



পূর্বা মুখোপাধ্যায় ★ সাশ্রয় নিউজ : জিলিপি (Jalebi)। বাঙালির কাছে এমন এক মিষ্টি, যার প্যাঁচে পড়তে কারও আপত্তি নেই। সকাল হোক বা সন্ধে, উৎসব হোক বা অবসাদ, জিলিপি অনায়াসে জায়গা করে নেয় প্রতিটি মুহূর্তে। তবে রথযাত্রা এলেই এই মিষ্টির কদর যেন আরও ক’য়েক গুণ বেড়ে যায়। রথের মেলার সঙ্গে জিলিপির যোগ শুধুই ভোগ কিংবা খাওয়াদাওয়া নয়, তার আড়ালে রয়েছে বৈদিক সূত্র ও সাংস্কৃতিক ব্যাখ্যা। উল্লেখ্য, অষ্টাদশ শতকে ওড়িশা থেকে বাংলায় রথযাত্রার প্রচলন বাড়ে। আর সেই রথযাত্রা উপলক্ষ্যে রাস্তার ধারে, মন্দিরের গেটে বা মেলায় জিলিপির দোকান না থাকলে যেন উৎসবই পূর্ণ হয় না। Nadia জেলার কৃষ্ণনগর (Krishnanagar) থেকে পুরুলিয়া (Purulia), বাঁকুড়া (Bankura) থেকে পশ্চিম মেদিনীপুর (Paschim Medinipur) প্রতিটি জায়গায় রথযাত্রা মানেই সকালবেলা গরম জিলিপির খোঁজ।
পড়ুন : Mutton recipe | রসুনেই বাজিমাত, পেঁয়াজ ছাড়াই জমজমাট ‘রসুনে রসালা’ খাসির মাংস
ঐতিহাসিক ও সংস্কৃতি গবেষক তপন সেনগুপ্ত (Tapan Sengupta) বলছেন, “জিলিপির পাকদণ্ডী শুধু স্বাদের জন্য নয়। এর ঘূর্ণায়মান আকারও গুরুত্বপূর্ণ। বৈদিক ব্যাখ্যায় এই পাককে জীবনের চক্রের সঙ্গে তুলনা করা হয়। রথযাত্রা, যা জীবনের চলমানতার প্রতীক, তার সঙ্গেই মিল রয়েছে জিলিপির এই পাকের।” তাঁর মতে, মিষ্টি খাবারের মধ্য দিয়ে আনন্দ ও শক্তির প্রকাশ হয়। আর জিলিপির মিষ্টত্ব ও ঘূর্ণি-আকৃতি দুই-ই রথযাত্রার দর্শনে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অনুদিকে, বঙ্গের বিভিন্ন রথমেলায় সকাল থেকে রাত পর্যন্ত লম্বা লাইন দেখা যায় জিলিপির দোকানে। Nadia জেলার নবদ্বীপ (Nabadwip)-এর রথমেলায় জিলিপি বিক্রেতা গোপাল দাস (Gopal Das) জানালেন, “রথের দিনগুলিতে দিনে প্রায় ৭০-৮০ কেজি জিলিপি বিক্রি হয়। সকালবেলা গরম জিলিপি আর ছোলার ডালের সঙ্গে খাওয়ার আলাদা মজা আছে।” ক্রেতারা বলছেন, রথযাত্রা মানেই জিলিপির গন্ধে সকাল শুরু করা, আর সন্ধেয় ফের জিলিপি খেয়ে বাড়ি ফেরা।
পুরাণ মতে, রথযাত্রা হল ভগবান জগন্নাথ (Jagannath)-এর মন্দির থেকে অন্য মন্দিরে গমনের উৎসব। এই যাত্রাপথে ভক্তরা বিভিন্ন প্রসাদ নিবেদন করেন। সেই তালিকায় জিলিপির স্থান বেশ উপরের দিকেই। Nadia জেলার কৃষ্ণনগর (Krishnanagar)-এর এক পুরোহিত অমলেন্দু ভট্টাচার্য (Amalendu Bhattacharya) জানালেন, “জগন্নাথদেবকে যে প্রসাদ নিবেদন করা হয়, তাতে জিলিপি অবশ্যই থাকে। এই মিষ্টিকে শুভ ও শুদ্ধ মনে করা হয়। ফলে রথযাত্রার দিন ভোগে জিলিপি না থাকলে পূজা সম্পূর্ণ হয় না।” আবার, এই জিলিপি প্রীতি শুধু বাংলায় নয়, ওড়িশা ও উত্তর ভারতের বিভিন্ন রাজ্যেও সমানভাবে প্রচলিত। তবে বাংলার রথযাত্রা মেলায় জিলিপির ঘ্রাণ যেন আলাদা। বিশেষ করে কৃষ্ণনগর (Krishnanagar), শান্তিপুর (Shantipur), নন্দীঘাট (Nandighat)-এর মেলায় জিলিপি বিক্রি মানেই উপচে পড়া ভিড়। অনেকে সকালেই জিলিপি কিনে রাখেন, কারণ বেলা বাড়লে দোকানে জায়গা পাওয়া কঠিন হয়। Nadia জেলার শান্তিপুর (Shantipur)-এর বাসিন্দা সুতপা চক্রবর্তী (Sutapa Chakraborty) বললেন, “রথযাত্রার সকালে গরম জিলিপি না খেলে উৎসবই জমে না। বছরের অন্য দিনেও খাই, কিন্তু রথের জিলিপির স্বাদই আলাদা।” জিলিপি তৈরির পদ্ধতিতেও লুকিয়ে আছে তার বিশেষত্ব। ময়দা, দই, বেকিং পাউডার মিশিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রেখে তারপর তেলে ভাজা হয়। শেষে চিনি-জলে ডুবিয়ে তোলা। Nadia জেলার কৃষ্ণনগর (Krishnanagar)-এর মিষ্টির কারিগর নিখিল নস্কর (Nikhil Naskar) জানালেন, “রথের সময়ে রাত জেগে জিলিপি তৈরি করতে হয়। চাহিদা এত বেশি থাকে যে সকাল ৫টার আগে সব তৈরি না করলে বেলা গড়াতেই বিক্রি শেষ হয়ে যায়।” আসলে রথযাত্রা মানেই শুধুমাত্র ভক্তি নয়, তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে উৎসব, খাওয়া-দাওয়া, আনন্দ আর স্মৃতি। আর সেই স্মৃতিকে মিষ্টিমাখা করে রাখে এই পাক ঘোরানো জিলিপি। তাই বলা চলে, রথের চাকা ঘুরলেও জিলিপির পাক কিন্তু তার চেয়ে কম নয়, বরং বাঙালির মনে পাক ঘুরিয়ে যায় বছরের পর বছর।
ছবি: সংগৃহীত
আরও পড়ুন : Patoler Dolma Recipe | নতুন স্বাদে পটলের দোলমা, মাছের ডিমের জাদুতে জমে উঠুক বর্ষার খাওয়া
