



বসুধা চৌধুরী ★ সাশ্রয় নিউজ : বিশ্বজুড়ে ভারতীয়দের প্রতিভা, কঠোর পরিশ্রম ও বহুভাষিক দক্ষতা আজ এক স্বীকৃত বাস্তবতা। দেশে বেকারত্বের হার যখন বাড়ছে, তখন বহু তরুণ-তরুণী চায় নিজেকে প্রমাণ করতে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে (Foreign Job)। ফলে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমেরিকা সহ বিভিন্ন দেশে ভারতীয় যুবসমাজের পদচারণা বাড়ছে। সরকারি ও বেসরকারি তথ্য বলছে, বিশ্বের নির্দিষ্ট কিছু দেশে নিয়মিতভাবেই ভারতীয় চাকরিপ্রার্থীরা কাজ খুঁজে পান। চলুন জেনে নেওয়া যাক এমন নয়টি দেশের কথা, যেখানে সবচেয়ে বেশি ভারতীয় চাকরি পান, কীভাবে পান, আর কোন নিয়ম মেনে সেই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়? জেনে নিই

সংযুক্ত আরব আমিরাত (UAE)
দুবাই ও আবুধাবির মত শহরে ভারতীয়দের সংখ্যা বিশাল। মধ্যপ্রাচ্যের এই ধনী দেশটি ভারতীয় কর্মীদের জন্য অন্যতম বড় গন্তব্য। হসপিটালিটি, নির্মাণ, রিটেল, নিরাপত্তা পরিষেবা, তথ্যপ্রযুক্তি ও অ্যাকাউন্টিং-এর মত ক্ষেত্রে বিপুল কর্মসংস্থান রয়েছে। ভারতের বিভিন্ন রিক্রুটমেন্ট এজেন্সির মাধ্যমে UAE-তে চাকরির অফার আসে। এছাড়া বিদেশ মন্ত্রকের অনুমোদিত “emigrate.gov.in” পোর্টালের মাধ্যমে ECR (Emigration Check Required) পাসপোর্টধারীরা কাজের সুযোগ পেতে পারেন। বৈধ ভিসা, কাজের চুক্তিপত্র, স্পনসর কোম্পানির তথ্য, মেডিক্যাল ক্লিয়ারেন্স সব কিছু জমা দিয়ে তবেই এখানে প্রবেশ সম্ভব। অনেক ক্ষেত্রেই নিয়োগ সংস্থা ও স্পনসর সংস্থা বিমান ভাড়া ও থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়।
সৌদি আরব
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ভারতীয় কর্মী রয়েছে যে দেশে তার মধ্যে অন্যতম সৌদি আরব। মেডিকেল, কনস্ট্রাকশন, আইটি, পেট্রোলিয়াম ইন্ডাস্ট্রিতে কাজের প্রচুর সুযোগ রয়েছে এখানে। সৌদি সরকারের “Musaned” প্ল্যাটফর্ম এবং ভারতের MEA অনুমোদিত রিক্রুটমেন্ট এজেন্সিগুলির মাধ্যমে নিরাপদে নিয়োগ হয়। চাকরি পাওয়ার আগে মেডিক্যাল টেস্ট বাধ্যতামূলক। কাজের চুক্তিপত্রে বেতন, কাজের সময়, অতিরিক্ত সুবিধা, ছুটি ইত্যাদির স্পষ্ট উল্লেখ থাকতে হয়। স্পনসর কোম্পানির সাহায্যে “Iqama” (residency permit) পাওয়া গেলে কাজ শুরু করা যায়।

কাতার
বিশ্বকাপ ২০২২-এর পর কাতারে নির্মাণ ও পরিষেবা ক্ষেত্র ব্যাপক সম্প্রসারিত হয়েছে। ভারতীয়দের এখানে বিপুল চাহিদা রয়েছে। নির্মাণ শ্রমিক, গাড়িচালক, হাউস কিপিং, হসপিটালিটির কাজ ছাড়াও এখন অনেক ভারতীয় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ও অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সেক্টরেও নিয়োজিত হচ্ছেন। কাতারে যাওয়ার জন্য মেডিক্যাল পরীক্ষার পর স্পনসর ভিসা প্রয়োজন হয়। “Qatar Visa Center” (QVC)-র মাধ্যমে নিরাপদে এবং যথাযথভাবে যাবতীয় কাগজপত্র জমা দেওয়া হয়।
কানাডা (Canada)
সম্প্রতি কানাডা ভারতীয়দের জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে উঠেছে। হাই-স্কিলড প্রফেশনাল, বিশেষ করে সফটওয়্যার ডেভেলপার, নার্স, টেকনিশিয়ান, শিক্ষাবিদদের চাহিদা বেশি। কানাডার Express Entry সিস্টেম বা Provincial Nominee Program (PNP)-এর মাধ্যমে আবেদন করা যায়। IELTS স্কোর, শিক্ষাগত যোগ্যতা, কাজের অভিজ্ঞতা, বয়স, ফান্ড প্রুফ ইত্যাদি বিষয়গুলোকে ভিত্তি করে পয়েন্ট দেওয়া হয়। ভিসা পেলে স্পাউস ও সন্তানদেরও সঙ্গে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।
জার্মানি (Germany)
জার্মানিতে ভারতীয় আইটি প্রফেশনাল ও ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য বিপুল সুযোগ রয়েছে। ‘Blue Card’ নামক স্কিমের মাধ্যমে উচ্চ শিক্ষিত বিদেশিদের স্থায়ীভাবে কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয়। জার্মানির বিভিন্ন কোম্পানি সরাসরি ভারতীয় প্রার্থীদের নিয়োগ করে থাকে। কাজের অফার পেলে উপযুক্ত কাজের ভিসা নিয়ে প্রবেশ করা যায়। তবে অনেক ক্ষেত্রেই জার্মান ভাষায় দক্ষতা থাকা আবশ্যিক হয়। এই দেশে পড়াশোনা শেষে কাজ খোঁজার ক্ষেত্রেও সুযোগ অনেক।

অস্ট্রেলিয়া (Australia)
অস্ট্রেলিয়ায় ভারতীয়দের একটি বড় অংশ রয়েছে যারা মূলত আইটি, স্বাস্থ্যসেবা, অ্যাকাউন্টিং, শিক্ষা ও নির্মাণ খাতে কাজ করেন। Skilled Independent Visa (Subclass 189) বা Skilled Nominated Visa (Subclass 190)-এর মাধ্যমে পয়েন্ট ভিত্তিক সিস্টেমে আবেদন করতে হয়। ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা (IELTS/PTE), বয়স, শিক্ষাগত যোগ্যতা, কাজের অভিজ্ঞতা এসব মিলিয়ে পয়েন্ট নির্ধারিত হয়। PR পাওয়ার সুযোগ থাকায় অস্ট্রেলিয়া অনেকের পছন্দের গন্তব্য।
সিঙ্গাপুর (Singapore)
সিঙ্গাপুরে ভারতীয়রা বহুবিধ ক্ষেত্রে কাজ করেন। যেমন ব্যাঙ্কিং ফিনটেক, আইটি, বায়োটেক, হসপিটালিটি। Employment Pass (EP) বা S Pass-এর মাধ্যমে চাকরি করা যায়। EP-এর জন্য উচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং উচ্চ বেতন কাঠামো থাকা প্রয়োজন। সিঙ্গাপুরে চাকরি খোঁজার জন্য বিভিন্ন জব পোর্টাল যেমন JobStreet, JobsDB, LinkedIn ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়। স্পনসর কোম্পানির মাধ্যমে কাজের ভিসা মেলে।
যুক্তরাজ্য (UK)
UK-তে ভারতীয় ডাক্তার, নার্স, শিক্ষক ও আইটি প্রফেশনালদের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। NHS-এর অধীনে নার্সিং পজিশনের জন্য ভারতীয়দের প্রচুর নিয়োগ হয়। Skilled Worker Visa-এর আওতায় নিয়োগ হয়। IELTS এবং CBT পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে, রেজিস্ট্রেশন ও স্পনসরশিপ পাওয়ার পর ভিসা আবেদন করা যায়। পড়াশোনা শেষে কাজের সুযোগ পাওয়া এবং PR-এর পথও খোলা থাকে।

যুক্তরাষ্ট্র (USA)
ভারতীয় যুবসমাজের সোনার দেশ বলা যেতে পারে আমেরিকাকে। হাই-স্কিলড কর্মীদের জন্য H-1B ভিসা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, সায়েন্টিস্ট, ফিনান্স এক্সপার্ট, ডাক্তার এসব ক্ষেত্রে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট সময়কালে (এপ্রিল) H-1B ভিসার লটারি খোলে, তাতে নির্বাচিত হলে আবেদন জমা দেওয়া হয়। Green Card পাওয়ারও সুযোগ আছে দীর্ঘমেয়াদে। STEM শিক্ষার্থীদের জন্য OPT ও CPT-র মতো নিয়ম রয়েছে যাতে তারা পড়াশোনা শেষ করার পর কাজ করতে পারেন।

এই সব দেশের মধ্যে অধিকাংশেই কাজ খোঁজার প্রথম ধাপ হল একটি বিশ্বাসযোগ্য জব অফার পাওয়া, যেটি সংশ্লিষ্ট দেশের অভিবাসন নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অনেকে LinkedIn, Indeed, Glassdoor ইত্যাদি আন্তর্জাতিক জব পোর্টালের মাধ্যমে আবেদন করেন। কেউ কেউ নিয়োগ সংস্থার সাহায্য নেন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, প্রতিটি দেশেই আইনি পথ মেনে, সমস্ত মেডিক্যাল ও পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সম্পূর্ণ করে কাজের ভিসা নেওয়া। অন্যদিকে, ভারত সরকারের Emigration Act অনুযায়ী যারা Emigration Check Required (ECR) ক্যাটাগরিতে পড়েন, তাদের ক্ষেত্রে বিদেশযাত্রার আগে নির্দিষ্ট অনুমোদন নেওয়া জরুরি। অনেক সময়ে প্রতারণার শিকার হন তরুণ-তরুণীরা, তাই MEA (Ministry of External Affairs)-র অনুমোদিত রিক্রুটমেন্ট এজেন্সির মাধ্যমেই বিদেশে কাজ খোঁজা উচিত। সবশেষে বলা যায়, আন্তর্জাতিক কর্মক্ষেত্রে ভারতীয়দের জন্য সুযোগের পরিসর বাড়ছে। প্রয়োজন শুধু সঠিক তথ্য, দক্ষতা, পরিকল্পনা এবং আইনি প্রক্রিয়া মেনে এগিয়ে চলা। এই প্রজন্মের ভারতীয় যুবক-যুবতীরা আজ শুধু দেশের সীমায় আটকে নেই, তাঁরা গড়ছে এক নতুন বৈশ্বিক পরিচয়।
সব ছবি : প্রতিনিধিত্বমূলক
আরও পড়ুন : USA : আমেরিকায় প্রবেশে কড়া নিষেধাজ্ঞা: ১২ দেশের নাগরিকদের প্রবেশ পুরোপুরি নিষিদ্ধ, বিধিনিষেধ আরও ৭ দেশের উপর
