



ফিচার
মানুষের জীবনে চারটি স্তর আছে-শৈশব, কৈশোর, যৌবন ও বার্ধক্য। তার মধ্যে শৈশব ও কৈশোর খুব মূল্যবান। বাড়ির ভিতের মতো মানুষের জীবনের ভিত হল শৈশব ও কৈশোর। এই সময় সঠিক শিক্ষা ও উন্নত জীবনাদর্শ মানুষকে উন্নত মানুষে পরিণত করে। লিখেছেন : অভিজিৎ দত্ত
প্রকৃত জীবন : উন্নত জীবনচর্চা
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ। তাই তার জীবনচর্চায় শ্রেষ্ঠত্বের নিদর্শন থাকা দরকার। আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রে বলা হয়েছে, ‘আত্মনং বিধি’ অর্থাৎ নিজেকে জানো। আবার স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, প্রত্যেকের মধ্যেই রয়েছে অনন্ত সম্ভাবনা। এসবই ঠিক। আসল ঠিক হল, নিজেকে তৈরি করা বা প্রকৃত মানুষ হওয়া। নিজেকে তৈরি করা বা সঠিক মানুষ হওয়া মুখের কথা নয়! সেই জন্য আমাদের একজন বিখ্যাত মনীষী মন্তব্য করেছেন, ‘মুরগির বাচ্চাকে মুরগি হতে অত কষ্ট করতে হয় না, কিন্ত মানুষের বাচ্চাকে মানুষ করতে গেলে অনেক কষ্ট করতে হয়।’ যে কোনও স্বপ্নকে সফল করতে গেলে যেমন প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়, সেইরূপ প্রকৃত মানুষ হতে গেলে অনেক সংযত ও নিয়মমাফিক জীবনচর্চা করতে হয়।
আজ মানুষে-মানুষে এত ভেদাভেদ, হিংসা,খুনোখুনী, পরশ্রীকাতরতা, ব্যাভিচার মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে। আজ মানুষের প্রধান শত্রু মানুষ। আজ মানুষ, মানুষকে বিশ্বাস করতে পারছে না। কেন মানুষের এত অধঃপতন দশা? এর উত্তর নিহিত রয়েছে মানুষের জীবনচর্চার মধ্যেই। উন্নত জীবনচর্চার মধ্যে যে বেড়ে উঠেছে, তার সঙ্গে একজন অনুন্নত জীবনচর্চার মধ্যে বেড়ে ওঠা মানুষের মূল্যবোধ বা জীবনদর্শন কখনও-ই এক হবে না বা মিলবে না।এইজন্যই শাস্ত্রে বলেছে, ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস/অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।’
‘জন্মিলে মরিতে হবে/ অমর কে কোথা কবে’… উপরের বাক্যগুলি ধ্রুব সত্য। কিন্তু ক’জনই তা মনে রাখে! মানুষের জীবনে চারটি স্তর আছে-শৈশব, কৈশোর, যৌবন ও বার্ধক্য। তার মধ্যে শৈশব ও কৈশোর খুব মূল্যবান। বাড়ির ভিতের মতো মানুষের জীবনের ভিত হল শৈশব ও কৈশোর। এই সময় সঠিক শিক্ষা ও উন্নত জীবনাদর্শ মানুষকে উন্নত মানুষে পরিণত করে। অনেকেই বলবেন, সঠিক জীবনদর্শন কী? এক কথায় এর উওর দেয়া মুশকিল। মোটামুটি বলা যায়, সত্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে পথ চলা, সকলের ভাল চিন্তা করা। নেতিবাচক চিন্তা বা কুচিন্তাকে প্রশ্রয় না দেয়া এবং পরমশক্তির প্রতি আস্থা। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘চারটি যোগের মাধ্যমেই মানুষের মুক্তি সম্ভব। এই চারটি যোগ হল কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, রাজযোগ, ও ভক্তিযোগ।’ এছাড়া বিবেকানন্দ একটি সুন্দর কথা বলেছেন, ‘মানুষের মন কোন ডাষ্টবিন নয়, যে ক্রোধ, হিংসা, কুচিন্তা প্রভৃতির ন্যায় বাজে জিনিস দিয়ে ভরিয়ে তুলতে হবে।’
আমাদের ভারতবর্ষ এক সুপ্রাচীন ও মহান দেশ। অনেকেই বলেন, আধ্যাত্মিকতার পীঠস্হান। অনেক মহাপুরুষ ও এদেশে জন্মগ্রহণ করেছেন। অনেক ভাল, ভাল উপদেশ তাঁরা দিয়ে গিয়েছেন। যেমন বুদ্ধদেবের আর্যসত্য ও অষ্টাঙ্গিক মার্গ, মহাবীরের পঞ্চ মহাব্রত, গুরু নানকের উপদেশ প্রভৃতি। আবার হজরত মহম্মদ বা যীশু খ্রীষ্টও অনেক মূল্যবান উপদেশ পৃথিবীবাসীকে দিয়েছেন। আমরা কী তা অনুসরণ করি? আজ যদি আমরা মহাপুরুষদের জীবন ও বাণী সম্পর্কে সঠিকভাবে উপলদ্ধি করতে পারতাম, তাহলে পৃথিবীটা একটা স্বর্গের দেশ হত। সেইজন্য কবি বলেছেন, ‘কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক/কে বলে তা বহুদূর/মানুষের মাঝেই স্বর্গ নরক/মানুষেতেই সুরাসুর।’
মানুষ এখন প্রচণ্ড ব্যস্ত। কিন্ত একটা কথা সকলকেই মনে রাখতে হবে, মানুষ খালি হাতেই পৃথিবীতে এসেছে আবার খালি হাতেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে। মানুষকে স্মরণীয় করে রাখবে তার ভাল কাজ। এইজন্য শাস্ত্রে বলেছে, ‘জীবনের মূল্য আয়ুতে নয়, কল্যাণময় কর্মে।’ কাজেই নিজেকে ভালভাবে তৈরি করতে না পারলে তার পক্ষে কী ভাল কাজ করা সম্ভব? সকলেরই উচিৎ এই ব্যাপারটি নিয়ে ভাবা। আমাদের দেশ যখন পরাধীন ছিল তখন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল দেশকে স্বাধীন করা। ইংরেজদের এদেশ থেকে বিতাড়ন করা। কিন্ত শুধু স্বাধীনতা অর্জনই স্বাধীনতাসংগ্রামীদের লক্ষ্য ছিল না। এরসঙ্গে তাঁরা একটি উন্নত ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখেছিলেন। এই উন্নত ভারতবর্ষ কাদের নিয়ে গড়ে উঠবে? আমি, আপনি সহ আপামর দেশবাসীকে নিয়েই তো। সুতরাং দেশের ভাল-মন্দ নির্ভর করবে দেশবাসী কেমন শিক্ষা বা জীবনাদর্শ নিয়ে বড় হচ্ছে তার উপরে ভিত্তি করেই। আজ দুঃখের সঙ্গেই বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক সুবিধাবাদ সবকিছুকেই শেষ করে দিচ্ছে।এর থেকে উদ্ধার পেতে গেলে একটিই উপায় নিজেকে শিক্ষিত করা ও উন্নত জীবনাদর্শ মেনে চলা। এবং মহাপুরুষ ও স্বাধীনতাসংগ্রামীদের আর্দশে অনুপ্রাণিত হওয়া ও তাঁদের মেনে চলা। নাহলে উন্নত জীবন ও উন্নত দেশ তথা বিশ্বের আশা সুদূরপরাহত। এইজন্য শ্রীরামকৃষ্ণদেব জগতের শ্রেষ্ঠ কথাটি বলে গেছেন, ‘তোমাদের চৈতন্য হোক।’ আর সাধক রামপ্রসাদ আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘এমন মানব জমিন রইল পতিত/আবাদ করলে ফলতো সোনা।পরিশেষে কবির উক্তি দিয়েই শেষ করি।সেই ধন্য নরকুলে/লোকে যারে নাহি ভুলে/মনের মন্দিরে সেবে/সদা সর্বজন।’
ছবি : সংগৃহীত
