Sasraya News

Thursday, February 13, 2025

Kayes Ahmed : নিয়ামত আলীর জাগরণ’ অদৃষ্টের পরিহাস কিংবা সুতীব্র ঘৃণার গল্প

Listen

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিশালী কথাসাহিত্যিক কায়েস আহমেদ (১৯৪৮-১৯৯২)। তাঁর লেখা যেমন বিগত প্রজন্মের পাঠদের আমোদিত করেছে, তেমনি নব্য প্রজন্মের সাহিত্যের পাঠকদের ভিন্নস্বাদের জোগান দিয়ে চলেছেন। তাঁর গল্প সম্পর্কে কলম ধরলেন এই সময়ের সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক নুসরাত সুলতানা

 

 

 

‘নিয়ামত আলীর জাগরণ’ অদৃষ্টের পরিহাস কিংবা সুতীব্র ঘৃণার গল্প

 

প্রারম্ভিক কথা: বাংলা কথাসাহিত্যের ধারায় কায়েস আহমেদ (১৯৪৮-১৯৯২) এক বিরলপ্রজ প্রতিভা। ষাটের দশকের তরুণ গল্পকারদের মধ্যে যে নিরীক্ষাপ্রবণ প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার প্রকাশ ঘটেছিল কায়েস আহমেদ ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ। [১] দেশ, কাল, জাতি সমাজ ও মানুষের সম্পর্কে তাঁর পর্যবেক্ষণ শক্তি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। কায়েস আহমেদ ছিলেন প্রবলভাবে সত্য সন্ধানী এবং সৎ কথাসাহিত্যিক। গল্পের চরিত্রায়ন এবং আখ্যান বিনির্মাণে তিনি একেবারেই ভণিতা বা ছলাকলাকে প্রশ্রয় দেননি। ছোটগল্পের প্রচলিত ও ধরাবাঁধা ছকে বা অন্য দশজন যে পথে হেঁটেছেন সে পথ তিনি আদৌ মাড়িয়ে যাননি। প্রকরণ ভেঙে তিনি বেরিয়ে পড়েছেন নতুন ও অচেনা দিগন্তের দিকে। তাঁর গল্পে একই বৃত্তে ঘুরপাক খাওয়া মানুষগুলোর মধ্যে কেউ কেউ নষ্টালজিয়ায় আক্রান্ত, কেউ বা জীবন যুদ্ধে ক্লান্ত, কেউ বা ক্ষণিক সুখে বিভোর। নির্বিকার, নিষ্ঠুর, ক্ষয়িষ্ণু সমাজ ব্যবস্থায় জীবন যাপনের মানুষগুলো দরজা ভেঙে বেরিয়ে এসে ঠাঁই নিয়েছে কায়েসের ছোটগল্পের বুকের গহীন বন্দরে। আর এ কারণেই তাঁর গল্পের চরিত্ররা কৃত্রিম সভ্যতার বিবরে গড়ে ওঠেনি। হয়ে উঠেছে রক্তেমাংশে গড়া জীবন্ত চরিত্র। ‘নিয়ামত আলীর জাগরণ’ গল্পের নিয়ামত ও তেমনি রক্ত-মাংসে গড়া এক ব্রাত্যজন।

আখ্যান ভাগ: নিয়ামত আলীর জাগরণ’ গল্পে অদৃষ্টের নির্মম রসিকতার শিকার আধপাগলা নিয়ামত। তার জীবন কাহিনী রূপায়ণের মাধ্যমে কায়েস আহমেদ অত্যন্ত দক্ষতার এবং মমতার সঙ্গে একটি উপেক্ষিত জীবনের বেদনাদায়ক অধ্যায় চিত্রায়ণ করেছেন। নিজেকে ব্রিটিশ আমলের একজন প্রাক্তন সোলজার-বার্মা ফ্রন্টের জাপানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধকারী হিসেবে পরিচয় দিতে আনন্দ অনুভব করে এবং একই সঙ্গে গর্বও বোধ করে। সে নকশাল কর্তৃক ধনীদের সম্পদ লুণ্ঠনের কথা বলতে বলতে পরিমলের কাছে একটা বিড়ি চায়। পরিমল বিড়ি না দেওয়ায় সে ক্ষুব্ধ হয়। তিনু মণ্ডল নিয়ামত আলীকে ট্যাক থেকে বিড়ি বের করে করে দিয়ে সঙ্গে নিয়ে বের হয়। তিনু ভাবে- নিয়ামতকে বাড়ি পৌঁছে দেবে। তিনুর সাপটে ধরা হাত থেকে নিয়ামত বেরিয়ে গিয়ে ক্রমাগত বলতে থাকে- ‘আগুন জ্বেলিয়ে দেবো। বোমা মেরে উড়িয়ে দেবো শালাদের’…
আপন মনে বকতে বকতে সে মল্লিকদের বাগানবাড়ির পুকুরঘাটে শানের উপর শুয়ে স্বপ্নের আবেশে ‘নির্ঝঞ্ঝাট বার্মা ফ্রন্টে চলে যায়’। স্বপ্নে দেখে কত কী! কোথা যেন অচেনা একটা পাখি ডাকছে। টগবগ করে মাংস ফুটছে বড় ডেকচিতে। সেই মাংসের সুগন্ধের ভেতরে চুলার আগুনের দিকে তাকিয়ে আছে নিয়ামত।
হঠাৎ করে ডেকচির মুখ খুলে গিয়ে একটা নধর খাসি নিয়ামতের পাশ দিয়ে ছুটে বেরিয়ে যায়। আর নিয়ামত ভয় পেয়ে গিয়ে ভাবে- লোকজনকে সে খেতে দেবে কী! এমন সময় পুলিশ এসে তাকে নকশাল সন্দেহে আটক করে। তখন সে বলে ওঠে, ‘আমি নকশাল নই, স্যার আমি নিয়ামত।’ কিন্তু পুলিশ শোনে না তার কথা। পুলিশ নিজেদের ভেতর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে বলে ওঠে- হারামজাদা পাক্কা বদমাইশ! দুর্বল শরীরে নিয়ামতের পা এগোয় না তবুও লুঙ্গি, গেঞ্জি পরা হাত দু’টি মুষ্টিবদ্ধ হয়। গ্রীবায়, দুই চোয়ালে এবং চোখে তীব্র ক্ষোভে ভরা দৃঢ়তা এসে যায়।প্রচণ্ড ঘৃণায় নিয়ামত ওসির মুখের দিকে তাকিয়ে বমি করে দেয়।[৩]

 

 

 

 

গল্পের অভিঘাত এবং গদ্যের শিল্পরূপ : নিয়ামত আলী ভিটামাটি ছাড়া নিঃস্ব, ছন্নছাড়া একজন ব্রাত্যজন। সে থাকে ইয়ার কসাইয়ের কারখানার পাশে ছোট্ট একটা চালাঘরের পাশে। ইয়ার আলীর পোষা গরু-ছাগল দেখাশোনা করে আর বজরা মাথায় নিয়ে গরুর গোসত বিক্রি করে। সেই নিঃস্ব নিয়ামত আলীই নিজেকে পরিচয় দেয় বার্মাফ্রন্টের বিপ্লবী যোদ্ধা হিসেবে। আসলে নিজেকে সবার সামনে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ করতেই নিজেকে বার্মাফ্রন্টের যোদ্ধা বলে আর পিঠের কার্বাঙ্কলকে বলে গুলির দাগ। গল্পের ন্যারেশনে আমরা দেখি, পরিমল বিড়ি না দিলে নিয়ামত বলে- হামকো তুম পাচেনতা, হাম বার্মাফ্রন্ট মে লড়াই কিয়া হ্যায়। আর তুই শালা মুদির ব্যাটা মুদি। আর এসব দেখে গল্পে উল্লেখিত জনপদের সকলেই হাসে এবং নিয়ামতকে পরিহাস করে। এটি যেমন গল্পের একটি শক্তিশালী দিক। তেমনি অন্যদিকে দেখতে পাই। যে নিয়মতকে দেখে ছোট ছোট ছেলে ছোকরারা লে-লে, হৈ-হৈ করে শিস বাজায় পুলিশ তাকেই পাকড়াও করে। নেশায় চুড় হয়ে বমি করতে করতে যখন নিয়ামত মল্লিকদের বাড়ির বাগানের ভেতর সান বাঁধানো পুকুর ঘাটে মাথায় পানি দিয়ে একটা গভীর নিদ্রায় ডুবে গিয়ে স্বপ্নে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। পুলিশ তার দিকে রাইফেল তাক করে নিয়াত জেগে উঠে বলে- স্যার আমি নক্সাল নই, আমি..। তখন পুলিশ বলে শাটাপ ইউ ব্লাডি নক্সালাইট। নিয়ামত তীব্র ঘৃণায় পুলিশের মুখের দিকে তাকিয়ে বমি করে দেয়। এভাবেই কায়েস আহমেদ রাষ্ট্রের পুলিশি ব্যবস্থাকে তীব্র কটাক্ষ হেনেছেন এই গল্পে।

এবার আসি গল্পের শিল্পরূপ প্রসঙ্গে। কায়েস আহমেদ-এর গল্প ও গদ্য তাঁর আখ্যান ভাগের মতোই শক্তিশালী। চৈত্রের তীব্র তাপদহন যেমন শরীরকে উত্তপ্ত করে তোলে তেমনি কায়েস আহমেদ-এর গদ্য অনিবার্যভাবেই মনযোগী পাঠকের মননকে আচ্ছাদিত করে। যা থেকে পাঠকের মুক্তি নেই। এর সঙ্গে তিনি সন্নিবেশ করেছেন দারুণ সব উপমা এবং উৎপ্রেক্ষা। যেমন গল্পের ন্যারেশনে আমরা দেখি – নিয়ামত বলতে বলতে তেল চিটচিটে ছেঁড়া ডোলি -ডোলি হয়ে যাওয়া গামছার মতো করে ফেলেছে।

শেষ কথা: কায়েস আহমেদ পাঠককে গল্পের এক গভীর কুহকময় জগতে নিয়ে যান। যেখানে পাঠক গল্পের গাছে আরোহন করে কিন্তু নেমে আসার মইটা আর খুঁজে পান না। [২] পাঠকের মননে সৃষ্টি হয় তীব্র অস্বস্তি এবং বেদনাবোধ যা থেকে কোনোভাবেই মুক্তি মেলে না। ‘নিয়ামত আলী জাগরণ’ গল্পটিও আখ্যান, চরিত্রায়ন, গদ্য সবকিছুর সন্নিবেশনে বাংলা সাহিত্যের একটা স্থায়ী সম্পদ। নিয়ামত আলীর সঙ্গে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বহু মনযোগী পাঠক মননের গভীর সংযোগ স্থাপিত হবে এমনই প্রত্যাশা।🍁

তথসূত্র:

১.কায়েস আহমেদের গল্পের বিষয় ও আঙ্গিক- আশরাফ উদ্দীন আহমেদ। কালি ও কলম।
২. এক ছটাক কায়েস আহমেদ – অদ্রোহ। সচলায়তন
৩. গল্প- নিয়ামত আলীর জাগরণ – গল্পগ্রন্থ – লাশকাটা ঘর: কায়েস আহমেদ

আরও পড়ুন : Sasraya News | Sunday’s Literature Special | 29th December 2024 | Issue 45 || সাশ্রয় নিউজ | রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল | ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪ | সংখ্যা ৪৫

Sasraya News
Author: Sasraya News

Leave a Comment