



‘পশ্চিমবঙ্গের ভোট রাজনীতির কড়চা’ -এর, ত্রয়োদশ পর্ব। কলম ধরলেন বাংলার রাজ্য রাজনীতি নিয়ে সাশ্রয় নিউজ এর পক্ষে প্রতিবেদক অগ্নি প্রতাপ
উত্তর ২৪ পরগনা জেলার অন্যতম লোকসভা কেন্দ্র হল দমদম লোকসভা। ১৯৭৭ সালে এই লোকসভা কেন্দ্রটি গঠন হয়। এই লোকসভা আসনটি একসময় ২০০৯ এর আগে পর্যন্ত বামফ্রন্টের দখলেই ছিল। দমদম লোকসভা কেন্দ্রে তপশিলি জাতীয় উপজাতি ২৫ শতাংশ। মুসলিম সংখ্যালঘু ২৫ শতাংশ।
২০০৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী অধ্যাপক সৌগত রায় প্রথমবার নির্বাচিত হন ৪৭.০৪ শতাংশ ভোট পেয়ে। ২০১৪ এবং ২০১৯ সালেও তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী অধ্যাপক সৌগত রায় টানা তৃতীয়বার এই কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হন ৪২.৫১ শতাংশ ভোট পেয়ে। বিজেপি প্রার্থী শমিক ভট্টাচার্য ৩৮.১১ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন। ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে আবারো তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে অধ্যাপক সৌগত রায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
একদা তৃণমূলে থাকা নেতা শীলভদ্র দত্ত এই দমদম লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপির মনোনীত প্রার্থী।
সিপিআই(এম) -এর বর্ষীয়ান নেতা সুজন চক্রবর্তী এই কেন্দ্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। একদা এই কেন্দ্র বামকেন্দ্রিক ছিল বলে সুজন চক্রবর্তীর প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলে আশা দেখছেন সিপিআইএম নেতা কর্মীরা।
রাজনৈতিকভাবে সকলেরই ভিন্ন ভিন্ন মতবাদ থাকলেও প্রার্থীদের মধ্যে সবথেকে বড় মিল পাওয়া যায় তিনজন প্রার্থী হচ্ছেন প্রবীণ প্রার্থী এবং ইংরেজিতে সকলেরই নামের প্রথম অক্ষর হচ্ছে “S”।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই কেন্দ্রের একাধিক পুরসভার নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় নাম উঠে এসেছে বরানগর, কামারহাটি, পানিহাটি ,উত্তর দমদম। কেন্দ্রীয় এজেন্সির স্ক্যানার এ থাকার ফলে বারংবার ডাক পড়ছে বহু শাসক তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের।
তাই নিয়ে বিরোধীরা তীব্র আক্রমণ করে চলেছে শাসক তৃণমূলের বিরুদ্ধে।
গত ১লা জুন ২০২৪ সপ্তম দফা দমদম লোকসভা কেন্দ্রে ফলাফলের দিকে সবাইকার নজর, এবং জানার ইচ্ছা তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী সৌগত রায় এই নির্বাচন বৈতরণী পার করতে পারবেন! নাকি ১৯৯৮ এবং ১৯৯৯ সালে বিজেপি প্রার্থী মাননীয় তপন শিকদার পরপর দু’বার বিজয়ী হয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন তারই পুনরাবৃত্তি! নাকি এই কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী শীলভদ্র দত্তের হাত দিয়ে পদ্মফুল ফুটবে?
বারাসাত লোকসভা কেন্দ্র
বারাসাত লোকসভা কেন্দ্রটি উত্তর ২৪ পরগনা জেলার অন্যতম লোকসভা কেন্দ্র। এই লোকসভার অন্তর্গত হাবরার বিধায়ক প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী এবং বর্তমান বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক রেশন দুর্নীতি কাণ্ডে তিনি জেলে। আবার বাকিবুর রহমান যিনি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের ভীষণ ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত তিনিও আজকে জেলে।
২০০৯ সাল থেকে টানা তিনবার এই লোকসভা কেন্দ্রে জয়ী হয়ে এসেছেন তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী কাকলি ঘোষ দস্তিদার।
বারাসাত লোকসভা কেন্দ্রে তপশিলি জাতি ও তপশিলি উপজাতি ২৪ শতাংশ বেশি। মুসলিম সংখ্যালঘু ২৫.৮২ শতাংশ।
এবারের লড়াই মূলত তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি প্রার্থী সঙ্গে। ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রের অন্তর্গত সাতটি বিধানসভা থেকেই তৃণমূলের বড় জয় এসেছে।
কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি আপাদমস্তক শাসক তৃণমূল কংগ্রেস দুর্নীতি মায়াজালের ফাঁসে পড়ে। অনেক নেতা মন্ত্রী বর্তমানে জেলে আর অনেক নেতা-মন্ত্রীদের নামে কেন্দ্রীয় এজেন্সি বারবার চিঠি দিয়ে ডেকে পাঠাচ্ছে আর তাতেই শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের কপালে ভাঁজ পড়েছে। চারিদিকে দলীয় কোন্দলের জেরে ভালো নির্বাচনে অনেক জায়গায় ভরাডুবির আশঙ্কাও রয়েছে।
২০১৯ সালে এই লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী কাকলি ঘোষ দস্তিদার ৪৬.৪৪ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। বিজেপি প্রার্থী মৃণাল ক্রান্তি দেবনাথ ৩৮.৫৬ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন।
গত ১ জুন ২০২৪ বারাসাত লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী কাকলি ঘোষ দস্তিদার এবং বিজেপি প্রার্থী স্বপন মজুমদারের মধ্যে মূলত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তৃণমূল কংগ্রেস কিছুটা এগিয়ে। আবার আইএসএফ প্রার্থী দেওয়ার হলে ভোট কাটাকাটি হলে কোন ফুল ফুটবে? তার সময় বলবে।
বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্র
উত্তর ২৪ পরগনা জেলার অন্তর্গত এই বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্র। বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রে তপশিলি জাতি ও তপশিলি উপজাতি এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ৫০ শতাংশের বেশি। সেই জন্য সংখ্যালঘু ভোট যাতে হাতছাড়া না হয় প্রতিটি রাজনৈতিক দলই আদা জল খেয়ে নেমে পড়ে। বর্তমানে এটি একটি হাই ভোল্টেজ লোকসভা কেন্দ্র।
২০২৪ সালে সন্দেশখালি বিধানসভা কেন্দ্রে শেখ শাহজাহানের আবির্ভাব পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এক যুগান্তকারী অধ্যায় সূচনা করে। যা দেখে শুধু বাংলা নয় সারা ভারতবর্ষ লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়। পড়তে পড়তে শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের ঘনিষ্ঠ নেতাদের নাম জড়িয়ে পড়ে।উঠে আসে নারীদের প্রতি সেই নির্মম অত্যাচারের কথা। উঠে এসেছে পিঠা খাওয়ার গল্প যা প্রতিটা নারী শক্তিকে অপমান করা হয়েছে শুধু তাই না অপমানিত হতে হয়েছে। চারিদিকে নারী শক্তি সম্মিলিতভাবে রাস্তায় নেবে প্রতিবাদে গণ আন্দোলন গড়ে তুলেছে।
এই গণ আন্দোলনের এক প্রতিবাদী মহিলা যার নাম রেখা পাত্র। যিনি প্রতিবাদী মুখ হিসাবে এই বসিরহাট লোকসভায় বিজেপির প্রার্থী। তাঁরই এফআইআর করার পরিপ্রেক্ষিতে শেখ শাহজাহান ও তার পরিবার, শিবু হাজরা এবং অন্যান্যদের বিরুদ্ধে অনেক টাল বাহানার পর পুলিশ গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের আগে পর্যন্ত দিনের পর দিন পুলিশ দ্বারা চাপ আসতে থাকে রেখা পাত্রের ওপর এফ আই আর তুলে নেওয়ার জন্য।
প্রতিবাদের ঝড়ের শক্তি এতটাই ছিল যে চাপে পড়ে শাসক তৃণমূল কংগ্রেসকে অভিযুক্তদের মাথার ওপর থেকে হাত সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। সন্দেশখানি এই গণ অভ্যুত্থান মোর ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য একের পর এক ভিডিও ভাইরাল হতে থাকে। উঠতে থাকে বিভিন্ন মহল থেকে বিভিন্ন প্রশ্ন। স্থানীয়দের মতে শুধু মাত্র মা-বোনেদের ইজ্জত নিয়েই নয়, এখানকার প্রতিটি মানুষের জমি জায়গা জোর করে সমস্ত হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। আর শুধুমাত্র শাসক শ্রেণীর হাত তাদের মাথায় থাকার জন্য আইনের রক্ষকরা এত বছর ধরে অভিযোগের পর অভিযোগপত্র নিয়ে গেলে অভিযুক্তদের কাছেই তাঁদেরকে ফিরিয়ে দিতেম। চলত তাদের ওপর অভিযুক্তদের নির্মম অত্যাচার।
শাসকের তরফ থেকে অভিযোগ করা হয় সন্দেশখালি হচ্ছে ভারতীয় জনতা পার্টির তৈরি করা বড় ষড়যন্ত্র আর সেই ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে শেখ শাহাজান ও তার দলবল।
বিরোধী দলনেতা মাননীয় শুভেন্দু অধিকারী এবং অন্যান্য বিরোধীরা সবাই তীব্র প্রতিবাদ করে শাসকের বিরুদ্ধেই অভিযোগ এনেছেন যে, তাহলে কি কারণে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী জনসভা থেকে বলতে পারেন জমি অবৈধ হস্তান্তর নিয়ে আশা অভিযোগের ভিত্তিতে সেই সমস্যা মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে।
উঠছে প্রশ্ন, তাহলে কি শুধুমাত্র ভোট রাজনীতির জন্যই এই সন্দেশখালিকাণ্ড শাসক নেতাদের যোগসূত্র গলার কাঁটা হওয়ায় দেখেও না দেখার ভান? সবকিছু জানার পরও তারা সত্যি টাকে কিভাবে অস্বীকার করছে? তাহলে কি পিঠা বানানো বা খাওয়া হয়নি? কোন জাদুদন্ডের বলে শেখ শাহজাহান ক’য়েক শো কোটি টাকার মালিক হলেন? কীভাবে কেন্দ্রীয় এজেন্সির আনা শাহজাহানের বিরুদ্ধে অভিযোগ মাছ ব্যবসার নামে বিদেশ থেকে অবৈধ আর্থিক লেনদেন?
সন্দেশখালিকাণ্ড শাসকের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে। আজ প্রতিটা মানুষের মুখে সন্দেশখালিকাণ্ড নিয়ে নিন্দার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। পরিস্থিতি এতটাই গভীর হয়েছে যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রতিটি জনসভা থেকে সন্দেশখালিকাণ্ড নিয়ে সোচ্চার হয়ে তীব্র ভাষায় রাজ্যের শাসককে আক্রমণ করছেন।
শাসকের বিরুদ্ধে কোন কথা বললেই পুলিশ দিয়ে তুলে নিয়ে এসে কেসের পর কেস দেওয়া হচ্ছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। বর্তমানে সন্দেশখালিকাণ্ড একটি জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।
একদা বসিরহাট ছিল বামফ্রন্টের গড়। ২০০৯ সালে বসিরহাটে পালা বদল ঘটে, ক্ষমতা যায় ঘাসফুলের হাতে। সেই বছর হাজী নুরুল ইসলাম জয়ী হন। ২০১৯ সালে বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্র থেকে নুসরাত জাহান ঘাস ফুলের প্রার্থী হন। এবং এই কেন্দ্র থেকে ৫৪.৫৬ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। বিজেপি প্রার্থী সায়ন্তন বসু ৩০.১২ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে।
২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হবার পর নুসরাত জাহান কে নিয়ে বহু বিতর্ক তৈরি হয়। তার ব্যক্তিগত জীবন থেকে রাজনৈতিক জীবন নিয়ে ওঠে প্রশ্ন। দিন দিন ঘাস ফুলের অস্বস্তি বাড়তে থাকার ফলে অবশেষে ২০২৪ বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রে প্রার্থীবদল করে হাজী নুরুল ইসলামকে করা হয়।
গত ১ লা জুন ২০২৪ সপ্তম দফা বসিরহাট লোকসভা নির্বাচনে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ হল, এই কেন্দ্রে যথেষ্ট হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। এবং এই লড়াইয়ে আইএসএফ প্রার্থী নির্ণায়ক ভূমিকা গ্রহণ করবে ফলে বিজেপি প্রার্থী প্রতিবাদী রেখা পাত্র জয়ের সম্ভাবনা ৭০ শতাংশ।
ছবি : আন্তর্জালিক
আরও খবর : Loksabha Election 2024 : পশ্চিমবঙ্গের ভোট রাজনীতির কড়চা ১২
