Sasraya News

Durga Puja : আমেরিকায় দুর্গাপুজোয় 

Listen

আমেরিকায় দুর্গাপুজোয় 

মে ঘ শ্রী ব ন্দ্যো পা ধ্যা য় 

মানচিত্রে ম্যাসাচুসেট্‌স রাজ্যটির আকার বিশেষ বড় না হলেও বিভিন্ন কমিটির পাঁচ থেকে ছয়টি কমিটির পুজো সংঘটিত হয়ে থাকে এখানে। এলাকার স্কুল বিল্ডিং ভাড়া নিয়েই মূলত: কমিটির পুজো হয়, তাই সপ্তাহ শেষের শনি আর রবিবারেই পুজো করা সম্ভব হয়ে ওঠে। এর ফলে দেখা যায় কলকাতায় যে সময়ে পুজো হচ্ছে হয়তো তার আগের সপ্তাহে বা তার পরের সপ্তাহে ঠিক দু’দিনের মাথায় পুজো সেরে ফেলতে হল। শুধু কমিটিই নয়, সম্পূর্ণরূপে সময় ও প্রথা মেনে দুর্গাপূজা হয় বিভিন্ন মন্দিরেও। তবে উভয় জায়গাতেই অঞ্জলি ও প্রসাদের ব্যবস্থা থাকে। কমিটির পুজোয় থাকে উপরি কিছু।

পরপর দুই বছর কোভিডাসুরের কোপের পরে প্রবাসে পুজো আবার স্বমহিমায়। এই দুই বছর পুজো যে একদম হয়নি তা নয়। তবে সবখানেই ছিল প্রবেশ নিষেধ। পুরোটাই দেখা গেছে ‘জুম’ কলের মাধ্যমে। আমেরিকায় পাঁচ বছর কাটানোর পর এই প্রথমবার আমার সুযোগ হলো একটি কমিটির পুজোয় সারাদিন যাপনের। বার্লিংটন এলাকার ‘বেঙ্গলিজ অফ নিউ-ইংল্যান্ড’ নামক এই গোষ্ঠীর জন্ম ২০০৪ সালে। হুজুগে বাঙালী একত্রিত হবে অথচ গল্প-গান-আড্ডা হবে না তা কিভাবে সম্ভব! অতএব ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে পরিধি এবং পালন করা শুরু হয় দুর্গাপুজো, কবিপ্রণাম, সরস্বতী পুজো সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান। গত পয়লা ও দোসরা অক্টোবর এই বছরের পুজো অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘মার্শাল সাইমন্ডস মিডল স্কুলে’।

টিকিট আগে থেকে অনলাইনে কাটতে হবে অথবা স্কুলে ঢোকার সময় গেটে। প্যাকেজ বিভিন্ন রকম। নেওয়া যেতে পারে শনিবার অথবা রবিবার অথবা দু’দিনেরই টিকিট। দুপুর ও রাতের খাবার যোগ করলে দাম একরকম আবার শুধু দর্শনের অন্যরকম। আমরা রবিবারটাই বেছে নিয়েছিলাম কিছুটা মেনুর কল্যাণেও। ঢোকার মুখেই আমাদের নাম লেখা খামে দেওয়া হলো দুই বিশেষ রঙের রিস্ট-ব্যান্ড। বাচ্চার জন্য অন্য রঙ কারণ ওদের খাবার কাউন্টার আলাদা। এরপর ঢোকা হলো বিরাট হলঘরে যেটা অন্য দিন আসলে স্কুল ক্যান্টিন। টেবিল আর বেঞ্চ অবশ্য আজও পাতা। সেখানেই লোকজনের আড্ডা জমে উঠছে ক্রমশ:। কিন্তু হলের আরেকপাশ আজ সেজেছে বাঙালী সাজে। উমা তার চার ছেলেমেয়ে নিয়ে সেখানে আজ উপস্থিত। সময় মেনে শুরু হলো অঞ্জলী। তার আগে পুরোহিত মশাই মাইক ঠিক করতে করতে হাতে হাতে ফুল পৌঁছে গেল সামনের সারি থেকে একেবারে পিছনের সারি পর্যন্ত। অঞ্জলী শেষে কিন্তু ফুল প্রতিমার গায়ে ছুঁড়ে দেওয়া মানা। দুয়েকটি বারকোষে লোকের হাত ঘুরে সেই ফুল জমা হলো ঘটের কাছে।

 

ভুরিভোজে যে বাঙালীর ত্বর সয়না তা কী আর বলার অপেক্ষা রাখে? অঞ্জলী শেষ হওয়ার পরমুহূর্তেই দেখা গেল এনাকোন্ডার মতো দুটো লাইন দু’দিক থেকে ঘিরে ফেলেছে লম্বা হলটিকে। মাঝের একটা কাউণ্টারে যেখানে ভিড় হালকা সেখানে কেবল বাচ্চাদের জন্য ন্যুডলস দেওয়া হচ্ছে। প্রজাপতির মতো বাচ্চারা আনন্দে উটে বেড়াচ্ছে সারা হল জুড়ে। হাল্কা ঢাকের স্বর ভেসে আসছে। না: কোনো ঢাকীর ভাগ্য এখানে এসে ডলার প্রাপ্তিতে খুলে যায়নি। সমস্তটাই যন্ত্র চালিত। পুজোর ফল, খিচুড়ি, লাবড়া, ছোলার ডাল, বেগুনি, মিষ্টি চেটেপুটে খেয়ে উঠে মনে হলো হাতে অনেকটা সময়। একবার বাইরে থেকে ঘুরে এলে মন্দ হয়না। প্যান্ডেল হপিং না হোক, কাছাকাছি আরেকটি মন্দিরে যে পুজো হয় তা আমাদের অজানা নয়। শীতল হাওয়ার দাপুটে চাবুক আমাদের ফিরে আসতে বাধ্য করল মায়ের কাছে। অবশ্য এসে ভালোই হলো। ততক্ষণে মায়ের বরণ শুরু হয়ে গেছে। তারপরেই সিঁদুর খেলা। খেলা শেষ হতেই প্রথমে মাটিতে পড়ে থাকা ঘট, ফুল অন্যান্য উপাচার সরিয়ে ফেলা হলো। এরপর লক্ষ্মী গণেশ কার্তিক সরস্বতীকে একে একে নামিয়ে এনে করা হলো বাক্সবন্দী। মা দুর্গাও ব্যতিক্রম নন। মনে পড়ে যাচ্ছিল একটি গানের কয়েকটি পংক্তি “নিত্যা হয়ে রইবি ঘরে, হবে না তোর বিসর্জন”। বিসর্জন হয়তো হবে না, কিন্তু নিত্য পূজিতাও তো হবেন না। আবার এক বছর পর বন্দীদশা ঘুঁচে আলোকপ্রাপ্তা হবেন আমাদের চিন্ময়ী মা।

মুহূর্তের মধ্যে হলের সাজটাই কেমন পাল্টে গেল। যেখানে একটু আগে জমকালো পুজো চলছিল সেখানে এখন সারি সারি টেবিল। আসলে আগামীকাল মানে সোমবার থেকে যে আবার স্কুল শুরু! তাই পুজো কমিটির দায়িত্বের মধ্যে পড়ে রবিবার রাতের মধ্যে সমস্ত একতলাটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে যাওয়া। ‘একতলা’ কিন্তু খুব সামান্য জায়গা নয়। ক্যান্টিন বা হল থেকে বেরিয়ে লম্বা প্যাসেজের ওপারেও আছে কিছু আয়োজন। পরপর পাতা টেবিলে সাজানো শাড়ি, কুর্তি, সালোয়ার, গয়নাগাটি। মানে পুজো দেখা আর পুজো শপিং করার সুবর্ণসুযোগ একসঙ্গে। অস্থায়ী দোকানের পরে আছে একটি বেশ বড় অডিটোরিয়াম। মা বাক্সবন্দী হয়েছেন বলেই কিন্তু অনুষ্ঠান যে শেষ তা নয়। ইন্ডিয়ান আইডলের তিন নম্বর সিজনের রানার আপ অমিত পল পাক্কা দু’ঘন্টা তাঁর কণ্ঠের জাদুতে মাতিয়ে রাখলেন সমস্ত শ্রোতাদের। মধ্যে মধ্যে দর্শকদের সামনে মাইক ধরে বাঙালীর সুরজ্ঞানে বিস্মিত তিনি নিজেও। কিশোর কুমারের গান দিয়ে শুরু করে ধীরে ধীরে অধুনা বলিউড মিউজিকে ঢুকে পড়তেই দর্শকরা মেতে উঠলেন গানের তালে তালে নাচে। বাচ্চা-বুড়োর ভেদ নিতান্তই লঘু। অবশেষে আবার ফেরা বাংলা গানে। মান্না দে’র গান দিয়ে শেষ হলো আসর।

গানের রেশ কাটতে না কাটতেই রাতের খাবার লাইন পড়ে গেল। এলাহি ব্যাপার। আছে ভাত, মাছের মাথা দিয়ে ডাল, মাছের কালিয়া, পাঁঠার মাংস, চাটনি, পাঁপড়, মিষ্টি। বাচ্চাদের জন্য আলাদা পোলাও, চিকেন, কাপকেক। ষোলো আনা বাঙালী স্বাদের রান্নাবান্নার আয়োজনের দায়িত্বে কিন্তু ছিলেন এক পাঞ্জাবী ভদ্রলোক (কুক) ও তাঁর দলবল। খাবার বন্টনে কমিটির সদস্যদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও যত্ন প্রশংসার দাবী রাখে। দুর্গাপুজো বাঙালীর নিজস্ব হলেও ভিন্নধর্মী ও ভিনদেশী মানুষের সমন্বয় যেমন কলকাতাতে তেমন এখানেও লক্ষ্য করার মতো। শাড়ি-গয়নার পসরা নিয়ে বাংলাদেশ থেকে উপস্থিত ছিলেন দুই দিদি। আবার লোকাল এক বুটিকের পাঞ্জাবি মালকিনও ছিলেন। কুকের কথা আগেই বলেছি। আত্মীয়তা অথবা বন্ধুত্ব সূত্রে পুজোয় উপস্থিত ছিলেন অনেক আমেরিকান এবং আফ্রিকান আমেরিকানও। দেশী পোষাকে তাদের সকলকেই সুন্দর মানিয়েছে। অঞ্জলী দেওয়ার সময়ে হোক বা খাবার লাইনে, আত্মীয় পরিজনরা দুর্গার মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে কোনো কার্পণ্য দেখাচ্ছেন না। রাতে খাবার সময় এমনই এক পরিবারের সঙ্গে আমরা টেবিলে ভাগ করে বসেছিলাম। মেয়েটি বাঙালী, তার বর আমেরিকান। বেশ আমোদ করে নানান খাবার চাখছিলেন তিনি। একটা কালো টুকরো হাতে নিয়ে বউকে জিজ্ঞাসা করলেন, “এটা কী?” এটা সিনামন স্টিক মানে দারুচিনি শুনে অত্যাশ্চর্য হলেন। বুঝলাম এখানে কেক, পাঁউরুটি, পাই ইত্যাদিতে সিনামন গুঁড়ো যেমন অঢেল ব্যবহৃত হয়, রান্নায় গোটা মশলা হিসেবে তেমনটা নয়! বেচারার সমস্যা হলো হাতে করে মাছ বাছতে। আর যাই হোক কাঁটা চামচে এই কার্যটি একেবারেই করা চলে না। জামাই মানুষের হেনস্থায় তো আর হাসা যায়না। তাই যে যার থালায় মনোনিবেশ করলাম।

রাতের খাবারের পরেও কিছু ব্যান্ডের অনুষ্ঠান ছিল। কিন্ত এখানে তো পুজোর টানা ছুটি নেই। পরের দিন অফিস, স্কুল সবই খোলা। তাই দিনের শেষে অন্ধকারের চাদরমুড়ি দিয়ে কনকনে ঠান্ডা চিরে বাড়ির পথ ধরলাম। মন খারাপ? একদম নয়! আসছে মঙ্গলবার আবার যাচ্ছি তো পুজো দেখতে। এবারে এক মন্দিরের পুজোয়।

Sasraya News
Author: Sasraya News

Leave a Comment

Also Read