Sasraya News

Kailash Satyarthi : কৈলাস সত্যার্থী: ‘শিশুরা যেন শুধু স্বপ্ন দেখে না, সেই স্বপ্ন ছুঁয়ে ফেলতে পারে’

Listen

সূর্য মিত্র ★ সাশ্রয় নিউজ : একটি ক্ষীণ অথচ দৃঢ় কণ্ঠস্বর কানে এল — “আমি চাই, এই পৃথিবীর কোনও শিশুকে আর কখনও কোনও কারখানায় নয়, বরং স্কুলে যেতে দেখা যাক।” বলেন কৈলাস সত্যার্থী। বয়স সত্তর পেরোলেও কণ্ঠে আজও আগুনের তেজ। তাঁর চোখে আজও হাজারও শিশু শ্রমিকের অসহায় মুখ, যাদের তিনি উদ্ধার করেছেন শোষণের অন্ধকার গহ্বর থেকে।

কৈলাস সত্যার্থীর জন্ম ১৯৫৪ সালে মধ্যপ্রদেশের বিদিশায়। তখন তাঁর নাম ছিল কৈলাস শর্মা। উচ্চবিত্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে বড় হওয়া এই কিশোর স্কুলে যাওয়ার পথে একবার দেখেন, একটি সমবয়সী শিশু পায়ে চটিজুতো না পরেই কাঁধে ভার বহন করছে।
“আমার মনে প্রশ্ন জাগে— কেন আমি স্কুলে যাচ্ছি আর ও যাচ্ছে কাজে?”— কৈলাস বলেন পুরনো দিনের কথা মনে করে। একজন প্রকৌশলী হিসেবে সফল কেরিয়ার গড়ার সুযোগ ছিল তাঁর সামনে। কিন্তু সুবিধাভোগী জীবন তাঁকে টানেনি। বরং টেনেছে রাস্তায় দেখা সেই শিশু, যার নামে কোনও নথি নেই, অধিকার নেই, ভবিষ্যৎ নেই।

কৈলাশ সত্যার্থী। ছবি : সংগৃহীত

 

“বচপন বাঁচাও আন্দোলন”: শিশুদের মুক্তির স্লোগান

১৯৮০ সালে কৈলাস সত্যার্থী প্রতিষ্ঠা করেন বচপন বাঁচাও আন্দোলন। এটি কোনও NGO-র প্রকল্প নয়, বরং ছিল এক কঠোর মাটি-ঘেঁষা লড়াই। তাঁদের লক্ষ্য— জোরপূর্বক শ্রমে নিযুক্ত শিশুদের উদ্ধার করা, পুনর্বাসন দেওয়া এবং তাঁদের শিক্ষা নিশ্চিত করা।
তাঁর নেতৃত্বে এ পর্যন্ত ১ লক্ষেরও বেশি শিশুকে বিভিন্ন চরম শোষণের পরিবেশ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে কার্পেট কারখানা, ইটভাটা, গৃহশ্রমিক, এমনকি যৌন পাচারের শিকারগ্রস্ত শিশুরাও রয়েছে। “বচপন বাঁচাও” আন্দোলনের এক উদ্ধার অভিযানে অংশ নেওয়া কর্মী অর্জুন দাস জানান,
“একবার তাঁতের কারখানা থেকে ২৫ জন শিশুকে বের করছিলাম। মালিকরা দা নিয়ে তেড়ে আসে। সত্যার্থীজি সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘তোমরা যা করো, কিন্তু আমি এদের নিয়ে যাবই।” হুমকি, হামলা, প্রতিরোধ — পিছু হঠেননি
এই লড়াই ছিল প্রাণঘাতীও। বহুবার তাঁর উপর হামলা হয়েছে। একাধিকবার সহকর্মীরা আহত হয়েছেন, এমনকি ২০১১ সালে এক কর্মী প্রাণ হারিয়েছেন।
তবুও সত্যার্থীকে কখনও থেমে যেতে দেখা যায়নি।
“ভয়? আমি শিশুদের চোখে যন্ত্রণার যে ভয় দেখি, তার কাছে আমার জীবনের ঝুঁকি তুচ্ছ,”— কৈলাস সত্যার্থী বলেছিলেন এক সাক্ষাৎকারে।

কৈলাশ সত্যার্থী। ছবি : সংগৃহীত

 

নোবেল শান্তি পুরস্কার : লড়াইয়ের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

২০১৪ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান কৈলাস সত্যার্থী, পাকিস্তানের মালালা ইউসুফজাইয়ের সঙ্গে যৌথভাবে।
নোবেল কমিটি বলেছিল, “শিশুদের শোষণ বন্ধে তাঁদের অবদান বিশ্বজুড়ে মানবতাবাদের নতুন সংজ্ঞা তৈরি করেছে।” এই পুরস্কার শুধু একজন ব্যক্তিকে নয়, বিশ্বের লাখো নিপীড়িত শিশুর কণ্ঠস্বরকে সম্মানিত করেছিল। বিশ্ব তাঁর কাজের প্রশংসা করতে ভোলেনি। উল্লেখ্য যে, শুধু ভারতেই নয়, কৈলাস সত্যার্থী গড়ে তুলেছেন এক বৈশ্বিক আন্দোলন — Global March Against Child Labour। বিশ্বের ১৪০টি দেশে ছড়িয়ে থাকা এই জোটের মাধ্যমে শিশুশ্রমবিরোধী আন্তর্জাতিক আইন তৈরিতে সরাসরি ভূমিকা রেখেছেন তিনি।
বিশ্ব শ্রম সংস্থা (ILO)-এর কনভেনশন ১৮২ গৃহীত হয় তাঁর এই আন্দোলনের ফলেই।

শিশু-কিশোরদের সঙ্গে কৈলাশ সত্যার্থী। ছবি : সংগৃহীত

কৈলাস সত্যার্থীর পাশে ছিলেন তাঁর স্ত্রী সুমেধা সত্যার্থী— নিঃশব্দ এক সমাজসেবিকা, যিনি পুনর্বাসিত শিশুদের মানসিক পুনর্গঠনে কাজ করেছেন নিরলসভাবে। তাঁদের পরিবারে কোনও বিলাসিতা নেই, নেই কোনও প্রশাসনিক সুবিধার খুঁটি। শুধু রয়েছে মানুষের জন্য দায়বদ্ধতা।

শিশু-কিশোরদের সঙ্গে কৈলাশ সত্যার্থী। ছবি : সংগৃহীত

কৈলাস সত্যার্থী ও সুমেধা সত্যার্থীর ছেলে ভরত সত্যার্থী বলেন, “আমার বাবা কখনও আমাদের বলেননি রাজনীতি করো, বরং বলেন— আগে দেখো, মানুষ কোথায় কাঁদছে।” কৈলাস সত্যার্থী এখন ‘Childhood Freedom for All’ লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছেন। তাঁর দাবি, “২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে শিশুশ্রমের সম্পূর্ণ অবসান সম্ভব, যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও নাগরিক দায়বদ্ধতা থাকে।” তিনি আজও দেশের প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে শিশুদের সঙ্গে কথা বলেন, স্কুলে সময় দেন, আর অভিভাবকদের বোঝান— “শিশুরা শুধু ভবিষ্যৎ নয়, তারাও বর্তমান। তাদের খেলার, শেখার, বাঁচার অধিকার এখনই।”

মনে রাখতে হবে, কৈলাস সত্যার্থীর জীবন এক অনবরত প্রতিবাদ— নিঃশব্দ শিশুদের হয়ে, যাদের কণ্ঠ শোনা যায় না। তিনি একা, কিন্তু ভয়হীন। তাঁর বিশ্বাস, এই লড়াই চালিয়ে যেতে হলে কেবল আইন নয়, লাগবে সচেতন নাগরিকদের শক্তি।

তাঁর প্রশ্ন, “আপনি কি জানেন, আপনার শহরে ঠিক এই মুহূর্তে কত শিশু কাজ করছে? আপনি কী করেছেন তাদের জন্য?” প্রশ্নটি আজও বাজে কানে। আর কৈলাস সত্যার্থী নীরবে হেঁটে চলেছেন— শিশুদের সেই মুক্তভবিষ্যতের দিকে, যেখানে কোনো চোখ থাকবে না অবরুদ্ধ, কোনও কণ্ঠ থাকবে না স্তব্ধ।

সব ছবি: সংগৃহীত
আরও পড়ুন : Sasraya News, Sunday’s Literature Special | 25th May 2025, Issue 66 || সাশ্রয় নিউজ রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল | ২৫ মে ২০২৫, সংখ্যা ৬৬

Sasraya News
Author: Sasraya News

Leave a Comment

Also Read