



তনুজা বন্দ্যোপাধ্যায় : ভালবাসা কখনও কখনও এমন এক ঘোরের রূপ নেয় যা বাস্তবতাকেও অস্বীকার করে। ইতিহাসে এমন অনেক অদ্ভুত প্রেমকাহিনী রয়েছে কিন্তু কার্ল ট্যানজলারের (Carl Tanzler) প্রেম সেই তালিকায় নিঃসন্দেহে সবচেয়ে ব্যতিক্রমী ও বিভীষিকাময়। জার্মান বংশোদ্ভূত এই ব্যক্তি আমেরিকায় বসবাস করার সময় একজন তরুণীর প্রেমে পড়েন। প্রেমিকার মৃত্যু তাঁকে দমাতে পারেনি। বরং সেই মৃত্যুই ছিল কার্লের প্রেমের শুরু।এই প্রেমই পরিণত হয় এক ভয়াবহ মনস্তাত্ত্বিক জটিলতায়। ১৯৩০ সালের এই প্রেমকাহিনী আজও বিশ্বজুড়ে বিস্ময় সৃষ্টি করে।

কার্ল ট্যানজলারের জন্ম ১৮৭৭ সালে। জার্মানির ড্রেসডেন শহরে। প্রকৌশলবিদ্যা ও বায়ুশক্তি বিষয়ে কিছু প্রাথমিক শিক্ষা নেওয়ার পর পাড়ি দেন আমেরিকায়।পরবর্তীতে ‘কার্ল ভন কসেল’ নামেও পরিচিত হন। এবং ফ্লোরিডার ‘কি ওয়েস্টে’ মার্কিন নৌবাহিনীর হাসপাতালে এক্স-রে টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ শুরু করেন।

এখানেই তাঁর জীবন পাল্টে যায়। যখন ১৯৩০ সালে তাঁর সঙ্গে দেখা হয় মারিয়া ইলেনা মিলা দে ওয়োহোস (Maria Elena Milagro de Hoyos) নামের কিউবান বংশোদ্ভূত একজন তরুণীর।ইলেনা তখন মাত্র ২১ বছর বয়সী। যক্ষ্মায় আক্রান্ত ছিলেন। ট্যানজলার তখন ৫০ বছর বয়সী। তবু, প্রথম দেখাতেই ইলেনাকে (Maria Elena Milagro de Hoyos) চিনে ফেলেন নিজের বহুদিনের স্বপ্নে দেখা আদর্শ প্রেমিকা রূপে। ট্যানজলার বিশ্বাস করতেন একটি রহস্যময় “দর্শন” (বা স্বপ্নের মাধ্যমে) তাঁর সামনে ভবিষ্যৎ প্রেমিকার চেহারা প্রকাশ পেয়েছিল। ইলেনার চেহারার সঙ্গে হুবহু মিল।ট্যানজলার নিজের চিকিৎসা জ্ঞান এবং গবেষণার সবটুকু দিয়ে ইলেনার চিকিৎসা করতে শুরু করেন। হাসপাতালের সীমা ছাড়িয়ে তিনি তাঁর বাড়িতে ওষুধ, ডায়েট, রেডিয়েশন সহ যা কিছু পারতেন প্রয়োগ করতেন ইলেনার ওপর। কিন্তু ব্যর্থ হয় সব চেষ্টা। ১৯৩১ সালে ইলেনার মৃত্যু হয়। পরিবার তাঁর দেহ কবরস্থ করতে চাইলেও ট্যানজলারের উদ্যোগে তাকে কাচের তৈরি এক অলঙ্কৃত কফিনে রাখা হয়। এবং কবরের উপর নির্মাণ হয় এক সৌধ সমাধি।

এখানেই থেমে যায়নি তাঁর প্রেম। দু’বছর পর ট্যানজলার গোপনে কবর থেকে তুলে নেন ইলেনার মৃতদেহ। রাতে কবরখানা থেকে দেহ তুলে এনে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। শুরু হয় তাঁর ‘মৃত প্রেমিকার সঙ্গে বসবাস’। মরদেহ পচে যেতে শুরু করলে তিনি তার শরীরে গ্লাস আই বসান, চুল লাগান উইগ দিয়ে, ত্বকে কাপড় ও প্লাস্টার লাগিয়ে দেন যাতে রূপ অটুট থাকে। গন্ধ না ছড়াতে পারফিউম ও ডিসইনফেক্ট্যান্ট ব্যবহার করতেন। মৃতদেহকে ড্রেস পরানো হত, বিছানায় রাখা হত, তিনি মৃত প্রেমিকার সঙ্গে বসবাস করতেন। সাত বছর পর ইলেনার বোনের সন্দেহ হয়। তিনি ট্যানজলারের বাড়িতে এসে মৃতদেহ আবিষ্কার করেন এবং পুলিশে অভিযোগ করেন। ট্যানজলার গ্রেফতার হন। তাঁকে ‘কবর চুরির’ অভিযোগে আদালতে হাজির করা হয়। যদিও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে তাঁকে মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত প্রমাণিত করা হয়। মামলাটি পরে খারিজ হয়ে যায়। আরও বিস্ময়ের ব্যাপার হল, এই ঘটনা যখন জনসমক্ষে আসে তখন অনেক মানুষ ট্যানজলার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠে। তাঁরা তাঁর প্রেমের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়। যেন এটি এক নিষ্পাপ ভালবাসার নিদর্শন। মিডিয়ায় ট্যানজলারকে রোমান্টিক চরিত্র হিসেবে তুলে ধরা হয়, আর ‘ভ্যালেন্টাইনের মতো প্রেমিক’ বলে অভিহিত করা হয়। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ট্যানজলার চলে যান ফ্লোরিডার পাস্কো কাউন্টিতে। তিনি সেখানে একটি ছোট কুঁড়েঘরে থাকতেন। সেখানে গোপনে একটি মানুষের মূর্তি তৈরি করেন। সেই মূর্তিটিকে ইলেনার বিকল্প মনে করা হয়। ১৯৫২ সালে নিঃসঙ্গ অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। কার্লের মৃতদেহ পাওয়া যায় একটি কাগজে মোড়ানো নারী মূর্তির পাশে যেটি ইলেনার প্রতিকৃতি বলে সন্দেহ করা হয়।

কার্ল ট্যানজলারের কাহিনী প্রেম আর উন্মাদনার সূক্ষ্ম সীমারেখা কোথায়? এটিই বিতর্কের অন্যতম বিষয়। একদিকে তাঁর প্রেমিকসুলভ আত্মত্যাগ, অন্যদিকে সামাজিক ও নৈতিক চূড়ান্ত সীমা লঙ্ঘনের এক ভয়ঙ্কর প্রতিচ্ছবি। এই প্রেমকাহিনী মনে করিয়ে দেয়, ভালবাসা যদি ভারসাম্য হারায়, তা তখন আর প্রেম থাকে না পরিণত হয় এক ধ্বংসাত্মক বিকারে।
সমস্ত ছবি : আন্তর্জালিক
আরও পড়ুন : Ratan Tata : রতন টাটা একটি অনন্য জীবনের নীরব রূপকথা
