



সঞ্জয় সান্যাল ★ সাশ্রয় নিউজ : শুধু একটি ব্রীজ নয়, যেন আকাশ ও পাহাড়ের মাঝে টানা এক সাহসিকতার রেখা। হিমাচল প্রদেশের (Himachal Pradesh) স্পিতি উপত্যকায় (Spiti Valley) অবস্থিত চিচাম ব্রিজ (Chicham Bridge) এখন শুধু পর্যটনের নতুন কেন্দ্র নয়, প্রকৃতি আর প্রকৌশলের যুগলবন্দীর এক বিস্ময়কর নিদর্শন। চিচাম ও কিব্বার (Kibber) এই দুই পাহাড়ি গ্রামের মাঝে অবস্থিত এই ঝুলন্ত সেতুটি প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত কাজা (Kaza) শহর থেকে। তবে চিচাম ব্রীজের জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল বাস্তবিক প্রয়োজন থেকেই। আগেকার দিনে কিব্বার ও চিচাম গ্রামের বাসিন্দারা যোগাযোগের জন্য ব্যবহার করতেন একটি বিপজ্জনক গর্জ (gorge) বা খাদের উপর কাঠ ও রশির তৈরি ‘ঝুলন্ত দড়ির ঝাঁপ’। বর্ষা ও শীতে সেই ঝাঁপ হয়ে উঠত জীবনের ঝুঁকিপূর্ণ এক খেলা। সেই বিপজ্জনক পথ এখন ইতিহাস। আবার চিচাম ব্রীজের উচ্চতা শুনলে চমকে উঠবেন যে কেউ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৩,৫৯৬ ফুট বা প্রায় ৪,১৫০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই সেতুটি এশিয়ার সর্বোচ্চ ঝুলন্ত সেতু (Asia’s highest suspension bridge) হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে। এটি ১২০ মিটার দীর্ঘ ও প্রায় ১৫০ মিটার গভীর খাদ পেরিয়ে গ্রাম দু’টিকে সংযুক্ত করেছে। একসময় যেখানে ক’য়েক ঘণ্টা পায়ে হেঁটে বিপদের মুখে পড়তে হতো, সেখানে এখন মাত্র ১৫ মিনিটের যাত্রায় পৌঁছে যাওয়া যায় এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে। স্থানীয় বাসিন্দা রিগজিন (Rigzin) বললেন, “আমাদের তো জীবন বদলে গেছে। আগে কিব্বারে যেতে হলে ভাবতেই ভয় লাগত। এখন স্কুল, হাসপাতাল বা বাজার, সবই সহজে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব।” প্রকৌশলের এমন এক বিস্ময় হলেও, সেতুটি তৈরি করতে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। প্রায় এক দশকের চেষ্টা, প্রকৃতির প্রতিকূলতা, শীতের জমাট তুষার, অক্সিজেনের ঘাটতি, সব কিছু সত্ত্বেও ভারতীয় প্রকৌশলীরা এই ‘মিরাকল ব্রীজ’-এর নির্মাণে সাফল্য আনেন। ভ্রমণপ্রেমীদের জন্য এই ব্রীজ এখন হয়ে উঠেছে এক উত্তেজনার কেন্দ্র। গোটা উপত্যকা যেখানে খাড়া পাহাড়, বরফঢাকা উপত্যকা ও বিশাল নীলাকাশের স্বপ্নময় ছবি এঁকে রাখে, সেখানে চিচাম ব্রীজ যেন ছবির মতো একটি ফ্রেম, দাঁড়িয়ে থেকে কেউ চাইলে দেখতে পারেন দু’পাশে নির্জন পাহাড়, দূরে তুষারশুভ্র চূড়া, আর নিচে গভীর খাদ। ছবি তুলতে আসেন বহু মানুষ, কেউ কেউ তো শুধু এই ব্রিজ দেখার জন্যই পাড়ি দেন কষ্টসাধ্য পাহাড়ি পথ।
পর্যটক আরতি শর্মা (Aarti Sharma) বললেন, “আমি বহু ঝুলন্ত সেতু দেখেছি ইউরোপ-আমেরিকায়, কিন্তু এই ব্রিজের সৌন্দর্য আর উচ্চতার অনুভব একেবারে ভিন্ন। এক ধরণের থ্রিল আছে, আবার এক অভিজ্ঞতাও। আপনি যেন প্রকৃতির গভীরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।” চিচাম ব্রীজের পাশেই রয়েছে কিব্বার গ্রামের বিখ্যাত স্নো লেপার্ড ট্র্যাকিং জোন, এবং চিচাম হল সেই অঞ্চল যেখানে অনেক উচ্চ হিমালয়ী প্রাণীর দেখা মেলে। এই অঞ্চল এখন ধীরে ধীরে হিমাচলের এক বায়ো-ট্যুরিজম কেন্দ্র হয়ে উঠছে।
এই ব্রীজের মাহাত্ম্য শুধু পর্যটন বা দৃষ্টিনন্দন প্রকৌশলে নয়। এটি হয়ে উঠেছে এক সামাজিক সেতুবন্ধন দূরের এক উপত্যকার মানুষদের জীবনযাত্রা বদলে দিয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাজার ব্যবস্থায় এসেছে দ্রুত গতি। ছোট ছোট পাহাড়ি গ্রামের ছেলেমেয়েরা এখন স্বপ্ন দেখতে পারে আরও বড় কিছু। স্পিতি উপত্যকা অনেকেই বলেন ‘ছোট তিব্বত’, কারণ এখানকার সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস, ভাষা, এমনকী স্থাপত্যও তিব্বতের মতো। সেই ঐতিহ্যের মাঝে দাঁড়িয়ে চিচাম ব্রীজ যেন এক আধুনিক সংযোজন, যেখানে পুরনো সংস্কৃতির পাশে প্রযুক্তির নতুন আলো ছড়ায়। তুষার, পাহাড়, কল্পনার মতো নির্জনতা। আর এই সবের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা এক অসাধারণ সেতু, যা শুধু দুটি গ্রাম নয়, মানুষ আর প্রকৃতির মাঝেও তৈরি করেছে এক অভূতপূর্ব যোগসূত্র। চিচাম ব্রীজ এখন পাহাড়ের ভাষায় লেখা একটি বীরগাথা, সাহস, প্রয়াস ও স্বপ্নের এক নিরেট প্রতীক।
ছবি : সংগৃহীত
আরও পড়ুন : Manali | মানালি: পাহাড়ি রূপকথার পাতায় ছুটি কাটানোর ঠিকানা
