



বসুধা চৌধুরী ★ সাশ্রয় নিউজ : ভালবাসার সম্পর্কে প্রতারণা এ যেন চেনা কিন্তু অসহ্য এক বিষ। সম্পর্কের শুরুতে যে অঙ্গীকার, যে স্নেহ, যে ভরসা নিয়ে পথচলা, তার মাঝপথেই হঠাৎ চোরাস্রোতের মতো ঢুকে পড়ে গোপন অন্য কোনও মানুষ। সেই সম্পর্ক শারীরিক হোক বা মানসিক যন্ত্রণার তীব্রতা প্রায় সমানই। অথচ এই প্রবণতা থামানোর কোনও সফল কৌশল এখনও পর্যন্ত সমাজ বের করতে পারেনি। প্রশ্ন থেকে যায়, কেন মানুষ ঠকায়? এবং কেন ঠকে যায় বারবার?

অনেক সময় নিজের সঙ্গীর আচরণে হালকা ফাটল লক্ষ্য করেও আমরা মুখে কিছু বলি না। হয়ত সন্দেহ করি, হয়ত ভিতরে ভিতরে কষ্টে গুমরে যাই। কিন্তু সঙ্গী যখন কিছুই বলেন না, তখন সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। গোপন করার এই খেলা শেষ পর্যন্ত দু’জনকেই ঠকায়। একজন ঠকায় বিশ্বাসঘাতকতা করে, আর একজন ঠকে হৃদয় হারিয়ে। মনোবিদ রিচা বসু (Richa Basu) জানাচ্ছেন, “গোপনীয়তা যখন প্রবণতা হয়ে দাঁড়ায়, তখন সম্পর্কের ভিতরটা ক্ষয়ে যেতে থাকে। আসল সমস্যা সত্যি বলার সাহসের অভাব।” বহু মানুষই বোঝেন না, যদি সত্যিটা বলা হত, সম্পর্ক হয়তো অন্য দিকে মোড় নিত, কিন্তু প্রতারণা নামক আত্মঘাতী অস্ত্রটা ব্যবহার করতে হত না।

আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি এই প্রবণতার পেছনে বড় কারণ। কাউকে নিজের জীবনে এনে কথা বলা, মানসিক প্রশ্রয় চাওয়া এই প্রবণতা জন্ম নেয় যখন একজন মানুষ নিজের জায়গায় নিজে অপ্রাসঙ্গিক মনে করতে শুরু করেন।
Read: Sex : যৌন সম্পর্ক বিষয়ে আপনি সঠিক জানেন তো?
তখন প্রয়োজন পড়ে এমন কাউকে, যিনি প্রশ্ন করবেন না, শুধু শুনবেন। আর সেখানেই তৈরি হয় নতুন কোনও সম্পর্কের সম্ভাবনা, যেটা সঙ্গীর অজান্তে বেড়ে ওঠে। মনোবিদ দীপাঞ্জলি সেন (Deepanjali Sen) বলছেন, “অনেক সময় একঘেয়েমি থেকেও মানুষ প্রতারণার পথে হাঁটেন। সম্পর্ক যত পুরনো হয়, ততই উত্তেজনা কমে আসে। সেই জায়গাটা পূরণ করতে চান নতুন কারও মাধ্যমে।” অথচ এই একঘেয়েমির কথা যদি সঙ্গীর সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা করা যেত, তাহলে হয়ত পথ বদলে যেত। আবার অনেকে নির্জনতা সহ্য করতে পারেন না। একসঙ্গে থাকা মানেই সব সময় মানসিকভাবে কাছে থাকা নয়। জীবনযাপনের চাপ, কাজের ব্যস্ততা, পারিবারিক টানাপোড়েনের মধ্যে সঙ্গীর থেকে দূরত্ব তৈরি হতে থাকে। তখনই কোনও তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি মানসিক প্রশ্রয় হিসেবে আবির্ভূত হয়। কেউ কেউ হয়ত সেখানে সীমা বজায় রাখেন, কেউ আবার গোপন আবেগে জড়িয়ে ফেলেন নিজের সবটুকু। আবার, অনেকে এই সমস্যাকে এককভাবে মানসিক বিচ্ছিন্নতা বলেও ব্যাখ্যা করেন। যেমন সমাজকর্মী অনুভব ঘোষ (Anubhav Ghosh) বলেন, “প্রতিদিনের চাপে আমরা সম্পর্কের যত্ন নিতে ভুলে যাই। কেউ যদি অনুভব করেন, তিনি তাঁর সঙ্গীর কাছ থেকে ভালবাসা, শ্রদ্ধা বা সহানুভূতি পাচ্ছেন না, তখনই তাঁর মনে হয়, এই সম্পর্কে আর তাঁর কোনও অস্তিত্ব নেই। সেই জায়গায় অন্য কারও উপস্থিতি যেন নতুন আলো এনে দেয়।”

বর্তমান সমাজেও বহুগামিতা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বিস্তর। কেউ কেউ বিশ্বাস করছেন, একাধিক মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা মানে মুক্ত জীবন। কিন্তু সম্পর্ক যখন গোপনে গড়ে ওঠে, তখন তার আর কোনও স্বচ্ছতা থাকে না। প্রেম যেখানে লুকিয়ে নিতে হয়, সেখানে ভালবাসা একপেশে হয়ে যায়। মনোবিদ শ্রেয়া রায় (Shreya Roy) বলেন, “বহুগামিতা আর প্রতারণার মাঝখানে সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। যেখানে স্বচ্ছতা নেই, সেখানে কোনও তত্ত্বই দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না।” এখানেই আরও এক বড় ভূমিকা নেয় ডিজিটাল যুগ। অগণিত ডেটিং অ্যাপ, সোশ্যাল মিডিয়ার নিত্যনতুন প্ল্যাটফর্ম মানুষকে যোগাযোগের দারুণ সুযোগ দিচ্ছে। কিন্তু সেই সহজলভ্যতার হাত ধরেই তৈরি হচ্ছে আবেগের ফাঁদ। একজন মাত্র ইনবক্স মেসেজ থেকেই সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছেন, অথচ নিজস্ব সম্পর্কের ভিত তখনও অটুট দেখাচ্ছে। এই দ্বিচারিতা শেষ পর্যন্ত সম্পর্ককে ভেঙে দেয়।সোশ্যাল সাইকোলজিস্ট অর্ণব চক্রবর্তী (Arnab Chakraborty) বলছেন, “মানুষের মধ্যে আগ্রহ, রোমাঞ্চ, নতুনকে চেনার একটা সহজাত বাসনা রয়েছে। কিন্তু সেই বাসনা যখন নৈতিক সীমা পেরিয়ে যায়, তখনই সম্পর্কের ভিত কেঁপে ওঠে। গোপন প্রেম, ডিজিটাল কথোপকথন সবটাই একটা না বলা বিশ্বাসঘাতকতা।” অথচ এই বিশ্বাসঘাতকতা যে কত সহজে ঠেকানো যেত, তা নিয়ে প্রশ্নও তুলছেন বিশেষজ্ঞরা। যদি শুধু বলা যেত, “আমি খুশি নই”, যদি বলা যেত, “আমার কিছু বলতে মন চাইছে”, তবে হয়ত সম্পর্ক প্রতারিত হওয়ার আগেই নতুন রূপ পেত। সম্পর্ক মানেই তো একসঙ্গে থাকা নয়, সম্পর্ক মানে একে অপরকে জানার সাহস রাখা। প্রতারণা কোনও হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনা নয়। তা অনেক দিনের না-বলা, না-শোনা কথার ফসল। সেই জমিতে যদি সাহসের বীজ পোঁতা যেত, তবে হয়ত গড়ে উঠত একটুকরো বিশ্বাসের বন। আর প্রতারক শব্দটা হয়তো আজও অজানা থেকে যেত।
ছবি : সংগৃহীত
আরও পড়ুন : Sexuality : সাফল্যের পথে কামনার কাঁটা: যৌন উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণই আসল শক্তি
