



ইংরেজি নিউ ইয়ার ২০২৩ সংখ্যা
নাহিদ হাসান রবিন বাংলাদেশে থাকেন। সাম্প্রতিক সময়ের পটভূমিতে প্রচুর ছোটগল্প লেখেন বাংলা ভাষার এই লেখক। ওঁর গল্পের টানে বিভোর হন পাঠকরা। সাশ্রয় নিউজ-এর আজকের পাতায় রইল লেখকের একটি ছোটগল্প।
নষ্ট হতে হতে
নাহিদ হাসান রবিন
নব্বই দশকের শুরুর দিকের কথা। একজন যুবকের কাছে একটা বাইসাইকেল বা ক্যামেরা থাকা মানে হল, সেই এলাকার তরুণ সমাজের রাজা। আর যদি কোনও তরুণের থাকে একটা মোটর সাইকেল; তাকে তো মহারাজাই বলা চলে। তাহলে শুনুন এমন একজন মহারাজার গল্প।
আমি তখন কলেজে পড়ি। বাড়ি থেকে উপজেলা শহরের দূরত্ব দশ কিলোমিটার। এলাকার রাস্তাঘাটে তখন উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। খানিক পথ পায়ে হেঁটে, খানিকটা বাসে আর খানিকটা রিক্সায় করে কলেজে যেতে হত। এর মধ্যে আবার দু-একটা খেয়াও পার হতে হত। দিনের অনেকটা সময় রাস্তায় কেটে যেত। আর যদি বন্যার মৌসুম হয়, তবে তো দিনই শেষ। এ কারণে তখন উপজেলা শহরগুলোতে ব্যাপকভাবে ছাত্রাবাসের প্রচলন ছিল। আর এই ছাত্রাবাসগুলো ছিল আড্ডার মহারাজ্য। আমি বেচারা মহারাজা হয়েও ছাত্রাবাস নামক মহারাজ্যের স্বাদ পুরোপুরি নিতে পারি নাই। একবারে ডানপেটা হওয়ার কারণে, বাড়ি থেকে একটা মোটরসাইকেল জোগাড় করে নিয়েছিলাম। তাই বাড়ি থেকে কলেজ করার জন্য ছাত্রাবাসের আড্ডাগুলো পুরোপুরি নিতে পারি নাই। তবে সেখানকার আড্ডার কোনও পর্ব থেকে একেবারে বাদও পড়িনি। কলেজ শেষ করে বা প্রাইভেট পড়ার উছিলায়, কখনো কলেজ ফাঁকি দিয়ে বন্ধুদের ছাত্রাবাসে গিয়ে তাদের সাথে আড্ডায় সামিল হতাম। তাস খেলা ছিল তখন ছাত্রাবাসের প্রধান আড্ডা। দু-চারজন নিয়মিত সিগারেট টানতো। কয়েকজন আবার সিগারেটের তামাক বের করে তার সাথে গাঁজা মিশিয়ে টানতো। প্রথম দিকে এসব এড়িয়ে গেলেও, পরবর্তীতে দু-এক টান দেয়া হত। তবে, কোনও নেশা হয়নি আমার। নেশাটা ধরেছিল আরও পরে।
সেই সময় সিনেমা দেখা ছিল তরুণদের আরেক নেশা। একেতো সিনেমা হলের মালিকের ছোট ভাইয়ের বন্ধু, তার উপর ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত থাকায়, সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখতে আমাদের কয়েকজনের টাকা লাগত না। এমনকি সঙ্গে দু-একজনকে ফ্রী নিয়ে যেতে পারতাম।
______________________________________________
মৃত্যুর হাত থেকে আমি বাঁচার কোনও চেষ্টাও করতে পারছি না। আমার শরীরে কোনও শক্তি নেই। ছাত্রাবাসে গিয়ে আমি আর কারও সঙ্গে কোন কথা বলিনি। সোজা একটা বেডে শুয়ে পড়েছিলাম। প্যান্ট-সার্ট বদলানো তো দূরের কথা। পায়ের জুতাটাও খোলা হয়েছিল বলে মনে হচ্ছে না।
______________________________________________
সিনেমা হলের সামনে ফুটপাতের চায়ের দোকানে আড্ডা দিতাম প্রায়ই। তখন এসব করতেই ভালো লাগত। এসময় বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে, আবার কিছুটা নিজের ইচ্ছায় মাঝে মাঝেই সিগারেটে ভরা গাঁজায় টান দিতাম। মানুষ কোনও ভালো কাজে আগ্রহী না হলেও, মন্দ কাজের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। আমার বেলাতেও তাই হয়েছিল। কেমন একটা হালকা ঘোরের মধ্যে থাকতাম। ভালো লাগত। একদিন ঘটে গেল এক অন্যরকম ঘটনা। প্রতিদিন বিকেলে হলের ছাদে আড্ডা দিতাম কয়েক বন্ধু। গাঁজা টানা তখন প্রাত্যহিকের মতোই বলা চলে। প্রতিদিনের চেয়ে আজকের গাঁজাটা কেমন যেন আলাদা। দু’টান দিতেই কাঁশি উঠল। অনেক সময় পার হলেও কাঁশি আর থামেই না। এ অবস্থাতেই আরো দু টান নিলাম। কেমন যেন ঢেকুর উঠল। কাঁশির মাত্রাটাও বেড়ে গেল। চোখ দুটো লাল হয়ে উঠল। মাথাটা ঝিমিঝিম লাগতে শুরু করলো। ছাদ থেকে নেমে নিচে চায়ের দোকানে এলাম। একটা দুধ চা খেয়ে নিলাম। কিন্তু এখনও কাঁশি হচ্ছে বার বার। কপালের দুইপাশ কেমন টেনে আসছে। কপালে হাত দিয়ে দেখলাম, ঘেমে গেছে। কারো কোন কথাতে মনোযোগ দিতে পারছি না। তাদের কথা শুনছি, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ভুলে যাচ্ছি। শরীরের শক্তি কমে আসছে। আমি বুঝতে পারছি আমি এখন নেশায় ভোঁ। আমার সঙ্গে যারা আছে, তারা আমাকে নিয়ে কিছুটা ঠাট্টা করছে, এটাও বুঝতে পারছি। আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। মনে হচ্ছে একটু বসলে ভালো লাগবে। চায়ের দোকানের বেঞ্চগুলো ফাঁকা নেই। অন্যদিকে, আমাকে যে নেশায় ধরেছে, একথা বন্ধুদের বলতেও সংকোচবোধ করছি। একটা সিট খালি হলে সুযোগ বুঝে বসে পড়লাম। মামুন দোকান থেকে দুটো বাংলা ফাইভ সিগারেট নিয়ে একটি নিজে জ্বালালো, অন্যটি আমাকে দিল। নিজেকে ওদের সামনে মাতাল বলে ধরা না দেয়ার জন্য সিগারেটটি জ্বালালাম। কিন্তু সিগারেটে টান দিয়ে কোন মজা পাচ্ছি না। গলার ভেতর কেমন জ্বালা পোড়া অনুভব করলাম। সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে খানিকক্ষণ বসে থাকলাম। তবে আমার মনোযোগ স্বাভাবিক নয়।
খানিক পরে সবাই নদীর ধারে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হল। আমি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। এর মধ্যে কত সময় চলে গেছে বুঝতে পারি নাই। আমি দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট অনুভব করলাম খুব। যখন খুব বেশি অস্বস্তি অনুভব করলাম, তখন অগত্যা চায়ের দোকানের বারান্দার বাঁশের খুঁটি ধরে দাঁড়ালাম। আমার সামনে দিয়ে শত শত লোকজন চলাচল করছে। সিনেমা হলের সামনের বড় বড় বাল্বের তীব্র আলোতেও সামনের লোকজনগুলোকে আবছা মনে হচ্ছে। ব্যস্ত শহরের কোলাহল বা সিনেমা হলের মাইকের তীব্র আওয়াজও আমার কানে আসছে না। কেমন বধির লাগছে। সহপাঠিরা একে অন্যের সঙ্গে কথা বলছে। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে। এভাবে কতটা সময় দাঁড়িয়ে ছিলাম বলতে পারি না। লোকজনের চেঁচামেচি কানে এলো। হালকাভাবে কানে এলো, কেউ একজন বলল- মনে হয় মৃগী রোগ আছে। চামড়ার জুতা নাকে ধরে শোকাও, সেরে যাবে। আমি ঘোরের মধ্যেও বুঝতে পারলাম দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কখন বুঝি মাটিতে পড়ে গেছি। লোকজনের কথা উড়ে দিয়ে বন্ধু মামুন আর মিন্টু আমাকে হাত ধরে উঠিয়ে সবাইকে বলল, জ্বর আছে একটু, তাই এভাবে পড়ে গেছে।
আরও পড়ুন : Ira Khan Wedding : বিয়ে করলেন ইরা খান
ওরা আমাকে রিক্সায় নিয়ে একটি ছাত্রাবাসে নিয়ে গেল। যাওয়ার সময় হোটেল থেকে একটু টক নিয়ে আমাকে খাইয়ে দিল। রিক্সায় যাওয়ার সময় আমার মনে হল, আমাকে নিয়ে রিক্সাটা কোনও গহীন খাদের দিকে যাচ্ছে। আকাশটাও কেমন ধীরে ধীরে আমার মাথার কাছে চলে আসছে। মৃত্যু বুঝি আমাকে তাড়া করছে। বুকের ভেতরটায় প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করলাম। মনে হচ্ছিল মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছি আমি। কিন্তু মৃত্যুর হাত থেকে আমি বাঁচার কোনও চেষ্টাও করতে পারছি না। আমার শরীরে কোনও শক্তি নেই। ছাত্রাবাসে গিয়ে আমি আর কারও সঙ্গে কোন কথা বলিনি। সোজা একটা বেডে শুয়ে পড়েছিলাম। প্যান্ট-সার্ট বদলানো তো দূরের কথা। পায়ের জুতাটাও খোলা হয়েছিল বলে মনে হচ্ছে না। শুধু এটুকু মনে আছে, সুশান্তদের ছাত্রাবাস ছিল ওটা। তারপর আর কিছু মনে নেই আমার। কখন যে ঘুমের অতল সাগরে ডুবে গেছি…
ঘুম ভাঙলে দেখলাম, আমার চারপাশে অনেকগুলো বেড। কিছুক্ষণ চোখদুটো মিটমিট করে ডান হাতের তালুতে চোখদুটো কচলিয়ে নিলাম। হ্যাঁ অনেকগুলো বেড, বেডগুলিতে সাদা চাদর বিছানো। বিভিন্ন বয়সের মানুষ এসব বেডে শোয়া-বসা। আমার পাশে সুশান্ত ছাড়া আর কাউকেই চিনছি না। সহপাঠিদের সবাই হয়ত সুশান্তর কাছে আমাকে রেখে চলে গেছে। চলে যাওয়ারই কথা। যত্ন করে নেশা খাইয়ে মাতাল করেছে, আবার সেই মাতালকে পাহারা দেয়া তো তাদের কাজ নয়। হাতের তালুতে চোখ দুটো আবারও একটু কচলিয়ে নিয়ে দেখলাম, এটা আসলেই ছাত্রাবাস না। বেডের সাথে স্ট্যাণ্ডে ঝুলানো স্যালাইনের পট। আমার বাম হাতে স্যালাইনের সূচ ঢুকানো। খানিকক্ষণ দম ধরে থেকে হাতের ঘড়িটার দিকে তাকালাম। কালো রঙের ক্যাসিও ঘড়িটার স্ক্রীণে ভেসে ওঠা তারিখ বলে দিল, মাঝখানে একদিন পার হয়ে গেছে। ঘুম জাগা লাল চোখে সুশান্ত আমার দিকে তাকিয়ে কাছে এলো। জড়িয়ে ধরে কান্নাভরা কণ্ঠে বলল, আর কখনও এসব করিস না। মুহূর্তে চলে গেলাম আমার আগের দিনগুলোতে। কত সুন্দর ছিল সেই দিনগুলো। নিজের প্রতি ভীষণ ঘৃণা হল। নষ্ট হতে হতে…
অলঙ্করণ : প্রীতি দেব
[ সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ, গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, ভ্রমণ কাহিনী…। ই-মেল : sasrayanews@gmail.com ]
