Sasraya News

Christmas Special 2023 : সাশ্রয় নিউজ বড়দিন স্পেশাল ২০২৩

Listen


সম্পাদকীয়

সাশ্রয় নিউজ-এর পক্ষ থেকে সকল পাঠক-পাঠিকাদের Christmas ও বড়দিনের আন্তরিক প্রীতি শুভেচ্ছা ও ভালবাসা জানাই। 

🍁ক বি তা / এ ক

বিকাশ চন্দ

প্রতিভাসে 

উজ্জ্বল অক্ষর ক্ষয়ে গেলে
ভাঙা বুকে অবাক সকল শব্দ রাশি
প্রজন্ম খুঁজে বেড়াতে বহুকাল প্রতীক্ষায়
অবশিষ্ট ভালোবাসায় স্থির কালের উষ্ণতা
অনির্বাণ জ্বলনে কাতর চেনা মুখ

জন্ম কথা শোনার প্রতীক্ষায় গাছের কাছে
চুপচাপ ফুল পাতার আশ্চর্য রহস্য
সনাতন সময় কাল জানে কোথাও
আমার বর্তমান যদি ভালোবাসো
আশ্চর্য নিষিদ্ধ সময়ে একাকী রক্ত-স্নান কেন

অঙ্কুর জন্মের অনুরাগ জানে নারী ফুল নদী
অপাপ জ্যোৎস্না জানে আলোর বিরহ
অবাঞ্ছিত ক্লান্তি ভাঙে শাশ্বত অবকাশ
ব্যর্থ যুবক যুবতী প্রত্যাশিত জীবন খোঁজে
কেবল অক্ষম সময় নির্বাক ক্ষমতার ভেতর
শরীরী বিষণ্ণতা দু’ঠোঁটে কাঁপছে অস্ফুট স্বরলিপি
অবিনীত সময়ে তবু বুকময় নিবিড় প্রণয় কথা
আর কত কাল আশ্চর্য ক্ষুধা ঝরে পড়ে
এ কেমন যন্ত্রণা ছায়া প্রচ্ছায়া হীন বাঁচে
সকল যৌবন স্থীর নিষিদ্ধ প্রতিভাসে

 

তাহমিনা শিল্পী

যীশু আসছেন

একটি গাছের সাথে দেখা হল
গাছটি মাথা নুয়ে আছে,
গাছটির পাতায় পাতায় ক্লেদজ সময়ের যন্ত্রণা।
আচমকা গড়িয়ে এল ক’য়েকটি রঙিন বল
বলগুলোকে একে একে গাছে বেঁধে দিলাম।
গাছটিকে ঘিরে সোনালি জ্যোতির্বলয় হেসে উঠল
শিশুর ছদ্মবেশে এক স্বর্গদূত মুক্তির গান শোনায়
কুমারী ম্যারির কোলে, ছোট্ট কু্ঁড়ে ঘরে।
রঙির বলগুলো ক্রিসমাস ট্রির ডালে দুলে দুলে বলে
যিশু আসছেন, যীশু আসছেন
হে অশুভ আত্মার দল,
এবার তোমরা পালাও, পালাও…

 

আমিনা তাবাসসুম 

ভোরের গোধূলিলগ্ন

একটু পরেই সূর্য দেখা দেবে দিগন্তে

এই মুহূর্তে,
তোমাকে ছাড়া কিছু ভাবছি না

আসলে সকল ভাবনার মধ্যেই তুমি থাকো
এবং
ভোরের সান্নিধ্যে এসে
পাখিদের ঠোঁটের থেকে গল্প শুনি রোজ

অন্ধকার সোনালী হচ্ছে ক্রমশ
এই আলো এবং সময় আমাদের নিয়ে যায়
অলৌকিক রূপকথার স্তরে

তারপর কোনও সংকোচ থাকতে নেই
অচিন্ত্য, মিশে যাওয়া ছাড়া
প্রেমে আর কোনও ডাকনাম নেই

 

সৈয়দ নূরুল আলম

জলের পাশে মানুষ

উত্তরবঙ্গের জলভাসি মানুষের পাশে মানবিক মানুষ।  ব্যথার খোঁজে ব্যথা, বৃষ্টি ভেজা কান্না বিপদসীমা উপর দিয়ে হাঁটে। হাতে হাতে পুরনো কাপড়, শুকনো চিড়া-গুড়, জলের পাশে মানুষ। প্রবল স্রোতে মায়ের কোল ছুটে ভেসে যায় দুগ্ধ শিশু।
গাছ ভাঙে, পাড় ভাঙে, মন ভাঙে সরল মানুষের। অপলক তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছুই থাকে না করার।

 

শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী

পাপ 

নদীর বুকের ওমে রেখে যাই চিঠি
দুলছে শূন্যে দড়িসেতু
এ পথে আসতে নেই জেনেশুনে শপথ করেছি
ডুবছে সাধের ডিঙি। ডোবো

এ পথ অন্য কারো এক প্রহর আবছায়া ঘেরা
নদীর বুকের ওমে পাথর সাজিয়ে রেখে
চলযান বয়ে নিয়ে চলি চুপিচুপি
এ পথে আসতে নেই জেনে

গুল্ম আমার ঘরে সোহাগী সতীন
প্রাণখুলে পারাপার হয়ে চলি রোজ
ভাবিনি কখনো এও পাপ
আসেনি কখনও পাপবোধ

যতো কলাপের মতো পাপড়ি খুলেছি
তৃষ্ণা মিটেছে ততো এক আঁজলা জল
ভাবিনি কখনও পারাপারগামী নদীর বুকের ওম যতো
কখন শুকিয়ে গেছে পাপে।

 

অমলকান্তি চন্দ

ক্ষত 

তুমি তো কোনওদিন দেখনি
কতকাল আমার বুকের ভেতর
দীর্ঘ গিরিখাত
উপুড় হয়ে শুয়ে আছে।

প্রতিমুহূর্তে খনন হতে হতে
এই যে জটিল ক্ষত
অমৃত জল
ছিটিয়ে দিতে থাকলে
আচেনা আকাশ
হাসতে দেখলে
সেটাও পরাগসময়।

ব্যথা হলে মন চুপসে যায়
নাড়ি ছুটতে থাকে
দূরন্ত গতির মাঝামাঝি কোনও এক
কাকতাড়ুয়ার ভেতর
কৌশলী কুশল
বিনিময় হতে হতে তুমি জেনে গেছ
সুরা জীবনের জটিল
গন্তব্যের কথা।

এত কিছু জান বলে
মস্তিষ্ক প্রখর হয়
কঞ্চির মতো গাঢ় হতে থাকে
বিলম্বিত আঘাত
আর
তোমার অভিনব চাটুকারিতা।

 

সৈকত মজুমদার

নীলা’র প্রতি

নীলা’র ঘুমন্ত কপালে চুম্বন এঁকেছিলাম একদিন,
ওর শরীরের প্রতিটি লোমকূপ আমার স্পর্শে শিহরিত হয়ে ওঠেছিল;
মুহূর্তে নীলা’র কাজল চোখের চাহনি আর
কম্পিত ঠোঁট আমার হৃদয়ের গভীরে ঝড় তুলেছিল!
গভীর আবেগে অস্থির হয়ে ওঠি আমি,
আমার সারা শরীরে প্রবল বিদ্যুত তরঙ্গ খেলে যায়;
ধীরে ধীরে নীলা’র বুকে মাথা রাখি এবং
সে তার বাহুডোরে আমাকে জড়িয়ে ধরে।

অতঃপর আমার মাথা কোলে লয়ে নীলা কপালে চুমু খায়,
আর নীলা’র ঘন কালো মেঘের মত চুলে আমার মুখ ঢেকে যায়;
নির্জন দুপুরে বিমোহিত হয়ে যাই নীলা’র প্রতি সেইদিন!

 

মমতা রায় চৌধুরী 

যদি পারতাম

যদি হতে পারতাম
তোমার উষ্ণ হৃদয়ে
একরাশ হিমেল বাতাস
গ্রীষ্মের নির্জন দুপুরে
আঁকতাম শীতল সোহাগ।
যদি হতাম শ্রাবণী সন্ধ্যার
বুক দুরু দুরু করা নিশ্বাস
এক বুক অক্সিজেনে
কাটাতাম চিরটাকাল।
তারপর…
যদি শরতের নীলাকাশে
শুভ্র মেঘের পানসিতে
ভেসে যেতে পারতাম
বহু দূরে…
তাহলে আর আমার
নাগাল কে পায় ।
যদি হতাম
পাড়া-গাঁয়ের মেঠো সুরে
অঘ্রাণের নবান্নে মেতে উঠতে
পরতে পরতে ছড়িয়ে দিতাম
তার গন্ধ হৃদয়াকাশে।
যদি হতাম ফাগুন হাওয়া
তোমায় নিয়ে মাততাম
আবিররঙা পলাশে।
যদি পারতাম…
তোমায় ছুঁতে…
যদি পারতাম…

 

বাপ্পাদিত্য জানা

অবনত সম্পর্ক

 

কবিতার বাসভূমি কাচ ভাঙা আজ
সহসা কোথায় যেন মেঘহীন বাজ

ছিঁড়ে যায় পুড়ে যায় জল-ছায়া কথা
অন্ধকার ভেঙে ফ্যালে সঙ্গ-শূন্য ব্যথা

পরজন্ম কড়া নাড়ে শান্তনা শূন্যের
ক্ষয়ে ক্ষয়ে মাংস পিন্ড অধিক পূন্যের!

কবিতার ছেঁড়া পাতা মালা হয় যদি
অপূর্ণ চাঁদের আলো হয় মরুনদী

অস্তিত্বের জন্য

 

অস্তিত্ব আসলে আবহমানকে খোঁজে

গোধূলির বিষাদ চলন স্থির নয়
যাওয়ার জন্য আসে
আসে বলে চলে যায়-

সম্পর্কের জাল প্রান্ত-দুপুরও বোঝে

ভালোবাসো না আর

 

আর ভালোবাসো না এখন। জানি।

রাত ভেঙে ভোর হয়
ঘাসে ঘাসে ঘাম জমে, সোনালি শিশির
নরম স্পর্শের দাগ অনুভব-শূন্য।

দুপুর-নক্ষত্র রোদ ঢালে
তাপের কাছে পার্থিব, নতজানু হয়
রোদে আর, বুক জুড়ে বৃষ্টি ঝরে কই?

সব আলো শুষে নেয় রাত
নতুনের মতো হেসে ওঠে অন্ধকার
জ্যোৎস্নায় পোড়া, স্মৃতির ধুলোয় হাসে!

এইসব সহজ বেদনা এসে বলে,
এখন ভালোবাসো না আর-

 

 

নীলাদ্রি দেব 

সহজ 

যে চোখ দেখেছে চোখ, নিরিবিলি হাসি
ওতে হেমন্তের ওম, রেস্তোরাঁয় সৌখিন আলো
আপাত ব্যস্ত শহর আদৌ জানে কি
কার গভীরে কত নিঃশব্দ প্রপাত
যখন স্থির হই, চুপচাপ আসি
বলি এসো সহজ হই আরও একটুখানি

অর্পিতা আচার্য

ভাষা

ধলেশ্বরীর ধূসর আকাশ কুশিয়ারার চর
একটি শব্দ লেখা হল ‘উনিশ’ সে অক্ষর
রক্তে রঙিন উপত্যকায় অঝোর বর্ণমালা
স্রোতের মতো বইছে আজও সুরমা বাংলা

 

 

 

 


🍁গ ল্প


 

সাম্প্রতিক সময়ের লেখক নুসরাত সুলতানা থাকেন বাংলাদেশে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। বর্তমানে লেখক প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের অধীনস্থ মিলিটারী ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে সিভিলিয়ান ষ্টাফ অফিসার হিসেবে কর্মরত। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ : ছায়া সহিস (২০১৯), গহিন গাঙের ঢেউ (২০২০)। পায়রার পায়ে আকাশের ঠিকানায় (২০২১)। মৌতাত (২০২২)। মহাকালের রুদ্র ধ্বনি (২০২২) নাচের শহর রূপেশ্বরী (২০২৩), চান্দ উটলে গাঙ পোয়াতি অয়-২০২৩। সাশ্রয় নিউজ-এর বড় দিন স্পেশাল ২০২৩-এ রইল লেখকের একটি গল্প। 

 

নাচের শহর রূপেশ্বরী

নুসরাত সুলতানা

 

এক
তিতলি নদীর পাড়ে আছে প্রায় আধা মাইল জায়গা জুড়ে এক প্রকাণ্ড বট গাছ। বট গাছের সামনে নদী থেকে জনবসতির দিকে বিস্তীর্ণ প্রান্তর। আকাশে সেদিন রুপোর থালার মতো চাঁদ উঠেছে। বটগাছের পাতাগুলো জোছনায় ধুয়ে আরও রুপমতি হয়েছে। তিতলি নদীর বুকে ডুব দিয়েছে পূর্ণ চাঁদ। তাতে নদীর যুবতী বুক ফুলে ফেঁপে উঠেছে। অই বটগাছের বিস্তীর্ণ প্রান্তরে সেদিন নাচের অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে
পঁচিশ থেকে ত্রিশ বছরের দশ-বারোজন যুবা-পুরুষ। এই কয়েকদিন আগেও তারা আচার আচরণে সোমত্ত পুরুষ ছিল। কিন্তু কী থেকে যে কী হল! কেউ-ই কিছু বুঝতে পারছে না! বেশ কিছুদিন ধরে এই যুবকেরা পায়ে ঘুঙুর লাগিয়ে নেচে বেড়ায়, কেউ-ই পালন করে না সংসার ধর্ম। স্ত্রীরা যখন প্রেমাকাঙ্ক্ষায় ছটফট করে পুরুষগুলো তখন নাচের রেওয়াজ করে। অইসব পুরুষরা সেদিন শুক্লপক্ষ রাতে বটবৃক্ষের তলায় নাচের আসর জমিয়েছে। তারা পায়ে ঘুঙুর বেধে নেচে চলেছে। “যমুনার জল দেখতে কালো, চান করিতে লাগে ভালো” “নিশা লাগিলো রে” এরকম একটার পর একটা গানের সঙ্গে। সেদিন রাতে নাচের অনুষ্ঠানে এসেছেন জমিদার মনোজ চৌধুরীও। মনোজ চৌধুরী কিছুতেই বুঝতে পারছেন না ছেলে-ছোকরাগুলোর হলটা কী! যাহোক নাচ দেখতে এসে মনোজ চৌধুরীর মনে হচ্ছে, এ কোনও যুবক নয়! যেন স্বয়ং স্বর্গ থেকে একদল দেবতা নেমে এসেছে। তাদের মুদ্রা, নিষ্ঠা, ছন্দ, তাল, লয় সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে তারা ক’য়েক পুরুষ ধরে নৃত্যশিল্পী। জমিদার ধন্দে পড়ে যায়, তাঁদের সঙ্গে কী এমন ঘটতে পারে, যা তাদের এমন করে দিয়েছে!

______________________________________________

মিথুনের শ্যামবর্ণ উজ্জ্বল চেহারা, বাচনভঙ্গি আর পৌরুষদীপ্ত কণ্ঠ যে-কোনও নারীরই ভালো লাগার কথা। মিথুন বলে, ইরাবতী তুমি খুব সুন্দর এবং ভালো একটি মেয়ে। নাও এই কাঠগোলাপ তোমার জন্য। ইরাবতী খুব অবাক দৃষ্টিতে তাকায় মিথুনের দিকে। কিন্তু সেই চোখ থেকে তখন সবুজ আলো বেরুচ্ছে না। বরং সেখানে দেখা যায় গভীর সমুদ্রের নীলাভ গভীরতা।

______________________________________________

ওখানে গভীর রাতে তেমন কোনও নারীই নেই। আছে আশি বছরের এক ভিক্ষুক বৃদ্ধা যে এ-গ্রাম ও-গ্রাম ঘুরে ভিক্ষা করে বেড়ায়। হঠাৎই জমিদারের চোখ যায়- এক কোনে এক উর্বশী রূপসীর দিকে। পটল চেরা চোখ তার, তনু দেহ, লম্বা কালো চুল আর চোখের মণিগুলো সবুজাভ। জমিদার তার পেয়াদাকে দিয়ে ডেকে পাঠায় অই রূপসীকে। রূপসী এসে প্রণাম জানিয়ে বলে, জি বলুন মহামান্য। আপনার জন্য কী করতে পারি? জমিদার জিজ্ঞেস করে, ভদ্রে আপনি কোথায় থাকেন? মানে আপনার নিবাস কোথায়? আর আপনার নাম কী? রুপসী উত্তর দেয়, জি আজ্ঞে আমার নাম ইরাবতী আর থাকি নদী পেরিয়ে গিয়ে দুই গ্রাম পর। অই যে পোড়াবাড়ির পাশে যে মন্দির আছে তার পাশে আমাদের কুঁড়েঘর আছে। কথা বলার সময় হঠাৎ মনোজ চৌধুরীর মনে হল ইরাবতীর চোখ থেকে একটা সবুজ আলোক রশ্মি ঠিকরে বেরুচ্ছে। ঠিক তখনই চোখ সরিয়ে নেন জমিদার। জমিদার তাকিয়ে দেখতে পায়, নদীর মাঝখানে একটা ডিঙ্গি নৌকা। এরপর ইরাবতীর দিকে তাকিয়ে আর খুঁজে পায় না। নিমিষেই হারিয়ে ফেলে ইরাবতীকে। মনোজ চৌধুরীর মগজে একটা তীব্র কৌতুহল বোধ বসতি গেড়ে বসে।

দুই

রূপেশ্বরী শহরের পূব পাশ দিয়ে বয়ে গেছে মায়াবতী নদী আর পশ্চিম পাশ দিয়ে তিতলি নদী। আছে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ধানক্ষেত। রয়েছে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়। বড় রাস্তার দুপাশে আছে সারি সারি নারকেল, সুপারি আর পাম গাছ। শহরে যেমন আছে স্কুল- কলেজ -বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তেমনি আছে ক্ষুদে ব্যবসায়ী, কৃষক, জেলে সহ কিছু নিম্ন আয়ের মানুষ। সবাই মিলেমিশে বাস করে আসছে শহরে। নারী-পুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পরিশ্রম করে। শিশুরা স্কুলে যায়, নারীরা ঘরকন্যার কাজ করে। সোমত্ত পুরুষরা দিনভর পরিশ্রম করে, রাতে স্ত্রীর শরীরে ঢেলে দেয় ক্লান্তি। তারপর নারী-পুরুষ উভয়ই সঙ্গমে ক্লান্ত হয়ে ঢলে পড়ে রাতের বুকে। জমিদার মনোজ চৌধুরীর যারা প্রজা তারাও বেশ সুখী জমিদারের খাজনা আদায় ব্যবস্থায়। প্রজাদের ফসল না হলে জোর করে খাজনা আদায় করে না জমিদার। কিন্তু ছয়মাস যাবৎ রূপেশ্বরী শহরের বুকে নেমে এসেছে এক অদৃশ্য, অশরীরী অভিশাপ। হঠাৎ, হঠাৎ-ই দেখা যায় কোনও এক জোয়ান পুরুষ কাজ-কর্ম ফেলে কোনও ভর সন্ধ্যায় কিংবা খুব সকালে পায়ে নুপুর বেঁধে ঘরে ফিরছে। তারপর আর স্ত্রীকে ছুঁয়েও দেখছে না, সংসার গোল্লায় যাচ্ছে, পুরুষটি দুরন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়ে নাচে-গানে আর হাসি-তামাশায়।

মনোজ চৌধুরী সকাল বেলা নাস্তা করতে বসে তার স্ত্রীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করছে। মীনাক্ষী যেমন সুন্দরী তেমনি তার গানের গলা। গায়ের রঙ একটু চাপা তাছাড়া যে-কোনও পুরুষই তার ৩৮ ইঞ্চি বুক, ২৮ ইঞ্চি কোমর, পাতলা ঠোঁট, ডাগর চোখে প্রথমেই আকৃষ্ট হয়ে যায়। বিশ বছরের বিবাহিত জীবনেও মনোজ মীনাক্ষীর গুণমুগ্ধ। মীনাক্ষী প্রতি সকালে নিজ হাতে মনোজ চৌধুরীর জন্য তোকমা, বেল, পেঁপে সহ ক’য়েক রকম শরবত বানায়। বাবুর্চি তৈরি করে বাকরখানি, লুচি, আলুর দম, পায়েস, ঘন দুধের চা। মনোজ-মীনাক্ষীর প্রেমময় দাম্পত্য প্রজা এবং সাধারণ মানুষের মুখে মুখে ফেরে। প্রতিদিন সকাল বেলা দপ্তরে যাওয়ার আগে মনোজ মীনাক্ষীকে গভীর আলিঙ্গনে কপালে চুম্বন দিয়ে যায়। আর তাতে মীনাক্ষীর কমলার কোয়ার মতো ঠোঁটগুলো হয়ে ওঠে টকটকে লাল এবং চোখগুলো হয়ে ওঠে বৃষ্টি ধোঁয়া পাতার মতো আদ্র ও কোমল।

তিন

শহরের আনাচে-কানাচে লোকজনের মুখে শোনা যায়,  কোথাও কোথাও ভর সন্ধ্যায় কিংবা মধ্যদুপুরে কখনও কখনও দেখা যায় এক অপ্সরা সুন্দরীকে। কখনও দেখা যায় কোনও যুবা পুরুষের সঙ্গে আবার কখনও দেখা যায় একা-একা ফুলের মুকুট মাথায়। ঠোঁটে চোরা হাসি আর চোখে আগুন নিয়ে ঘুরে বেড়ায় সে। জমিদার মহাশয় বিষয়টি নিয়ে মাঝেমধ্যেই খুব চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। ভেবে দেখছেন মীনাক্ষীর প্রস্তাব। মীনাক্ষী বলেছিল, তান্ত্রিক ডেকে যোজ্ঞ করার কথা। এসব ভাবতে ভাবতে জমিদারের আচম্বিত মনে পড়ে ইরাবতী নামক সেই সবুজ চোখের মেয়েটির কথা। জমিদার স্থির হয়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, মহিলা তান্ত্রিক সুরবালাকে যোজ্ঞ করতে ডাকবেন। তেমনি ডেকে পাঠানো হল সুরবালাকে। সুরবালায় মাথায় কোমর অব্দি জটা চুল, নাক একেবারে থেবড়ো, চোখ বেশ বড়, গায়ের রঙ বেশ কালো। এসেই সুরবালা রানীমাকে প্রণাম জানিয়ে বলে, বেয়াদবি নিয়েন না জননী। ঘোরতর বিপদের গন্ধ পাচ্ছি তোমার সংসারে। ভালো করে মহাদেবের পূজা দাও। মীনাক্ষী উদগ্রীব হয়ে শুধায়, কী করন লাগবে তান্ত্রিক মা কও দেখি!

তান্ত্রিক বলে,  বাচ্চা পোলার কোমরের তাগা, কুমারী মাইয়ার দুধের বোটার গোড়ার পশম, চল্লিশ বছর বয়স্ক বিধবা নারীর কাঁচা-পাকা চুল, ছাগলের দুধ আর খেজুরের গুড়ের পায়েস, কলমি ফুল, কচুরিপানা ফুলসহ নয়রকম ফুল আর পাঁচরকম কচি পাতা লাগবে। খুব সকালে খালি পেটে যোজ্ঞ করতে বসপ আর সন্ধ্যায় ধ্যানে যা দ্যকতে পাওন যাইব জানাইয়া দিমু। মঙ্গলবার দিন ধ্যান সমেত যোজ্ঞ পূজায় বসপ রানী মা। দিনভর যোজ্ঞ শেষে সুরবালা জানায়, সে আয়নায় দেখতে পেয়েছে এ শহরে এক অশরীরী অতৃপ্ত নারী আত্মা ঘোরাফেরা করছে যে সমস্ত পুরুষের ওপর প্রতিশোধ নিতে চায়। পুরুষ জাতির ওপর তার ভীষণরকম রাগ।

মীনাক্ষী নিয়মিত ধুপ দেয় ঘরে। প্রাসাদে এনেছে মহাদেবের মূর্তি। মীনাক্ষীর কানে কেবলই বাজতে থাকে তান্ত্রিকের উচ্চারিত বিপদের আশঙ্কা। বিভিন্ন মন্দিরে পাইক-বরকন্দাজ দিয়ে পূজা পাঠায় জমিদার পত্নী । নিজে একদিন মহাদেবের পূজায় উপোস করেছে সারাবেলা। সন্ধ্যায় মনোজের হাতে পরমান্ন খেয়ে উপোস ভাঙে মীনাক্ষী। তারপর সেদিন রাতে যেন প্রথম রাতের সোহাগ দিয়েছে মনোজ তাকে। সারা শরীরে তার লাল ফুলা ফুলা দাগ। গোসলে গিয়ে মীনাক্ষী পরম সোহাগে দাগগুলোর ওপরে হাত বুলায় আর তৃপ্তির হাসি হাসে।

প্রায় প্রতিদিনই খুব সকালে হাঁটতে বের হয় মনোজ চৌধুরী। মাঝে মাঝেই যায় তিতলি নদীর পাড়ে যায়। সেদিন তিতলি নদীর পাড়ে হাঁটতে এসে হঠাৎ পায় কাঠগোলাপের গন্ধ। হঠাৎ আসে চোখ-মুখ জুড়িয়ে যাওয়া একটা ঠাণ্ডা বাতাস। কেমন আনমনে বসে আছে মনোজ চৌধুরী। আচমকা এক নারী কণ্ঠ শুনতে পায় মনোজ। সে কণ্ঠ যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসা বিরহ সঙ্গীতের মতো প্রাণ কেড়ে নেয়। মনোজ বিষ্ময়ে তাকিয়ে দেখে ইরাবতী! বলে আরেএএ তুমি? এত সকালে? তুমি না অইপারে থাকো? ইরাবতী হেসে বলে, জি জমিদার বাবু, নদীর এই পাড়ে সকালবেলা আসতে ইচ্ছে করল। এরপর ইরাবতী বলে চলেন, জমিদার বাবু আপনেরে আমাগো গাঁয়ে নিয়া যাই। জমিদার বলে, যাব কীভাবে? ইরাবতী খিলখিলিয়ে হেসে বলে, নৌকায় যাইবেন। অই হাসি এমনই অপার্থিব যে মনোজের বুকে গিয়ে ঝনঝন করে বেজে ওঠে।

এরপর এক সপ্তাহের প্রায় প্রতিদিনই খুব সকালে মনোজ বেরিয়ে যায় প্রাতঃভ্রমণে। মীনাক্ষী যখন ঘুমের ঘোরে একটু উমম করে মনোজের গলা জড়িয়ে ধরতে যায় তখন হাত ঠেকে মনোজের মাথার বালিশে। সেদিন মীনাক্ষী বিছানা ছেড়ে উঠে যায়। তার বুকের ভেতর হু হু করে ওঠে অমঙ্গল চিন্তায়।

______________________________________________

স্থানকালের চেতনা প্রায় লুপ্ত হয়ে যাচ্ছিল মিথুনের। চোখগুলো কেমন ভয়ার্ত ফাঁসির আসামীর মতো লাগছে। তখন ইরাবতী মিথুনের আরও ঘনিষ্ঠ হয় এবং মিথুনের বুকে একটা গভীর চুমু এঁকে দেয়। মিথুনের কানে ফিসফিস করে, যেন প্রবাহিত নদীও শুনতে না পায় সেভাবে খুব আস্তে বলে, আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। তোমার কোনো ক্ষতি করা আমার পক্ষে সম্ভব না।

______________________________________________

চার
একদিন ভর সন্ধ্যা বুকে নিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো মনোজ ঘরে ফেরে। তার সেই গমগমে গলা আর নেই। চুলগুলো উসকোখুসকো। এসে যখন মীনাক্ষীকে ডাক দেয়, মনে হচ্ছে যেন একটা বাচ্চা ছেলে ডাকছে। মীনাক্ষী তখন সন্ধ্যা দিচ্ছিল। মনোজের ডাক শুনে এসেই বলে ওগো মিথুনের বাবা, কী হল তোমার! পর মুহূর্তেই দেখে মনোজের পায়ে ঘুঙুর! মীনাক্ষী চিৎকার করে খাস আয়া শিখাকে বলে, ওগো শিখা মাসি আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে! এরপর নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে মীনাক্ষী। সাজগোজ নেই। চোখে কাজল পড়ে না। কোনওরকম একটু সিঁদুর ছুঁইয়ে রাখে সিঁথিতে। এক কোণে পড়ে থাকে হারমোনিয়াম। নায়েব সাহেব খবর দিয়েছে সুরবালাকে। সুরবালা এসেই বলে, খবর দেও মিথুন বাবাজিরে। সাধু বাবার কাছে যাইতে অবে। সে আছে নীলমণি পাহাড়ের চূড়ায়। মিথুন প্রাচ্য মিথ পুরাণ বিষয়ে উচ্চতর গবেষণা করছে শান্তিনিকেতনে। তাকে তার করেছেন নায়েব সাহেব। টেলিগ্রামে লিখেছেন নায়েব, মাদার সিরিয়াস সিক, কাম ক্যুইকলি।

মিথুন দেশে এসে সব শুনে প্রথমে অবিশ্বাস করে। আরও বিস্তারিত পড়াশোনা করে মিথ, অশরীরী, আত্মা এসব বিষয়ে। নিজের ভেতর থেকে সে একেবারেই তাড়া পায় না হিমাংশু সাধুর কাছে যেতে। পরে তার বাবার সার্বিক কর্মকাণ্ড এবং মায়ের দুরাবস্থা দেখে রাজি হয় নীলমণি পাহাড়ের চূড়ায় হিমাংশু সাধুর কাছে যেতে। তিনদিন, চাররাত ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে পৌঁছায় মিথুন নীলমণি পাহাড়ের পাদদেশে। পৌঁছেই সকালবেলা দেখতে পায় হিমাংশু সাধুর দর্শনে প্রায় শ-খানেক মানুষের ভিড়। নিচেই বসে আছে সাধুর ব্যক্তিগত ব্যবস্থাপক নেহাল। নেহাল মিথুনকে জানায়,  সাধুর লগে দেখা করতে অইলে এককেজি মধু, এককেজি ছাগলের দুধ, একটা রূপার মাদলী আর এক হাজার টেকা লাগব। টাকা ছাড়া সবকিছুরই ব্যবস্থা আছে ম্যানেজারের কাছেই। তবে শর্ত হচ্ছে, সেলাইবিহীন গেরুয়া পরিধানে উপোস অবস্থায় উঠতে হবে দুই হাজার মিটার উঁচু পাহাড় চূড়ায়।

পরের দিন খুব সকালে মিথুন উপোস থেকে ওঠে নীলমণি পাহাড়ের চুড়ায়। হিমাংশু সাধু সব শুনে মিথুনকে বেঁধে দেয় একটা তাবিজ আর সঙ্গে রাখতে দেয় তিনটি কড়ি। এরপর তাকে পাহাড় চুড়ার গাছের ফলাহার দেয়। তারপর বলে দেয়, কীভাবে কী করতে হবে। মিথুন রূপেশ্বরী ফিরে শোনে আরও দু’জন পুরুষ এর ভেতর একই ঘটনার শিকার হয়েছে। মিথুন প্রথমে হিমাংশু সাধুর শর্তানুযায়ী কালী মন্দিরে ঘটা করে পূজা দেয়। পরের দিন খুব সকালে তিতলি নদীর পাড়ে যায়। হিমাংশু সাধু তাকে বলে দিয়েছে প্রতিদিন যেন মিথুন তিতলি নদীর পাড়ে যায়, অইখানে সে আকাঙ্ক্ষিতজনের দেখা পাবে।

পঞ্চম দিন খুব সকালে দেখা মেলে এক অপ্সরী তরুণীর। অই তরুণী সেদিন নদীর ধারে বসেছিল। একা। তার হাতে অনেকগুলো হিজল ফুল। হঠাৎ চারিদিকে কাঁঠালিচাঁপা ফুলের গন্ধ পায় মিথুন আর সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে সাধু বাবার কথা। তড়িঘড়ি কড়ি হাতে নিয়ে তাকায় তরুণীর চোখে। দেখতে পায় সবুজ আলো। মিথুন সেদিন শুধু পরিচিত হয়ে চলে যায়। এরপরের দিন মিথুন তাজা কাঠগোলাপ নিয়ে হাজির হয় তিতলি নদীর পাড়ে। মিথুনের শ্যামবর্ণ উজ্জ্বল চেহারা, বাচনভঙ্গি আর পৌরুষদীপ্ত কণ্ঠ যে-কোনও নারীরই ভালো লাগার কথা। মিথুন বলে, ইরাবতী তুমি খুব সুন্দর এবং ভালো একটি মেয়ে। নাও এই কাঠগোলাপ তোমার জন্য। ইরাবতী খুব অবাক দৃষ্টিতে তাকায় মিথুনের দিকে। কিন্তু সেই চোখ থেকে তখন সবুজ আলো বেরুচ্ছে না। বরং সেখানে দেখা যায় গভীর সমুদ্রের নীলাভ গভীরতা। এরপর আরও একদিন তিতলি নদীর পাড়ে দেখা হয় ইরাবতীর সঙ্গে  মিথুনের। মিথুন হাসিমুখে অনেকক্ষণ গল্প করে। ইরাবতীকে উপহার দেয় একপাতা টিপ আর কোমরের একটা বিছা। ইরাবতী খুব খুশি হয়ে যায়। মিথুন সেদিন আসার সময় ইরাবতীর কপালে চুমু দিয়ে বলে, চল মেয়ে তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। ইরাবতী চোখের জলে হাসি দিয়ে বলে, নাগো, আমি একাই যেতে পারব। অন্যকোনওদিন তোমাকে নিয়ে যাব।

এরপর চারদিন মিথুনকে খুঁজে পায় না ইরাবতী। ইরাবতীকে দেখা যায় তিতলির পাড়ে একা আনমনে বসে থাকতে। শহরে আর কোনও যুবা পুরুষের পায়ে নতুন করে ঘুঙুর দেখা যায় না। কিন্তু আগে যারা নৃত্য শিল্পী হয়ে উঠেছে তারা নাচ-গান নিয়ে বেশ আছে। সেদিন আকাশে পূর্ণ তিথির চাঁদ। মিথুন জানে, সেদিন ইরাবতী তাকে খুঁজবে। মিথুনের মনেও বেশ অস্থিরতা ভর করে। মন ইরাবতীকে কিছুতেই অন্যকিছু ভাবতে সায় দেয় না। মিথুন কেবলই ভাবে, আমি ওর চোখে এক সমুদ্র দুঃখ দেখেছি! সন্ধ্যার একটু পরে মিথুন তিতলির পাড়ে আসে। এসে দেখে নদীর পাড়ে একা বসে আছে ইরাবতী। আর গুনগুনিয়ে গাইছে,  “জোছনা দিয়েছে আড়ি, আসে না আমার বাড়ি।” মিথুন পাশে এসেই বলে, এত সাহস জোছনার? তোমার বাড়ি যায় না? ওকে বেঁধে নিয়ে যাব তোমার বাড়ি, সঙ্গে আমি যাব। অমনি বাচ্চা মেয়ের মতো খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে ইরাবতী। সে হাসি মিথুনের কাছে খুব মানবীয় লাগে। মিথুন আবেগকে প্রশ্রয় না দিয়ে সাধু বাবার নির্দেশিত পথেই চলে নিজেকে সামলে নিয়ে। সে ইরাবতীকে বলে, চল আজ দু’জনে মিলে প্রচুর ভাজা-পোড়া খাবার খাই, তারপর নদীর পাড়ে এসে গল্প করব। দু’জনেই রূপেশ্বরী শহরের গলির মুখে দাঁড়িয়ে খায় বেগুনি, পেঁয়াজু, আলুর চপ, চিকেন ফ্রাই। এরপর দু’জন এসে আবার নদীর পাড়ে বসে। মিথুন ইরাবতীর হাত ধরে বলে, আমি তোমার সঙ্গে বাকি জীবন কাটাতে চাই। তোমার বাড়ি কে আছে? আমার মা তার সঙ্গেই কথা বলবে। ইরাবতী বলে, আজ সারারাত তোমার সঙ্গে এই জোছনায় স্নান করতে চাই। আমি প্রাণভরে তোমার চুলের গন্ধ নিতে চাই, আর তোমার স্পর্শে শীতল হতে চাই। মিথুন খুশি মনে রাজি হয়ে যায়। দু’জন খুব খুশি হয়ে গল্প করতে থাকে। ছেলেবেলা, ভিউ কার্ড জমানো, লাঠি লজেন্স খাওয়া, বেলুন ফুলানো, ঘুড়ি ওড়ানো। গল্পে গল্পে মিথুন যখন নবম শ্রেণির কথা বলে ইরাবতীর চেহারা বিমর্ষ হয়ে যায় এবং রীতিমতো সাদা হয়ে উঠতে থাকে। রাত তখন একটা। মিথুনের মনে পড়ে সে সাধু বাবার দেয়া কড়ি আনেনি। মিথুনের চেহারায় এবার ভয়ার্ত হরিণের ছাপ। একইসঙ্গে ভীতি ও কৌতুহল, রহস্য ও সৌন্দর্য, চন্দ্রলোকের মায়া এবং মধ্যরাত্রির নির্জনতা এক বিচিত্র অনুভূতি সৃষ্টি করে। স্থানকালের চেতনা প্রায় লুপ্ত হয়ে যাচ্ছিল মিথুনের। চোখগুলো কেমন ভয়ার্ত ফাঁসির আসামীর মতো লাগছে। তখন ইরাবতী মিথুনের আরও ঘনিষ্ঠ হয় এবং মিথুনের বুকে একটা গভীর চুমু এঁকে দেয়। মিথুনের কানে ফিসফিস করে, যেন প্রবাহিত নদীও শুনতে না পায় সেভাবে খুব আস্তে বলে, আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। তোমার কোনো ক্ষতি করা আমার পক্ষে সম্ভব না। আজ আমি তোমাকে সব বলব মিথুন। আমি জানি,  তুমি জমিদার বাবুর ছেলে। তোমার সকল গতিবিধি আমার জানা। কিন্তু তোমার চোখে আমি কোনও ধূর্ততা দেখিনি। তোমার চোখগুলো এই তিতলি নদীর মতোই স্বচ্ছ আর সুন্দর। তাই তোমার সঙ্গে আমি মিশতে শুরু করি। 

পাঁচ 
ইরাবতী বলতে থাকে। শোনো, আমারও খুব সুখী এবং সমৃদ্ধ একটা পরিবার ছিল, ভাইবোনের খুনসুটি ছিল।  বাবা সপ্তাহান্তে বাড়ি ফিরে আসতেন, আসার সময় বিভিন্ন বেকারি বিস্কুট, মিষ্টি, ফল নিয়ে আসতেন।  আমি আর আমার ভাই তখন খুব মজা করে খেতাম। মা বাবার পছন্দের পোস্ত রুই, কখনও সরিষা ইলিশ, আবার কখনও চিংড়ি মালাইকারী করতেন। বাবার প্লেটে এটা-সেটা তুলে দিতেন। বাবা তুলে দিতেন আমার প্লেটে। মা কপট রাগ দেখিয়ে বলতেন, সব আদর রাজকন্যার! আমি যেন কেউ না! বাবা বলতেন,  মেয়েকে হিংসা কর ক্যান? একটা মেয়ে আমার! তোমাকেও তো ভালোবাসি। তুমি আমার এই কুঁড়ে ঘরের রাণী। আমরা চারজন লুডু খেলতাম। বাবা সবসময়ই চুরি করত। এই কথা বলে ইরাবতী খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। ওর চেহারায় পূর্ণ চাঁদের জোছনা খেলে যায়। মুহূর্তেই আবার থমথমে মুখচ্ছবি নিয়ে ইরাবতী বলতে থাকে, আমি যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি তখন আমি সাবালিকা হলাম। একটু একটু করে আমার স্তন ফুঁড়ে উঠছিল। মা ফ্রকের সামনে কুচি দিয়ে দিতেন। বাবা এত দ্রুত আমাকে শাড়ি বা ওড়না দিতে চাইলেন না। বাবা বলতেন, ধুর! বাচ্চা মেয়ে কী ওড়না পরবে?

আমি যখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি তখন আমাদের বাড়িতে বাবার এক পিসতুতো ভাই পড়াশোনার জন্য থাকতে আসে। এর মাস তিনেক পরে আসে মায়ের এক মাসতুতো ভাই। মা আমাকে মাঝে মাঝে বলত,  আমি বড় হচ্ছি কোনও পুরুষের খুব কাছ ঘেঁষে যেন না বসি। কিন্তু আমি এসব কথার অর্থ বুঝতাম না। জ্যেঠু আর মামার সঙ্গে আমি খুব বন্ধুত্বপূর্ণ ভাবে মিশতাম। জ্যেঠু আড়ালে, আবডালে আমাকে দু’য়েকবার জড়িয়ে ধরে গালে চুমু দিয়েছে কিন্তু আমার এসব স্রেফ জ্যেঠুর আদর মনে হয়েছে। যদিও দু’য়েকবার শরীর খারাপ লেগেছে কিন্তু আমলে নিইনি।আমাদের গ্রামে বটতলায় বুদ্ধ পূর্ণিমার সময় অনেক বড় মেলা বসত। সেবার বাবা অফিসের ব্যস্ততায় বাড়ি আসতে পারেনি। আমি খুব বায়না ধরলাম মেলায় যাব জ্যেঠু আর মামার সঙ্গে। খুব সাজগোছ করলাম। মায়ের একটা লাল শাড়ি পরলাম, হাত ভর্তি চুড়ি পরলাম, গলায় দানাকুচি মালা পরলাম, লাল টিপ পরলাম, সবশেষে বড় একটা লাল টিপ পরলাম। মা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, মা সাক্ষাৎ দুর্গা। রক্ষে কর মা!… 

ছয়. 
মেলায় খুব ঘুরলাম, চুড়ি, ফিতা, ঝালর, মায়ের শাড়ি সব কিনলাম। ছিকা কিনলাম, গামছা কিনলাম, মেলায় ঘুরে মিষ্টি, মালপোয়া, ঘোল সব খেলাম। ঘোল খাওয়ার সময় আমার মাথা কেমন ঘুরিয়ে উঠল! জ্যেঠু আমার দিকে তাকিয়ে কেমন করে হাসল। মামাকে নিয়ে গেল তার বন্ধু রাতে তাস খেলার জন্য। জ্যেঠু নদী পার হয়ে সোজা পথে না গিয়ে গেল ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। ততক্ষণে আমার মাথা আরও ঘুরছে। আমি বল্লাম, জ্যেঠু জঙ্গলে যাচ্ছ ক্যান? জ্যেঠু বলে, জঙ্গলে আইজকা মজা করমু দুইজনে, চল। এই বলে আমার কোমর জড়িয়ে ধরে আমার স্তনে চাপ দেয় আর বলে মাগী তোর দুধগুলা যা টসটসে অইছে না! আমি বলি, ছি! তুমি আমার জ্যেঠু, বাবার সমান। অমনি বলে, ধুর! নারী-পুরুষের পরিচয় শুধু নারী-পুরুষ। এসব চাচা-ভাতিজী মানুষের বানানো সম্পর্ক। আর তুই তো আমার আপন ভাইয়ের মাইয়া না। আপন ভাইয়ের মাইয়া অইলেও আইজ তরে লাগাইতাম! তোর পাছা যা উঁচু মাইরি! আমি চিৎকার করে বলছি,  আমি মা-বাবাকে সব বলে দেব। তখন জ্যেঠু আমাকে কষে চড় মারে আর ঠোঁট কামড়ে ধরে। আর শরীরের কাপড় সব খুলতে থাকে। এরপর জ্যেঠু তিনবার ধর্ষণ করে এবং শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলে। আমাকে ফেলে যায় আরও গভীর জঙ্গলে। সেখান থেকে আমাকে তুলে নিয়ে যায় অন্ধকার সম্রাজ্ঞী। এরপর একটু থামে ইরাবতী। তারপর একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার বলতে থাকে, একদিন মৃতদের দেশে বসে কাঁদছি। মা-বাবা, ভাই সবার কথা খুব মনে পড়ছে। ঠিক এমন সময় অন্ধকার সম্রাজ্ঞী পাঠিয়ে দেয় সাপের রক্ত, মানুষের মৃত শিশুর মগজ, আর সিংহের কলিজা। আমি খেতে চাইনি প্রথমে। তখন আমাকে কাঁটাযুক্ত মান্দার লাঠি দিয়ে প্রহার করে।

সাত. 
বর্ণনা শুনে মিথুন ডুকরে কেঁদে ওঠে। ইরাবতী অমনি মিথুনের চোখে চুমুক দিয়ে খেয়ে ফেলে সবটুকু নোনাজল। আর আনন্দে নেচে ওঠে। বলে, মিথুন, তুমি আমার জন্য কাঁদলে! আমার আর কোনও অপ্রাপ্তি নেই। ইরাবতী বলে, এভাবে চল্লিশ দিন আমাকে খাওয়ানোর পর আমাকে অন্ধকার সম্রাজ্ঞী পৃথিবীতে পাঠায় পুরুষের ওপর প্রতিশোধ নিতে। কারণ অন্ধকার সম্রাজ্ঞী এই পৃথিবী পুরুষ শূন্য করতে চায়। মিথুন জিজ্ঞেস করে, তার কেন এত ক্ষোভ পুরুষের ওপর? তোমার না হয় জ্যেঠুর ওপরে ক্ষোভ! ইরাবতী বলে, সে এক হিন্দু মেয়ে হয়েও প্রেম করে পরিবার ছেড়ে এসেছিল এক মুসলিম ছেলের হাতধরে। যখন প্রথম বাচ্চা হয় তার স্বামী কাজের মহিলার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করে। একদিন চোখের সামনে দেখতে পেয়ে একে একে সবাইকে খুন করে। স্বামীর শিস্নটি কেটে সে দাঁত দিয়ে থেতলে দেয়। তারপর নিজে আত্মহত্যা করে। এরপর অন্ধকার দেবতার তপস্যা করে হয়ে ওঠে অন্ধকার সম্রাজী। তারপর থেকে সে পুরুষের ওপরে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে। 

ইরাবতী মিথুনের হাতে একটা স্বর্ণমুদ্রার কৌটা তুলে দিয়ে বলে, মিথুন যতবার আমি একজন পুরুষকে নপুংসক করেছি, ততবারই আমার দু’ফোঁটা চোখের জল হাতের তালুতে চারিদিকে সোনালী আভা ছড়িয়ে স্বর্ণমুদ্রা হয়ে গেছে। এই স্বর্ণমুদ্রা অই নপুংসকদের শিশ্নতে ছোঁয়ালেই ওরা আবার সোমত্ত পুরুষ হয়ে উঠবে। আর এই মুদ্রাগুলো দিয়ে তুমি একটা নাচের স্কুল খুলবে। সেখানে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে তাণ্ডব নৃত্য শেখাতে পারো।

ইরাবতীর মুখমণ্ডলে হঠাৎই ভর করে ঘন কালো মেঘ।
কিছুক্ষণ চুপ থাকে দু’জনেই। তারপর ইরাবতী বলে,  মিথুন আমি আবার জন্মালে নারী হয়ে জন্মাতে চাইব আর তোমার সঙ্গে সংসার করতে চাইব। কারণ ভালোবাসার সঙ্গমের স্বাদ আমি পেলাম না। তোমার ভালোবাসার চোখের জলে আমার আত্মা অন্ধকার থেকে মুক্তি পেয়েছে। অন্ধকার সম্রাজ্ঞীও তাই বলেছিল। মিথুন, শোনো-কাঁঠালিচাঁপার গন্ধ, তোমার চিবুকে পড়ে থাকা হেয়ালি রোদ, কিংবা চৈত্রের দুপুরে আসা হঠাৎ ঠাণ্ডা হাওয়া যে-কোনওভাবেই তোমার সঙ্গে আমার বারবার দেখা হবে। এবার যাই অন্ধকার সম্রাজ্ঞী তলব করেছে। হঠাৎই মিথুন দেখতে পায় একটা আলোর রেখা দিগন্তে মিলিয়ে গেল।🦋

অঙ্কন : প্রীতি দেব

 

 

 


🍁ক বি তা / দু ই 

 

অনীশ ঘোষ

কথামালা

এক পা আগুনে এক পা জলের উপরে
এভাবেই দাঁড়িয়ে জীবন ইদানীং
একদিকে দাউ দাউ পুড়ছে সময়
অন্যদিকে ভিজে যায় অনন্ত যাপনকাহিনী
অনিশ্চিত নয় আবার ঠিক নিশ্চিতও নয় পরের স্টেশন
পথের এক পাশে জ্বলছে চিতা
অন্য পাশে গড়াচ্ছে ভরন্ত জ্যোৎস্না
পার হয়ে যাচ্ছে জীবন নিরন্তর
দোটানার মধ্যে ঘর গড়তে বেলা গড়ায় ক্রমে
হুইসল বাজিয়ে ট্রেনটি থমকে গেছে
পোড়ো মন্দিরের সামনে মুখ লুকিয়ে…

 

সঞ্জয় ভট্টাচার্য 

হামসফর-৫

[য়‍্যে জিন্দেগী কভি কভি অজনাবি সি লাগতি হ‍্যয় ]

ছোট ছোট কথাই মনে লেগে যায়
কখনও,
নীরব করে দেয় শব্দের হাতছানি।
যে হাত উষ্ণ ছিল একদা
তার ছোঁয়ায় এখন শৈত্যপ্রবাহ।

সম্পর্কের কফিনে পেরেক ঠুকতে নেই,
প্রেমের বসত এখন নেই ওইখানে।

প্রেম সরে গেলে, নির্বাসনে দিও
সমস্ত জমানো আবেগ, আর
ঝলসে যাওয়া সময়ের রঙ।

আড়ালে থেক না।

তবু
গরাদখানায় শুনি প্রেম থাকে না।

 

বর্ণশ্রী বকসী

স্নেহলতা 

দূরের আকাশ থেকে অবিরত ঝরে স্নেহলতা
অমীমাংসিত সম্পর্কের মত সুন্দর প্রচ্ছদপট
নীলকণ্ঠ হয়ে বেঁচে থাকার মানে খোঁজা-
অদৃশ্য হতে থাকা রাত্রির শেষ ট্রেন যেন জীবন
বয়ে যাওয়ার দিক চিহ্নবাহী রেখাচিত্র।

আকুল আবেদন খারিজ করার আগেই সূত্রধরা ক্যাম্পফায়ার আর বনমোরগের তন্দুর দেহ অর্থবহ
আকণ্ঠ তৃষ্ণা বুকে চেপে স্বপ্ন দেখার অভিলাষ,
ভঞ্জন শেষের ঘণ্টার ধ্বনি অনুরণিত হয় চরাচরে
এমন করেই আঁধার কেটে গিয়ে আলোর মুখ দেখা!

মর্মনিস্নাত অক্ষরেরা টুপটাপ বসে পড়ে পদ্মপাতার
সবুজ অহংকার সাক্ষী রেখে, দেহের সীমান্ত ঘিরেই
আদিবাসীদের পরবিয়া সন্ধ্যার ‘দেউসি রে’-
‘ঝিলিমিলি ঝিক্কা দেউসি রে, বাবুর ঘরে দেউসি রে’
ছোটবেলার সুরের রেশ ধরেই নতুন পথের বাঁক…

 

তানজীর সৌরভ 

মরার আগে বাঁচো

ভুবন গেটে ফটোকপির দোকান, পাশে কসমেটিকস
মাঠের ওপারে মন, এপারে দেহ; এ কেমন ডিশ!
রাস্তাগুলো করছে মিছিল
কোথায় টিকেট, কোথায় সীল?
বোঝে না পরাণ
মন কেন আনচান!

কাজল পাখি ডানা ঝাপটায়- টিস্যুর বক্স খোলো
চোখ মুছে নাও, মুখ বুজে খাও; চুমুর বাতি জ্বালো
ভাবছো বুকে, কিসের সুখে এত পিছুটান?
আর কতবার চিত্ত মশাই হবে যে হয়রান!
কৃষ্ণের বাঁশি, সিঁদুর বৃষ্টি- ধুতির কোচা তোমার
আঁচল মেলো, হাসির আলো- প্রণয় ধ্বনির কাতার।

স্বপ্নে আসে মোরাকাবা, বাস্তবে সব দাবা
কার নামাজে কে মশগুল, কার ঘরে থাকে কেবা!
তবু আসে খুশির আতর, বসে আনন্দ বাজার
নৌকা খোলো, পাল তোলো- বইছে নদীর দাঁড়
মন্দির কখন মসজিদ, মসজিদ কখন মন্দির!
প্রেমে হেরেম থাকে না, ধ্যানে মুক্তি বন্দির…

একটু দাঁড়াও, হাতটা বাড়াও
পরাণ খুলে নাচো
মনটা ওড়াও, আজকে হারাও
মরার আগে বাঁচো

 

ফরিদ ভূঁইয়া

তিরক্ষ্যাপা চোখ

তিরক্ষ্যাপা চোখ!
ওই চোখে বিঁধেছ তো, আর রক্ষা নেই…।

নিকুঞ্জকানন যার হৃদয় ঠিকুজি—
পুড়ে পুড়ে ছাই হতে তার ইচ্ছে হয়
ধুলো কালি হতে হায়! ইচ্ছেগুলো ঠিকানা বিহীন…

তিরক্ষ্যাপা ওই চোখ খুব করে টানে—
বিদ্ধ হতে ইচ্ছে হয় মুছে ফেলে যাবতীয় স্বপ্ন অনাগত;
হতে পারে সেইসব মূল্য অতি জ্যোতিষ উজ্জ্বল!

বিষমাখা তির চোখে কে তুমি শিকারি?

 

দীপান্বিতা রায় সরকার

শুশ্রূষা

বিমুর্ত এক গাছের মতোই
ওই ছায়া শুশ্রূষা দেবে, অল্প…
বাকল থেকে সরিয়ে নেবে বিবর্ণ দাগ, আর
আগুন যখন ভাঙবে নীরব, আদিম কথকতা…

শ্মশানের শ্বেত স্তবের মতন শান্তিপ্রবণ
এই গোলার্ধ ব্যাস কমিয়ে নিচ্ছে
ছোট্ট যুগে ভীষণভাবে লেপ্টে থাকা আন্তরিক মুহূর্ত
সূর্যোদয়ের বিবর্তিত গল্প বলে গেল

ওই চোখের কোনও নিষ্কৃতি নেই
ভাঙবে সব ফিরোজা অক্ষরে…
যুদ্ধ তখন শরীর থেকে অনেক দূরে

শব্দ কুঠার ভেদ করেনি আত্মকথন
তিন প্রহরের বেলা এখন কে দেখাবে

হয়ত সেও চিরকালের অপাঙক্তেয়
তার সে প্রবল প্রার্থণাতে এই জন্ম…
বিমূর্ত এই প্রকৃতিতে ও-যে ছিল অপ্রকাশ্য
তার স্থিরতা এখন থেকে গাছের মতন

 

 

মিতা নূর

কেউ ডাকবে না

অলস দুপুর আমার মুক্তির পথ খুঁজে
নিরুপায় জীবন আমার একাকীত্বে গুমরে কাঁদে,
এইযে উঠোন ভর্তি জ্বলন্ত রোদ,
বুকের চাপা কান্নার অদৃশ্য প্রাচীর।
পাশেই একটুকরো বারান্দা,
এই ইট-পাথরের রাজ্যে চাপা পড়ে আছে।
কত অভিমান, অপূর্ণ চাওয়া!
অভিযোগগুলোও চোখের নালিশে ক্ষয় হতে-হতে,
শুকনো কংক্রিটে আজ আবদ্ধ!
বুকের গভীরে একটু একটু করে
জমিয়ে রাখা কষ্ট গলো আকাশ ছুঁয়েছে,
তারই কিছু দুঃখ তোমাদের কাছে রেখে…
আজ নীরবে চলে যাচ্ছি কোনও অজানায়, একা।
জানি, অভিমান ভাঙা ছলে কেউ ডাকবে না।
আর- মিথ্যে আশা করিও না !!

 

নূর কামরুন নাহার 

আমার সুবর্ণ শস্যকণা

মৃত্যুর পর আর কি আছে?
যখন বৈশেখের প্রথম ঝড়ের মতো দৃষ্টি
ছিনিয়ে নিতে চায় বুকের আঁচল
নক্ষত্রখচিত রাত দেখে লোভি কুকুর
লাঙ্গলের ফলায় ফলাতে চায় নষ্ট ফসল।
ফুটন্ত ফুলে আসে মৌসুমের কাক
চারপাশে কা কা কা কা।
ঠুকরে ঠুকরে খেতে চায়
বাড়ন্ত বৃক্ষের ভরন্ত শরীর।

আর আমি উপুড় হয়ে কাঁদতে কাঁদতে
রক্ষা করতে চাই আমার সুবর্ণ শস্যকণা
এক মুঠো মাটি ধরে রাখি মরুর বিতানে
মৃত্তিকায় ঢেলে দেই আমার লৌহ রং রক্ত।

মৃত্যুর পর আর কি থাকবে বলো?
কেউ বলে পাপ-পুণ্য ন্যায়-অন্যায় বিচার
কেউ বলে- সহস্র হুর, অমৃতের নহর।
স্বর্গ-নরক, বেহেস্ত-দোজখ, পুর্নজন্ম-পুনরুত্থান,
চুলের মতো পুলসিরাতের পুল।

আমি তো প্রতিদিন পাড় হই লালসার নদী
কেউ বলে, দু’চোখ সমূদ্র নীল
ঠোঁট লাল ডালিমের দানা
কেউ বলে, শরীরের ভাঁজে ভাঁজে কামনা
লকলক করে আগুনের কণা
পোড়ে, বন, বনানী, নগর
পোড়ে গৃহস্তের ঘর, খড়ের গাদা,শস্যদানা
পোড়ে জমি, গুল্মলতা, হাসনাহেনা।
জ্বলে নদীজল, জ্বলে চোখের কাজল
আকাশ থেকে নেমে আসে বজ্রপাত, শিলা
চূর্ণ-বিচূর্ণ হয় সভ্যতা, শিল্পকলা।

মৃত্যুর পর কি চাই আমি,
স্বর্গ-নরক, বেহেস্ত-দোজখ!
যখন প্রতিদিন চোখের আগুন
পোড়ায় আমার জমিন, আশালতা।

আর আমি উপুড় হয়ে কাঁদতে কাঁদতে
রক্ষা করতে চাই আমার সুবর্ণ শস্যকণা
এক মুঠো মাটি ধরে রাখি মরুর বিতানে
মৃত্তিকায় ঢেলে দেই আমার লৌহ রং রক্ত।

 

 

 


🍁ব ই প ত্র

 

সুপ্রিয় চক্রবর্তী 

সময়ের দলিল, ব্যতিক্রমী কবিতা 
বাস্তব এবং পরাবাস্তবের ক্ষমতায়নকে এক অলীক বন্ধনে আবদ্ধ করা প্রায় অসম্ভব, কিন্তু পার্থজিৎ চন্দের সদ্য প্রকাশিত কবিতার বই “মেফিস্টফেলিস এবং নরসুন্দর” এই কাজ করতে সক্ষম হয়েছে। কবিতায় বেশি কথা না বলে, স্বল্প কথায় কোনো এক সময়কে তুলে ধরা সহজ কাজ নয়, এই বইটিতে বাস্তবিক সময়কে কাব্যিক আঙ্গিকে তুলে ধরেছেন পার্থজিৎ। বইটি দুটি ভাগে বিভক্ত, প্রথম অংশ ‘মেফিস্টফেলিস’ আর দ্বিতীয় অংশের নাম ‘নরসুন্দর’। প্রথম অংশের কয়েকটি কবিতায় এমন কিছু রূপক ব্যবহার করা হয়েছে যা কল্পনার অতীত, যেমন ‘হাড়’ কবিতায় তিনি লিখেছেন: ‘বনের মধ্যে স্টেশন। স্টেশনের কাছে /রোজ এসে বসে থাকে একটা হায়না /#/ শাদা পোশাকের ড্রাইভার /তার কাছে ফেলে রাখে / মাংসের ছিটে লাগা হাড়ের টুকরো /# / হায়না সেটিকে চাটে। জলে ধুয়ে রেখে দেয় / # / কোনও কোনও দিন হাড় দাঁতে তুলে বোঝে / মানুষের নয়; এ হাড় হায়নার / # / দূর বন থেকে ড্রাইভার কুড়িয়ে এনেছে ‘…

পার্থজিৎ তার বইতে একাধিক রূপকের ব্যবহার করেছেন, কেমন মুরগিওয়ালা, ফস্টাস, মেফিস্টফেলিস, ম্যাজিশিয়ানের খরগোশ, একশৃঙ্গ গন্ডার, হায়না, কালো মাছ ইত্যাদি ইত্যাদি, কখনো বা তিনি হাবাগোবা নরসুন্দরের চোখে ফুটিয়ে তুলেছেন এক ডার্ক ওয়ার্ল্ড, যেখানে বিরাজমান ‘লুকোনো ক্ষুরের হাসি।..’। বইটির দ্বিতীয় অংশের কবিতাগুলোর গঠন মূলত গদ্য-কাব্যিক-পরিকাঠামো, কিন্তু তাতে অধিকাংশ কবিতাই আমাদের বাস্তব সময়কে চেনাতে সক্ষম। যেমন তার ‘জেলি’ কবিতার একটি অংশ “খুলি উড়ে গিয়েছিল, খুলি ওড়া ছেলেটিকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স মাঝে মাঝে শহরের দিকে যায়। এক বিরাট যন্ত্রে ঠান্ডায় সংরক্ষিত আছে তার খুলি, সতর্ক ড্রাইভার, তবু রাস্তার মাঝখানে এসে পড়ে দুঃখী টোটো’র সার, ফাঁকা শালপাতা হাতে বেয়াড়া ভিখারি অথবা অ্যাম্বুলেন্স দেখে লিফট চাইবার মতো ভীষণ চালাক কেউ। তারা কেউই জানে না গাড়ির ভেতর শুয়ে আছে খুলি উড়ে যাওয়া ছেলে, প্রতিটি ব্রেকের সঙ্গে মৃদু দুলে উঠছে তার মাথার ভেতর দুর্বোধ্য জেলির সংসার। এভাবেই হয়তো ছেলেটি একদিন তার বামহাতের আঙুল নাড়াবে, দু’চোখের পাতা খুলে তাকিয়ে দেখবে হাইওয়ের পাশে নয়ানজুলিতে শালুক ফুটেছে; অথবা এও এক পৃথিবীর মতো গ্রহ…ষড়যন্ত্রময় গাছ আর মানুষের দল তাকে রোজ গাড়ি করে কবরখানার দিকে নিয়ে যায়”।কবির কবিতায় মৌলিকতা এবং রূপকল্পের ব্যবহার এতটাই বাস্তব, যে এ এক অন্য পৃথিবী বা দেশ বলে মনে হতে পারে, কিন্তু বুঝতে অসুবিধে হয় না এই রূঢ় বাস্তব, যা সত্যি এবং ব্যতিক্রমী। এখানে প্রবল পরাক্রমে ‘মেফিস্টফেলিস’ ও ‘নরসুন্দর’, দুইই বিরাজমান। 🦋

 
🍁মেফিস্টফেলিস’ ও ‘নরসুন্দর’পার্থজিৎ চন্দ।  পেনপ্রিন্টস পাবলিকেশন। কলকাতা। 

 

 

 


আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ, গল্প, কবিতা, ভ্রমণ কাহিনী, উপন্যাস, প্রবন্ধ… ই-মেল : sasrayanews@gmail.com 


 

👉ছবি : সৌমিক দাস, ইন্টারনেট।

👉গল্প, কবিতা ও অন্যান্য অলঙ্করণ : প্রীতি দেব

সাশ্রয় নিউজ, ৫৭ বি.পি. রোড। কলকাতা ৭০০০৪১, পশ্চিমববঙ্গ, ভারত।

স্থানীয় খবর পাঠান : ই-মেল : sasrayanews@gmail.com

News Desk : 9734480882

Sasraya News
Author: Sasraya News

Leave a Comment

Also Read