বিশেষ করে মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রটি।
ছবি ঋণ : আন্তর্জালিক
আরও পড়ুন :Loksabha Election 2024 : পশ্চিমবঙ্গের ভোট রাজনীতির কড়চা-২
