



রীতা বিশ্বাস পান্ডে ★ নতুন দিল্লি : ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ২০২৫ সালের মে মাসের পরিস্থিতি—পহেলগাঁও হামলা ও “অপারেশন সিঁদুর” এর মতো ঘটনাতে, এটি বৈশ্বিক অর্থনীতিতে গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে, যদিও ভারত ও পাকিস্তানের অর্থনীতিতে এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি হবে। এখানে একটি বিশদ বিশ্লেষণ দেওয়া হল:
বৈশ্বিক অর্থনীতির উপর প্রত্যক্ষ প্রভাব
তেল ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি: মধ্যপ্রাচ্য থেকে খুব বেশি দূরে না হলেও ভারত ও পাকিস্তান বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ তেল ও গ্যাস সরবরাহ অঞ্চলের কাছাকাছি অবস্থিত। এই অঞ্চলে কোনও বড় সামরিক সংঘাত বিশ্বব্যাপী তেল ও গ্যাসের দামকে উসকে দিতে পারে। সরবরাহ শৃঙ্খলে বিঘ্ন, তেলের মজুত নিয়ে অনিশ্চয়তা এবং বাজারের ভীতি তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর জন্য মূল্য বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করতে পারে। ইতিমধ্যেই রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে, এবং এই নতুন সংঘাত পরিস্থিতিকে আরও লাজুক করে তুলতে পারে বলেই ওয়াকিবহাল মহল মনে করেন।
বৈশ্বিক বাণিজ্য ও সরবরাহ : যদিও ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সরাসরি বাণিজ্য খুব বেশি নয়, তবে উভয় দেশের মধ্যে আঞ্চলিক বাণিজ্য পথ এবং লজিস্টিক নেটওয়ার্ক রয়েছে। সংঘাতের ফলে এই পথে পণ্য পরিবহনে বাধা আসতে পারে, যা আঞ্চলিক সরবরাহ শৃঙ্খলকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এর ফলে কিছু নির্দিষ্ট পণ্যের সরবরাহ ব্যাহত হতে পারে এবং আন্তর্জাতিক শিপিং খরচ বৃদ্ধির সম্ভাবনা থেকেই যায়, যা বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে।
বিনিয়োগকারীদের আস্থা হ্রাস: ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ভীতি তৈরি করে। ভারত ও পাকিস্তানের মতো পারমাণবিক শক্তিধর দুটি দেশের মধ্যে সংঘাতের সম্ভাবনা বিশ্ব অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা বাড়িয়ে দিতে পারে। বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ থেকে সরে গিয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ যেমন সোনা, মার্কিন ট্রেজারি বন্ড বেছে নিতে পারে, যার ফলে শেয়ারবাজারগুলিতে পতন দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে উদীয়মান বাজারগুলিতে বিদেশি বিনিয়োগের (FDI এবং FPI) প্রবাহ কমে যেতে পারে।
বিমান চলাচল ও পর্যটন: যদি এই অঞ্চলের আকাশসীমা বন্ধ করে দেওয়া হয় বা বিমান চলাচল সীমিত করা হয়, তবে আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থাগুলির রুট পরিবর্তন করতে হবে, যার ফলে জ্বালানি খরচ ও সময় বাড়বে। এটি বিশ্বব্যাপী বিমান ভাড়ার ওপর প্রভাব ফেলবে। এছাড়াও, দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের পর্যটন শিল্প ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ভারত ও পাকিস্তানের অর্থনীতির উপর প্রভাব
প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি: একটি সংঘাতময় পরিস্থিতিতে উভয় দেশই তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করবে। এর ফলে উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলির জন্য বরাদ্দ কমতে পারে এবং উভয় দেশেরই রাজস্ব ঘাটতি বাড়তে পারে। পাকিস্তানের অর্থনীতি এমনিতেই দুর্বল, উচ্চ বৈদেশিক ঋণ এবং কম বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে ঘরে বাইরে কোনঠাসা। এমন অবস্থায় একটি দীর্ঘস্থায়ী সামরিক সংঘাত তাদের অর্থনীতিকে আরও সংকটে ফেলবে, এমনকি দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকিও বাড়াতে পারে। ভারতের অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী হলেও, যুদ্ধের ব্যয়ভার তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে মন্থর করতে পারে।
মুদ্রাস্ফীতি ও মুদ্রার অবমূল্যায়ন: যুদ্ধের কারণে পণ্য ও সেবার সরবরাহ ব্যাহত হতে পারে, যার ফলে মূল্যবৃদ্ধি ঘটবে। বিশেষ করে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে পরিবহনের খরচ বাড়বে এবং তা প্রায় প্রতিটি পণ্যের মূল্যকে প্রভাবিত করবে। এছাড়াও, বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে যাওয়ায় মূলধন পলায়ন (capital flight) হতে পারে, যা উভয় দেশের মুদ্রার (বিশেষত পাকিস্তানি রুপি) উল্লেখযোগ্য অবমূল্যায়ন ঘটাতে পারে। রুপির অবমূল্যায়ন আমদানিকে আরও ব্যয়বহুল করে তুলতে পারে এবং মুদ্রাস্ফীতির চাপ আরও বাড়িয়ে দিতে পারে
বাণিজ্য ও বিনিয়োগে পতন: উভয় দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হয়ে যাবে এবং অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এই অঞ্চলে বিনিয়োগ করতে দ্বিধা করবে, যা দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য ক্ষতিকর। কাশ্মীর অঞ্চলের পর্যটন শিল্প সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত হবে।
সম্পদ পুনর্বণ্টন: এই পরিস্থিতি অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং অবকাঠামো উন্নয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলিতে বিনিয়োগ কমিয়ে প্রতিরক্ষা খাতে সম্পদ স্থানান্তরিত হবে। এর ফলে সামাজিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে এবং দারিদ্র্য বৃদ্ধি পেতে পারে।
চাকরি হারানো ও মানবিক সংকট: সংঘাতের কারণে বিভিন্ন শিল্পে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে, যার ফলে ব্যাপক সংখ্যক মানুষ চাকরি হারাতে পারে। বিশেষ করে সীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষেরা বাস্তুচ্যুত হতে পারে, যা একটি বড় মানবিক সংকট তৈরি করবে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
বিশ্ব অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই সংঘাত নিরসনে পদক্ষেপ নিতে পারে। জাতিসংঘের মতো সংস্থাগুলি মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করবে এবং প্রয়োজনে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিতে পারে। তবে, এই পদক্ষেপগুলির কার্যকারিতা নির্ভর করবে পরিস্থিতি কতটা গুরুতর হয় এবং জড়িত পক্ষগুলির ইচ্ছার ওপর।
উল্লেখ্য, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ২০২৫ সালের মে মাসের এই সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি উভয় দেশের অর্থনীতিকেই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে জ্বালানি বাজারের অস্থিরতা, বিশ্ব বাণিজ্যে বিঘ্ন, এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করবে। স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে এবং আরও বড় অর্থনৈতিক বিপর্যয় এড়াতে অবিলম্বে কূটনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করা অত্যন্ত জরুরি।
-প্রতীকী চিত্র
আরও পড়ুন : Sasraya News Sunday’s Literature Special | 4th May 2025, Issue 63 | সাশ্রয় নিউজ রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল | সংখ্যা ৬৩ | ৪ মে ২০২৫, রবিবার
