শোভনা মাইতি ★ সাশ্রয় নিউজ ডেস্ক, কলকাতা : বাঙালির খাবারের পাতে দই মানেই যেন ভোজনের পূর্ণতা। দুপুরের ভাতের শেষে এক চামচ টক দই (Curd) ছাড়া অনেকের খাওয়া সম্পূর্ণ হয় না। অনেকেই মনে করেন, টক দই খেলে হজম ভাল হয়, শরীর ঠাণ্ডা থাকে। কিন্তু চিকিৎসা-বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এই অভ্যাস কতটা স্বাস্থ্যকর? সাম্প্রতিক সময়ে চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদরা এই বিষয়টি নিয়ে দিয়েছেন নানা গুরুত্বপূর্ণ মতামত, যা জানা অত্যন্ত প্রয়োজন।
পুষ্টিবিদ ঋতুপর্ণা মুখোপাধ্যায় বলেন, “দই একটি প্রাকৃতিক প্রোবায়োটিক (Probiotic)। এতে থাকা ভাল ব্যাকটেরিয়া অন্ত্রের (Intestine) জন্য অত্যন্ত উপকারী। ভাতের পরে অল্প পরিমাণে টক দই খেলে হজমের প্রক্রিয়া উন্নত হয়, গ্যাস বা অম্বলের সমস্যা কমে, আর শরীরের পিএইচ ব্যালান্স (pH Balance) ঠিক থাকে।’

কিন্তু, এই ‘অল্প পরিমাণে’ শব্দটির মধ্যেই লুকিয়ে আছে সতর্কতার ইঙ্গিত। কারণ চিকিৎসকরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, যে কোনও খাবারেরই অতিরিক্ত গ্রহণ শরীরের ক্ষতি করতে পারে। টক দইয়ের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। এতে থাকা ল্যাকটিক অ্যাসিড (Lactic Acid) অতিরিক্ত মাত্রায় শরীরে গেলে তা হজমতন্ত্রে জ্বালা, অ্যাসিডিটি (Acidity), ও গ্যাসের সমস্যা বাড়িয়ে দিতে পারে। ডা. সৌম্যজিৎ ঘোষ জানান, ‘টক দইয়ের প্রোবায়োটিক উপাদান অন্ত্রের জন্য ভাল হলেও, রাতের খাবারের পরে এটি খাওয়া একেবারেই ঠিক নয়। টক দইয়ের ঠাণ্ডা প্রকৃতি (Cold Nature) শরীরে শ্লেষ্মা উৎপন্ন করে, ফলে সর্দি-কাশি, শ্বাসকষ্ট বা সাইনাসের (Sinus) সমস্যা বেড়ে যেতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘যাঁরা আর্থ্রাইটিসে (Arthritis) ভোগেন বা জয়েন্টে প্রদাহ (Inflammation) আছে, তাঁদের টক দই এড়িয়ে চলাই ভালো। টক খাবার প্রদাহের মাত্রা বৃদ্ধি করে, যা ব্যথা ও ফোলা বাড়ায়।’
অন্যদিকে, পুষ্টিবিদ সুচিত্রা ঘোষ বলেন, ‘দিনের বেলা ভাতের সঙ্গে অল্প টক দই খাওয়া শরীরের জন্য দারুণ উপকারী। এতে ক্যালসিয়াম (Calcium), প্রোটিন (Protein), ভিটামিন বি (Vitamin B)-এর মতো পুষ্টি উপাদান থাকে, যা হাড় ও পেশিকে শক্তিশালী করে।’ তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘যাঁরা ল্যাকটোজ ইনটলারেন্ট (Lactose Intolerant), তাঁদের টক দই খাওয়ার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।’

চিকিৎসা বিজ্ঞানে দেখা গিয়েছে, টক দইয়ে থাকা প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া শরীরের ইমিউন সিস্টেম (Immune System) শক্তিশালী করতে সাহায্য করে। এটি অন্ত্রের ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া দূর করে, হজমতন্ত্রকে সুস্থ রাখে। তবে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, ফ্রীজ থেকে বের করে ঠাণ্ডা দই সঙ্গে সঙ্গে না খেয়ে, কিছুক্ষণ রুম টেম্পারেচারে (Room Temperature) রেখে খাওয়া উচিত। এতে শরীরে হঠাৎ তাপমাত্রার পার্থক্যের কারণে কোনও অস্বস্তি হয় না।চিকিৎসকরা দই খাওয়ার কিছু সঠিক সময় ও নিয়মও জানাচ্ছেন-
১. সকাল বা দুপুরে ভাতের সঙ্গে এক থেকে দুই চামচ টক দই যথেষ্ট।
২. রাতে টক দই খাওয়া এড়িয়ে চলাই ভাল, বিশেষ করে যাঁদের ঠাণ্ডা, সাইনাস, বা শ্বাসকষ্টের সমস্যা আছে।
৩. প্যাকেটজাত দইয়ের বদলে ঘরে তৈরি দই খাওয়া সবচেয়ে নিরাপদ ও উপকারী। বাজারের দইয়ে অনেক সময় প্রিজারভেটিভ (Preservative) ও চিনি যোগ থাকে, যা শরীরের ক্ষতি করতে পারে।
৪. টক দইয়ের সঙ্গে অল্প গুড় বা চিনি মিশিয়ে খেলে টকভাব কমে এবং হজমে সুবিধা হয়।
আরও পড়ুন : Scam, Safe Travel Tips | বেড়াতে গিয়ে সর্বস্বান্ত! ভ্রমণপ্রেমীরা কীভাবে এড়াবেন স্ক্যামের ফাঁদ?

গরমকালে দই শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে, ক্লান্তি দূর করে এবং ডিহাইড্রেশন (Dehydration) -এর ঝুঁকি কমায়। কিন্তু শীতকালে এই একই দই অনেক সময় শরীর ঠান্ডা বাড়িয়ে দেয়। তাই চিকিৎসকরা বলেন, মৌসুম বুঝে দই খাওয়াই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। ঋতুপর্ণা মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘দই খাওয়ার সবচেয়ে বড় উপকারিতা হল, এটি আমাদের হজমতন্ত্রকে সুস্থ রাখে। তবে শরীরের স্বভাব, ঋতু এবং খাওয়ার সময় অনুযায়ী দইয়ের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। কোনও কিছুই অতিরিক্ত ভাল নয়।’
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের একবাক্যে মত, ভাতের পরে টক দই খাওয়ার অভ্যাস একেবারে ভুল নয়, তবে পরিমাণ, সময় ও মৌসুম বুঝে খাওয়াটাই আসল। দুপুরে অল্প টক দই হজমে সাহায্য করে ও পুষ্টি দেয়, কিন্তু রাতে এটি শরীরের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে। তাই বাঙালির প্রিয় এই টক দই খাওয়ারও প্রয়োজন সংযম ও সচেতনতা।
ছবি: প্রতীকী ও সংগৃহীত
আরও পড়ুন : lifestyle change for fatherhood | বাবা হতে চান? এই অভ্যাসগুলি বদলালেই দ্রুত সুসংবাদ পাবেন




