



শ্রেয়সী মজুমদার ★ সাশ্রয় নিউজ : “বিবাহ স্বর্গে স্থির হয়” বহু পুরনো এই কথাটা শুনতে শুনতে আমরা বড় হয়েছি। কিন্তু বাস্তবে কী সব বিয়ে সত্যিই স্বর্গীয় হয়? সমাজের রঙিন ছবির আড়ালে আজ ভারতীয় দাম্পত্যজীবনের একটা অন্ধকার কোণ ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে ‘এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার’ বা পরকীয়া। মানে, বিবাহিত জীবনে থেকেও অন্য কারও প্রেমে জড়িয়ে পড়া।

ভয়াবহ এই প্রবণতা দিনকে দিন বাড়ছে ভারতের ঘরে ঘরে। যৌন বিশেষজ্ঞদের মতে, সম্পর্কের শীতলতা, শারীরিক সমস্যার অবহেলা, মানসিক দূরত্ব, এমনকী সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব সব মিলিয়ে এই সমস্যার শিকড় অনেক গভীরে। যৌন বিশেষজ্ঞ ড. অমিত নালে (Dr. Amit Nale) জানাচ্ছেন, “ভারতের প্রেক্ষাপটে বিবাহিত জীবনে পরকীয়া এখন খুবই সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে, ভারতের ৫০ শতাংশের বেশি বিবাহিত নারী-পুরুষ নিজেদের দাম্পত্য জীবনে সন্তুষ্ট নন। অনেকে প্রকাশ্যে স্বীকারও করছেন, তাঁরা অন্য কারও প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন কিংবা শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়েছেন।”

একটি সাম্প্রতিক জরিপ অনুযায়ী, ভারতের ৭৬ শতাংশ নারী ও ৬১ শতাংশ পুরুষ মনে করেন, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক কোনও পাপ নয়, বরং সেটা একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতির বিষয়। তবে প্রশ্ন হল, কেন বাড়ছে এই প্রবণতা? সম্পর্কের পবিত্রতা কি তবে হারিয়ে যাচ্ছে? ড. নালের কথায়, এর পিছনে শারীরিক, মানসিক, সামাজিক এই তিনটি স্তরের কারণই রয়েছে। পুরুষদের মধ্যে একাধিক শারীরিক সমস্যা যেমন : ইরেক্টাইল ডিসফাংশন, প্রিম্যাচিওর ইজ্যাকুলেশন বা ফিমোসিস থাকলে তা যৌন সম্পর্কের প্রতি অনাগ্রহ তৈরি করে। এর ফলে স্ত্রী অসন্তুষ্ট হয়ে পড়েন, সম্পর্ক ঠেকে যায় সঙ্কটে।

একইভাবে, মহিলাদের মধ্যে যোনির সংকীর্ণতা, যৌন উদ্দীপনার অভাব, অথবা হরমোনজনিত কারণে যৌন আগ্রহ কমে যাওয়া এসবও দাম্পত্য জীবনে চাপ তৈরি করে। ড. নালে আরও বলেন, “এই সব সমস্যাগুলো চিকিৎসাযোগ্য। কিন্তু সমস্যা হল, অধিকাংশ দম্পতি এসব কথা মুখে আনতে চান না। কেউ কারও সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেন না, ফলে সমস্যা বাড়তেই থাকে।”

তবে শুধু শারীরিক সমস্যাই নয়, মানসিক এবং সামাজিক চাপও বড় ভূমিকা রাখছে পরকীয়ার বিস্তারে। ভারতের বহু পরিবার এখনও যৌথ ব্যবস্থায় চলে। সেখানে নারীকে একসঙ্গে অনেক দায়িত্ব সামলাতে হয়।

বাড়ির কাজ, শ্বশুর-শাশুড়ির খেয়াল রাখা, সন্তানকে বড় করা সব কিছুতেই তাদের ভূমিকা মূল। ফলে নিজের মানসিক জায়গা বা স্বামীর সঙ্গে সময় কাটানোর জায়গা অনেকটাই কমে যায় অন্যদিকে, সোশ্যাল মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বেশ চিন্তিত। আজকাল অনেকেই বাস্তব সম্পর্কের চেয়ে ভার্চুয়াল সম্পর্ককে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। মোবাইল, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের জগতে হারিয়ে গিয়ে সঙ্গীর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন অনেকেই। এই ডিজিটাল দূরত্ব, ধীরে ধীরে তৈরি করছে আবেগের শূন্যতা আর সেই ফাঁকেই ঢুকে পড়ছে তৃতীয় কেউ। এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তির পথ কী? ড. নালে জানাচ্ছেন, “সবচেয়ে বড় দাওয়াই হল : খোলামেলা কথা বলা। একে অপরের সমস্যার কথা বলা, একে অপরকে বোঝা, যৌন জীবনে কোনও অসুবিধা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া, পারস্পরিক সম্মান বজায় রাখার মত বিষয়গুলো সম্পর্ককে বাঁচাতে পারে।” তিনি আরও বলেন, “অনেক সময় আমরা দেখি, এক জন সঙ্গী অন্য জনের শরীর বা গোপনাঙ্গ পরিষ্কার রাখেন না, ফলে যৌন আকর্ষণ কমে যায়। বারবার যৌনতায় না বলার ফলেই অনেক সময় অন্য সম্পর্কের জন্ম হয়। যদি এই সমস্ত বিষয় একে অপরের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায়, তবে অনেক সমস্যা এড়ানো সম্ভব।”

আসলে সম্পর্ক মানে শুধু প্রেম বা যৌনতা নয়। সম্পর্ক মানে নির্ভরতা, বোঝাপড়া এবং বিশ্বাস। আর এই বিশ্বাস ভাঙলেই সৃষ্টি হয় ফাঁক, যার মধ্যে সহজেই ঢুকে পড়ে অন্য কেউ। শহর থেকে গ্রাম এই সমস্যা আজ সর্বত্র।

অনেকেই আজও পরকীয়াকে লুকিয়ে রাখতে চান, আবার অনেকেই প্রকাশ্যে নিয়ে আসছেন। তবে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, পরকীয়া এখন আর ‘ট্যাবু’ নয় বরং এক ভয়াবহ বাস্তবতা। এই ফিচার আমাদের চোখ খুলে দেয়, যে সমস্যাকে এতদিন চুপিচুপি এড়িয়ে গিয়েছি, সেটাই আজ মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ছে। এর প্রতিকার একমাত্র স্বচ্ছতা, সাহসিকতা, এবং একে অপরের প্রতি দায়িত্ববোধ। সম্পর্কের শরীরটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই জরুরি তার আত্মা। সেই আত্মাটাকে সজীব রাখার দায়িত্ব আমাদেরই। নাহলে, যে সম্পর্ক একদিন ‘স্বর্গে’ তৈরি হয়েছিল, তা ভেঙে পড়বে এই পৃথিবীতেই।
ছবি : সংগৃহীত ও প্রতীকী
আরও পড়ুন : Extramarital affair : বন্ধ দরজার পেছনে কী চলল? পরকীয়ার অবাক সবাই
