



মিলি ঘোষ : কেরালার (Kerala) অচেনা শহর চের্থালা (Cherthala)। যেন প্রকৃতির আঁচলে গাঁথা এক ছবি। আলাপ্পুঝা (Alappuzha) জেলার অন্তর্গত এই শহর সমুদ্র আর ব্যাকওয়াটারের মাঝখানে এক রূপকথার পথ। ঘন সবুজ পামগাছের সারি, শান্ত জলের দুই পাড়ে ছড়ানো জীবনের ছায়া। সব মিলিয়ে চের্থালা যেন ভারতের দক্ষিণের এক অনুচ্চারিত প্রেমকাব্য। চের্থালার সঙ্গে প্রথম পরিচয় সেই রাস্তাটিতে দাঁড়িয়ে। এক ফালি পিচের সরু পথ। দু’দিকে বিস্তীর্ণ ব্যাকওয়াটার। মাঝে মাঝে ধীর গতিতে ছুটে যাওয়া দু’একটি মোটরসাইকেল। মনে হয়, যেন কোনও চিত্রকর ক্যানভাসে জলরঙে আঁকছেন তার স্বপ্নের ভূগোল। বাতাসে লবণাক্ততা আর শ্যাওলার গন্ধ মিশে এক অনির্বচনীয় ঘোর তৈরি করে।

এই অঞ্চল সম্পর্কে বলতে গিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা, অনিল ভাসুদেবন (Anil Vasudevan) জানান, “চের্থালা এখনও পর্যাপ্তভাবে কমার্শিয়াল হয়নি। এখানকার ব্যাকওয়াটার আলাপ্পুঝার মতো জনাকীর্ণ নয়, এটাই এর সৌন্দর্যের বড় কারণ। প্রকৃতি এখানে আপন গতিতে বাঁচে। মানুষ প্রকৃতির সঙ্গী।” চের্থালার মূল আকর্ষণ ব্যাকওয়াটার। ছোট ছোট খাল। জলপথ। ঝুপড়িঘেরা ঘাট। মাছ ধরার নৌকা। সব মিলে এক স্বপ্নময় দৃশ্যপট। স্থানীয় মানুষেরা এই জলপথই ব্যবহার করেন যাতায়াত ও জীবিকার জন্য। বেশ কিছু নৌকা দেখা যায়, যেগুলি এখন হাউসবোট হিসেবে পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। সেই হাউসবোটে চড়ে নদীর বুক চিরে ভেসে বেড়ানোর সময় মনে হয় সময় থেমে গিয়েছে। হাউসবোট চালক মোহনলাল (Mohanlal) বলেন, “বছরের বেশির ভাগ সময়ই এখানে আবহাওয়া মনোরম। বর্ষায় চারপাশের জল বেড়ে যায়, গাছপালায় নতুন সবুজ ছায়া পড়ে। তখন এখানে প্রকৃতি যেন জেগে ওঠে।’’ মোহনলালের কথার সঙ্গে সঙ্গে চোখে পড়ে পাড়ে মাছ ধরছেন এক বৃদ্ধ, গামছা মাথায়, ঠোঁটে সিগারেট। এ-এক নিঃশব্দ জীবনযাত্রা।

চের্থালায় ঘোরার আরও এক আকর্ষণ স্থানীয় গ্রামীণ জীবন। এখানে তাড়াহুড়োর বালাই নেই। জীবন ধীরে চলে। অথচ তা ক্লান্তিকর নয়। নারকেল গাছের ডালপালা। সাদা মাটির বাড়ি। কেরালার প্রথাগত “নালুকেট্টু” বাড়ির স্থাপত্য। ছোট ছোট মন্দির। আর হিন্দু-মুসলিম-খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের সহাবস্থান। সব কিছু মিলিয়ে এক অন্যরকম সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। যদিও চের্থালা একটি ছোট শহর। তবু কাছাকাছি কিছু গুরুত্বপূর্ণ দর্শনীয় স্থান রয়েছে। যেমন পাথিরামনাল দ্বীপ (Pathiramanal Island), যেখানে কায়াকিং বা ক্যানো চড়ার ব্যবস্থা রয়েছে। আবার আলাপ্পুঝার বিখ্যাত নেহরু ট্রফ নৌকা ভ্রমণের (Nehru Trophy Boat Race) সময় চের্থালার আশেপাশের গ্রামগুলিতেও উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে।এছাড়া সমুদ্রপ্রেমীদের জন্য চের্থালা থেকে মাত্র ক’য়েক কিলোমিটার দূরেই রয়েছে মারারি বিচ (Marari Beach)। সেখানে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে মনে হতে পারে যেন আকাশ আর জল একে অপরকে আলিঙ্গন করছে।

পর্যটকদের জন্য এখানে বেশ কিছু হোমস্টে। আয়ুর্বেদিক স্পা সেন্টার এবং কেরালার স্থানীয় রান্নার আয়োজন রয়েছে। স্থানীয় রেস্তোরাঁর মালিক শ্রীমতী রিমা নারায়ণন (Rema Narayanan) বললেন, “বিদেশি পর্যটকরা আমাদের রান্নায় খুব আগ্রহ দেখান। আমরা চেষ্টা করি কেরালার স্বাদ তাঁদের উপহার দিতে।” এই ভ্রমণের শেষে চের্থালাকে মনে হয় না শুধুই একটি স্থান। বরং যেন এক অনুভব। এখানে প্রকৃতি কথা বলে, বাতাসে থাকে ঐতিহ্যের গন্ধ, আর মানুষের হাসিতে মিশে থাকে আন্তরিকতা। হয়ত এই কারণেই কেরালাকে বলা হয় ‘God’s Own Country’। আর সেই ঈশ্বরের নিজের দেশের এক নিঃশব্দ কোণায় আছে চের্থালা, তার নিজের স্বরূপে, অবলীলায়।চের্থালার রাস্তায় দাঁড়িয়ে যখন
দু’চোখে জল আর আকাশের মিলনরেখা দেখি, তখন নিজেকেও খুঁজে পাই প্রকৃতির গভীরে। এই জায়গা শুধুই ভ্রমণের নয়, এই জায়গা আত্মার শান্তির ঠিকানা।
ছবি : সংগৃহীত
আরও পড়ুন : Manali | মানালি: পাহাড়ি রূপকথার পাতায় ছুটি কাটানোর ঠিকানা
