Sasraya News

Bengali Short Story : রোকেয়া ইসলাম-এর ছোটগল্প স্থলপদ্ম আর কাঠগোলাপ

Listen

ইংরেজি নিউ ইয়ার ২০২৪ সংখ্যা 


সাহিত্যিক রোকেয়া ইসলাম বাংলাদেশে থাকেন। দীর্ঘদিন সাহিত্যের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছেন। দুই বাংলার পাঠকদের ওঁর গল্প কথন পাঠকদের জারিয়ে রাখে। সাশ্রয় নিউজ-এর আজকের পাতায় রইল রোকেয়া ইসলাম-এর একটি ছোটগল্প। 

 

স্থলপদ্ম আর কাঠগোলাপ

রোকেয়া ইসলাম

চোখাচোখি হতেই দু’জন দুজনকে জড়িয়ে ধরে। দু’জনের পিঠেই দুজনের হাত বলে, ভালবাসি ভালবাসি।
ফরিদা আজ এসেছে আগরতলা শুধু মৃণালিনীর ম্যাসেঞ্জারে আমন্ত্রণে। দু’বছরের ফেসবুক ফ্রেন্ড ওরা।
মাত্র ছয়মাস মেয়াদের ভিসা পাসপোর্টের বুকে শুয়ে আলমারিতে ঘুমিয়ে ফুরিয়েছে তিনমাস। বাকি তিনমাসও ফুড়ুৎ করে কোন ফাঁকে উড়ে যাবে কে জানে! তাই ভিসার কার্যকরীতা ঠিক রাখার ইচ্ছে মৃণালিনীকে জানাতেই ও আমন্ত্রণ জানায় আগরতলায়। ফেসবুকের ঢালাও বন্ধুত্ব দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় মনে হয়েছে এই আমন্ত্রণটা আন্তরিক।
ট্রেনে আখাউড়া, দুইদেশের ইমিগ্রেশন পার হয়ে একেবারে শকুন্তলা মার্কেটের সাগর হোটেলে জম্পেশ ঘুম, ঘুম থেকে জেগে ওঠে কাউন্টারের ফোনে, আপনার গেস্ট নিচে অপেক্ষা করছে। কে আসবে যদিও ইমিগ্রেশন ক্রস করে ল্যাগেজ ধরে হাঁটার ভঙ্গীর একটা ছবি পোস্ট করেছে পেছনে আগরতলা ইমিগ্রেশন অফিসের গেট। ফ্রেন্ডলিস্টের কেউ আসলেও তো আসতে পারে। এমন একটা ক্ষীণ আশা বিকেলের রোদের ঝিলিক দেয়। হিসাব মেলাতে মেলাতে নিচে এসে উষ্ণতায় আলিঙ্গন। মৃণালিনী!

_____________________________________________

মৃণালিনীর বাড়ির চত্বরে ছোট্ট অথচ সুন্দর একটি বাগান আছে যা ফেসবুকে দেখেছে অনেকবার। বেশকিছু বীজ এনেছে মৃণালিনীর জন্য।
ঘোরাফেরায় ভুলে গেছে দেবার কথা।

_____________________________________________

দুইজনেই মোবাইলের মানুষটাকে দেখছে ছুঁয়ে ছুঁয়ে, যন্ত্রেরও কিছুটা অপূর্ণতা থাকে চোখ তা পূর্ণ করে।  চোখেরও কিছু নিজস্ব অধরা থাকে যন্ত্র তা ধরে বেঁধে সামনে এনে দেয়। সন্ধ্যার অচেনা শহর আগরতলা দেখছে ফরিদা চেনা শহরের অতি চেনা মৃণালিনীর চোখ, গ্রহণ করছে নিজস্ব বোধে।
তোমার তো ঠিকঠাক লাঞ্চ হয়নি।
ও যা হবার হয়েছে এবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাও তো তোমার শহর। তিন-চারদিনে তামা তামা করে দেবক্ষণ, আর্লি ডিনার না হলেও চা তো চলবে চল।
স্মাট বাজারের বিপরীতে দোতলার একটা বাহারি কফি শপে বসে ওরা। নিচে প্রবহমান শহর। ধুমায়িত কফির পেয়ালা দু’জনের সামনে স্ন্যাক্সের প্লেট আগেই খালি হয়েছ। কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়া আর জারুল শোভিত
চওড়া মসৃণ পথ ছিমছাম শান্ত শহর। তিনতলার চেয়ে উঁচু বাড়িঘর চোখে পড়ল না, রাস্তায় প্রাইভেট কার নেই বললেই চলে।
ত্রিপুরা রাজ্যটিকে তিনদিক থেকে বাংলাদেশ সৌহার্দ্য সম্প্রীতি ও বন্ধুত্বে জড়িয়ে রেখেছে।
ত্রিপুরা বাংলাদেশের সীমান্তজুড়ে চলছ সড়ক ও রেলপথ সংযোগের বিশাল কর্মযজ্ঞ। বৃহৎ ভারতের সুদৃষ্টিহীন রাজ্য বলেই মনে হল ফরিদার কাছে। জনসংখ্যা ৫০ লাখেরও কম। অর্থনৈতিক অবস্থা কিছুটা পশ্চাৎপদ হলেও মানুষগুলো সং সরল সুখী এবং সংস্কৃতিবান। আগরতলা হল ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী। আগর গাছ থেকেই স্থানের নামকরণ হয়েছে। রাজ্যের মর্যাদা পাবার পর নগরায়নের ফলে দিনে দিনে আগর গাছের সংখ্যা কমে গেছে।
১৫ অক্টোবর ১০৪৯ সালে ভারতের অধিরাজ্যে যোগ হয় ত্রিপুরা। হাওড়া নদীর তীরে মনোরম একটি জায়গা। পাহাড় কেটে সমতল করলেও এখনও শহরে পাহাড়ি ছাপ রয়ে গেছে। ইমিগ্রেশন পার হবার পর থেকেই বাংলা শুনবে এমনটা প্রত্যাশা ছিলই তবে সিলেটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া কুমিল্লা কিশোরগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষা ক্রমাগত ওর কানে এমন মায়া আর মধুর সংমিশ্রণ ঢালছে তাতে শহরটা ভালবাসার ক্ষেত্র হয়ে যায়।
ত্রিপুরার রাজ ভাষা ছিল বাংলা। দু’জনের আলোচনায় উঠে আসছে প্রাচীন ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধ।মৃণালিনী মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনতে আগ্রহী, সে তো হতেই পারে মুক্তিযুদ্ধে আগরতলার ভূমিকা অনস্বীকার্য। ফরিদা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছে, ওর পরিবারে ক’য়েকজন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। কফি আর স্ন্যক্স কখন হজম হয়ে গেছে। একটু রাত হতেই দু’জনে একেবারে ডিনার সেরে ফেরে।

আরও পড়ুন : ডানলপ থেকে শুরু নাম রথযাত্রা

সকালে একেবারে ফ্রেশ হয়ে লবীতে আসতেই দেখে মৃণালিনী বসে আছে। তিন চারটে দিন পুরো ত্রিপুরা ঘুরে ফিরে দেখে ফরিদা, মৃণালিনী এই ক’য়টি দিন পুরোপুরি ওকে দিয়ে দিল। মৃণালিনী বিকেলে আসবে ওকে নিতে ওদের বাড়িতে।
বাংলাদেশ থেকে অল্প কিছু উপহার নিয়ে গিয়েছে দেওয়া হয়নি। মৃণালিনী অনেক কথা বলেছে, অনেক শুনেছে তবুও বক্ষ উজার করে জানানো হয়নি দু’জনের একান্ত কথা। একবারও ওর বাড়িতে ডাকেনি, ফরিদা উপহারের কথা বলতেই কিছুটা দ্বিধা নিয়ে রাতে খেতে ডেকেছে। মৃণালিনীর বাড়ির চত্বরে ছোট্ট অথচ সুন্দর একটি বাগান আছে যা ফেসবুকে দেখেছে অনেকবার। বেশকিছু বীজ এনেছে মৃণালিনীর জন্য।
ঘোরাফেরায় ভুলে গেছে দেবার কথা।
বসার ঘরের পর্দা সরিয়ে যিনি ঘরে ঢুকলো বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে ফরিদা! দু’জনের বয়েসী অবয়ব থেকে আবরণ খসে পড়ছিল একেকটি করে বছর, কম করে চল্লিশটি বছর তো ঝরে পড়ল! কে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বিস্ময়ে অভিভূত! মুখোমুখি দু’জন কে? মৃণালিনীর ফেসবুকে ওঁদের দেখেছে চেহারাটা চেনা মনে হলেও এমন গভীরভাবে দেখেনি ব্যস্ত ফরিদা।

______________________________________________

ব্যাগ খুলে দেখে ক’য়েকটি ফুলের বীজ ওর ব্যাগে রয়ে গেছে। সৌমিত্রের হাতে ছোট্ট ছোট্ট প্যাকেটগুলো তুলে দেয়। মৃণালিনীর বাগানের ছবি ফেসবুকে দেখেছে বীজগুলো দিতেই এনেছিল, গতকাল রাতে আকষ্মিক  ঘটনায় আর দেওয়া হয়নি।

______________________________________________

আজ ওর সামনে কে দাঁড়ালো! মৃণালিনীর স্বামী,  সৌমিত্র রায়।
কি গো এমন হা হয়ে গেলে যে দু’জন, আরে তোমরা একই দেশের গো।
একই শহরেরও।
সামলে নেয় ফরিদা। শুক্ত মুইঠ্ঠা, টক ডাল, লাবড়া দই চিকেনে ভুড়ি ভোজনে রাত গভীর করে হোটেলে ফেরে। ল্যাগেজ গোছানই ছিল, তবুও আরেকবার দেখে শুয়ে পড়ে। আজ ওর ঘুম আসবে না জেনেও একটা ঘুমের ঔষধ খায়।
সকালে জলখাবারের সঙ্গে কড়া দু’কাপ চায়েও রাতে আধোঘুমো আধোঘুমো ম্যাজম্যাজে ক্লান্তি কাটে না।
শরীরকে খুব একটা পাত্তা দেয় না। অটো নিয়ে টার্মিনালে চলে আসে। ল্যাগেজ তুলে ট্যগ নম্বর ব্যাগে রাখতে রাখতে মগজে রিডিং রাখে। কাগজপত্র হারিয়ে ফেলা স্বভাব ওর।
একটু আগেই কি এসে পড়েছে ফরিদা! তা হোক শেষ মুহূর্তে হুড়োহুড়ি করে এটা ফেলে ওটা রেখে আসার মানুষ ও-নয়, চিরকালই ধীরে সুস্থে কাজ করে।
খোলা চত্বরে দাঁড়ায়, টার্মিনালের বাইরে একটা গাছের মাথায় আগুন লাগিয়ে ফুটে আছে কৃষ্ণচূড়া। রাত থেকে অপ্রকাশিত কথাগুলো চেপে আছে মাথায়, বুকের ভেতরটা থম মেরে আছে।
কেন এমন করলো সৌমিত্রদা? কেন তার প্রিয় শহর প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে হারিয়ে গেল। কত খুঁজেছে সৌমিত্রদাকে। আগরতলায় না এল তো চিরহারানোর দলেই থাকত!

গতকাল রাতে মৃণালিনী যতই অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত থাকুক দু’জনের আচরণে কিছুই কি বোঝেনি। শুধু ভদ্রতা করে চুপ রইল। ওদের নির্ভেজাল বন্ধুত্বে অদৃশ্য ছেঁড়া দাগ তো আঁকা হয়ে গেল। খোলা চত্বরে এক কোণায় একটা গাছের তলায় দাঁড়িয়েছিল ফরিদা। ওর খুব কাছে এসে একটা অটো থেকে নামে সৌমিত্র।
হঠাৎ ফরিদার এতদিনের অবরুদ্ধ অভিমান কান্না,  বেদনা, দু’চোখ দিয়ে বের হতে চায়। চিরকালের শক্ত মেরুদণ্ডের ফরিদা অপেক্ষা করে সৌমিত্রের মুখ খোলার! এতটা পথ যখন ছুটে এসেছে সেটা তো আর ফরিদাকে দেখার জন্য নয়। এত বছর পরও নিষ্ফল অভিমানে বুক ভরে ওঠে।
তোমার নিশ্চয়ই আমাকে কিছু বলার আছে।
না কিছুই বলার নেই, শুধু শোনার আছে। বাস ছেড়ে দেবে তাড়াতাড়ি বললে ভাল হয়, সৌমিদা।
ডাকটা এখনও মনে রেখেছিস।
অনেককিছুই ভুলিনি, সৌমিদা! বলতে গিয়ে আঁটকে রাখলো শব্দগুলো।
বলে এলে কি হতো।
জানিস না তুই, দেবলীনাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল ওর বাবা। শুধু আমি গরীব এই অপরাধে। মা মারা গেল, ভাইরা আলাদা হয়ে গেল কেউ কেউ চলেও গেল, কেউ ছিল না আমার পাশে। ভালবাসা ছিল না অর্থ ছিল না! দেবলীনাদিও কিন্তু ফিরে এসেছিল, ততদিনে তুমি তো হাওয়া তোমার শহর থেকে, তোমার গানের স্কুল থেকে। কেন তুমি ধৈর্য ধরলে না, সৌমিদা।
রাতের পর রাত আমার ঘুম হত না। দিনের পর দিন স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী কমতে লাগল। অনিশ্চয়তা আমার চারপাশ জুড়ে জাল ফেলছিলরে।
আমি ছিলাম। আমরা ছিলাম তোমার পাশে সৌমিত্র দা। তুমি ভরসা করতে পারনি আমাদের উপর, আমার বন্ধুদের উপর। অথচ আমরা আমাদের সবটুকু নিয়েই তোমার পাশে ছিলাম।
শহর জুড়ে তোমার গান ছিল সৌমিদা।
সৌমিত্র কিছু বলে না শুধু বয়েসী চোখ জোড়া অভিজ্ঞতা অভিমানের জলে ভরে থাকে, গড়িয়ে পড়ে না। শ্যামলী বাস থেকে ডাক আসে, চলতে শুরু করে ফরিদা।
একটু এগিয়ে আসে সৌমিত্র
নে এ-দুটো তোর জন্য এনেছি।
দু’টো কাঠগোলাপের ডাল তুলে দেয় ফরিদার হাতে। ব্যাগ খুলে দেখে ক’য়েকটি ফুলের বীজ ওর ব্যাগে রয়ে গেছে। সৌমিত্রের হাতে ছোট্ট ছোট্ট প্যাকেটগুলো তুলে দেয়। মৃণালিনীর বাগানের ছবি ফেসবুকে দেখেছে বীজগুলো দিতেই এনেছিল, গতকাল রাতে আকষ্মিক  ঘটনায় আর দেওয়া হয়নি।
তোর দেশে থাকুক আমার দেশের ফুল আমার দেশে থাকুক তোর দেশের ফুল। মৈত্রী হয়ে সম্প্রীতি হয়ে ওরাই সুবাস ছড়াক। মৃণালিনী আর আমি। মৃণালিনী তো আমার চেয়েও বেশি প্রিয় তোর কাছে। প্রিয় শব্দটার উচ্চরণে কি যেন আছে যা এতদিন তাড়িয়ে ফিরত ফরিদাকে। বাসে বসে নিচে দাঁড়িয়ে থাকা সৌমিত্রের দিকে তাকায় ফরিদা। রুমালে চোখ মুছছে চশমার কাঁচ মুচছে।

সৌমিদা,
ফরিদার চোখে তাকায় সৌমিত্র।
সৌমিত্রের চোখ জোড়া ভিজে লাল জবা হয়ে আছে।
কত কথা বলছে সৌমিত্রের চোখ। বাস চলতে শুরু করে…

অঙ্কন : প্রীতি দেব


 [সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ, গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, ভ্রমণ কাহিনী, উপন্যাস… ই-মেল : sasrayanews@gmail.com ]

Sasraya News
Author: Sasraya News

Leave a Comment