Sasraya News

Bengali Short Story : ঝুমকি বসু-এর ছোটগল্প ‘টেডি বিয়ার’

Listen

ইংরেজি নিউ ইয়ার ২০২৪ সংখ্যা 


ঝুমকি বসু-এর লেখন শৈলীতে নিজস্ব আছে। আর সেটিতে ভর করেই এই লেখক পাঠকদের সঙ্গে জুড়ে জুড়ে যান। এবং পাঠক লেখকের গল্পে কখন নিজেকেই মেলে দেন! বাংলাদেশে বসবাসকারী ঝুমকি তাঁর গল্পের ভেতর দিয়ে কথা বলেন অনেকের। সাশ্রয় নিউজ-এর আজকের পাতায় রইল তাঁর একটি গল্প। 

 

টেডি বিয়ার

ঝুমকি বসু
এক.
নিশ তলা অফিসের পরিপাটি পরিবেশে বসে মাটির গভীরতা খোঁজা নিতান্তই বোকামি, নিজেকে প্রবোধ দেয় অভিক। যান্ত্রিক শহরের চাকচিক্যের মোড়কে জীবন এখন বন্দী, শেষ কবে সবুজ ঘাসে নিরাভরণ পা পড়েছে, মনেই পড়ে না। ত্রিশ বছর আগের দুরন্ত শৈশবের সঙ্গে ডিজ়িটাল শৈশব ছিটেফোঁটাও মিলবে না, তা খুবই স্বাভাবিক। গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্ধার দিনগুলোতে এখন রাক্ষসী থাবা বসিয়েছে ভিডিও গেম। শিশুদের মন-মগজ খুটে-খুটে খেয়ে যাচ্ছে ঘুনপোকা। অভিকের মনে পড়ে, বাবার কাছে একবার খুব বায়না ধরেছিল একটা ফুটবল কিনে দেওয়ার জন্য। বাবা বলেছিলেন ‘শুধু ফুটবল নিয়ে লাথালাথি করলেই তো হবে না, পায়ের জোর থাকতে হবে, ফুটবল খেলার নিয়ম জানতে হবে। একটা জিনিস শুধু দেখেই কেনার জন্য বায়না করলে তো হবে না, সেই জিনিসের সঠিক ব্যবহার আগে শিখতে হবে।‘ এই একই কথা অভিকও বলেছিল তার ছয় বছরের শিশুকন্যা অলিভাকে। সঙ্গে সঙ্গেই ওর মা কেয়ার কথার তোড়ে টেকাই দায় হল তার।
একটা সফট টয়ের জন্য এইটুকু মেয়েকে এত কথা শোনাচ্ছ অভিক? ত্রিশ বছর আগের দিন কি এখন আছে?
আসলেই ত্রিশ বছর তো কম সময় নয়। অথচ চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে অভিক, সাদামাটা এক রঙিন শৈশব! গ্রামের নাম অযোধ্যা, নামটি আটত্রিশ বছর ধরে অভিক যার কাছেই বলেছে সেই জানতে চায়, এটা কি রামচন্দ্রের অযোধ্যা? এই অযোধ্যা রামের না হলেও, এরও একটা ইতিহাস আছে। বিস্ময়কর এক মঠ, যেটাকে সবাই ‘অযোধ্যার মঠ’ নামে চেনে, তা এই গ্রামকে দিয়েছে দেশজুড়ে পরিচিতি। অভিক যখন স্কুলে পড়ত, তখন অনেক ভিনদেশী পর্যটককে সেই সময়েও এই গ্রামে আসতে দেখেছে। তারা এলেই কিশোর বয়সী ছেলেরা সব পিছু পিছু ছুটত, যেন মঙ্গল গ্রহ থেকে কিছু এলিয়েনের পা পড়েছে এই গ্রামে। সেই উৎসুক যাত্রায় অভিক কখনোই সঙ্গী হয়নি, সার্কাসের জোকার দেখার মতো একদল নিরীহ মানুষকে বিব্রত করে তাদের পেছন পেছন সিটি বাজাতে বাজাতে চলা, এ বড় অন্যায়, ছোট হলেও এই বোধ তার টনটনে ছিল। সেই সময় মঠ নিয়ে পুরো এলাকা জুড়ে লোক্মুখে নানা কাহিনি প্রচলিত ছিল, মঠের ছাদের চাড়িতে গজার মাছ আছে, মঠের মধ্যে ভূত-প্রেতের বাসা, গা কাটা দেওয়া এসব গল্প শুনে শুনে বড় হয়েছে অভিক। বুঝতে শেখার পর জেনেছে বারো ভুঁইয়ার অন্যতম রাজা প্রতাপাদিত্য তার গুরু অবিলম্ব সরস্বতীর স্মতিস্তম্ভ হিসাবে মঠটি নির্মান করেন। রাজা প্রতাপাদ্যিতের শাসনমাল থেকেও জানা যায়, সে সময় সমগ্র বাগেরহাট প্রতাপাদিত্যের শাসনাধীন ছিল। মঠের সামনের ঘাসের বিছানায় পা ফেলে শীতের শিশির ছোয়ার সেই অনুভুতি এখনও অভিককে শিহরিত করে। স্কুলের মাঠে দল বেধে হা ডু ডু, গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্দা খেলার সেই শৈশব আজকাল ঢাকা শহরে বড্ড বেমানান। অযোধ্যা গ্রামে পাখির ডাকে ভোর হত, অথচ অলিভা এখনও জানে না ভোর কি জিনিস!
____________________________________________

কেয়ার কান্নার দমক, তীব্র ভয়ের সঙ্গে আর যা ঘটে গেল সেই পরিস্থিতির জন্য অভিক মোটেই প্রস্তুত ছিল না। ব্লিডিং শুরু হল কেয়ার। সকাল তখন সাতটা, ডোরবেল বাজছে, নাস্তা বানানোর জন্য বোধহয় রহিমা খালা এসেছে।

____________________________________________

স্মৃতি আজ খুব জ্বালাতন শুরু করেছে, রাজ্যের নস্টালজিয়া এসে ভর করেছে অভিকের মনে। অফিস থেকেই এসব ভাবনার বীজ় অঙ্কুরোদগম হয়ে, এখন বাসায় ফেরার পথে এসি গাড়িতেও তার ডালপালা ছড়িয়েছে। একটা ভালো দোকান পেলে টেডি বিয়ার কিনেই নেবে অভিক আজ, কেয়াকে বেশি ঘাটিয়ে লাভ নেই। আড়াই মাসের ভ্রুন বহন করছে সে, মেজাজ অকারণেই খিটখিটে থাকে, ডাক্তার বলেছেন এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, গর্ভবতীদের নয় মাসে এমন অনেক অস্বাভাবিকতা দেখা যায়, যা তাদের জন্য নিতান্তই স্বাভাবিক। অলিভা জন্মানোর সময় অবশ্য কেয়ার এমন মুড সুয়িং হতো না, তখনকার আচরণ ছিল আরও অদ্ভূত, ছাদ অথবা ব্যালকনির টব থেকে খুচিয়ে খুচিয়ে মাটি তুলে খেয়ে ফেলত কেয়া। অভিক প্রথম যেদিন দেখল, রীতিমতো ভয় পেয়ে গিয়েছিল, ভেবেছিল কেয়া মানসিক সমস্যায় ভুগছে। অভিককে অবাক করে দিয়ে সে বেলায়ও ডাক্তারের জবাব ছিল এমন নাকি অনেকেরই হয়।
আজ যদি টেডি বিয়ারটা না কিনে নিয়ে যায়, এটা নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করবে অলিভা, আর কেয়ার মেজাজ খারাপ হতে থাকবে। আজ তাই যাওয়ার পথেই কিনতে হবে এটা। অলিভার যে টেডি বিয়ার নেই, তা নয়। প্রত্যেক জন্মদিনে এই তুলতুলে উপহার কম পায়নি সে, কিন্তু কোনওটার রঙ লাল নয়, তাই বায়না লাল রঙের টেডি বিয়ার লাগবে তার।
নামী দোকানের লাল রঙের টেডি বিয়ার নিয়েই বাসায় উপস্থিত হল অভিক। দেখে অলিভার উচ্ছ্বাসের সীমা রইলো না। ঘুমানোর সময় এবার তার নতুন বায়না, একে পাশে নিয়ে রাতে ঘুমাবে সে।
-কেন এমন বায়না করছো মা? মায়ের শরীর ভালো না, তার মধ্যে আবার বিছানায় এটা না নিয়ে ঘুমালে হয় না?
-না বাবা, আমি আজ ওকে পাশে নিয়েই ঘুমাবো, না হলে সারা রাত জেগে থাকবো।
-আচ্ছা, ঘুমাক না একদিন। কাল আর বলবে না দেখো, প্রথম দিন বলেই শখ হয়েছে।
-ঠিক আছে, ঘুমাক।
হার মেনে নিল অভিক। এমনিতেও বিবাদ এড়িয়ে চলাই স্বভাব তার, তাছাড়া মা-মেয়ের কথার তোড়ে পাত্তাও পাবে না তার অনুযোগ, তাই হাল ছেড়ে দেয় সে। মেয়েকে ঘুম পাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই ঘুম এসে যায় কেয়ার, প্রেগন্যান্সির প্রথম দিকে ঘুমও নাকি খুব বেড়ে যায়, আর শেষ দিকে নিদ্রাদেবী কেন জানি বেপরোয়া থাকেন, চোখে ঘুম আনতেই চান না। অভিকেরও বিছানায় দেহ এলাতেই ঘুম এসে যায়, সারাদিন অফিসের ধকলে কাটে, এছাড়া শহুরে মানুষদের রাত জাগার এই অভ্যাস এত বছরেও আয়ত্ত করা হয়নি তার। মাঝ রাতে অলিভার তীব্র চিৎকার আর কান্নায় ঘুম ভেঙে যায় কেয়া-অভিকের।
ওকে সরাও বাবা, ওকে সরাও, ও আমাকে ঘুমের মধ্যে চিমটি কাটছে।
-কি অদ্ভুত কথা বলছো অলি-  অভিক চরম বিরক্ত এখন।
বাদ দাও না, ছোট মানুষ। আচ্ছা, পাশে নিয়ে ঘুমাতে হবে না। অভিক, ওটাকে আলমারির মাথায় তুলে রাখো।
বেডরুমের মালয়েশিয়ান উডের কালো আলমারির মাথায় টেডিটাকে তুলে দিল অভিক। শেষ রাতে আবারও চিতকারে ঘুম ভেঙে গেল অভিকের। না এবার অলিভা নয়, চিৎকার কেয়ার।
-অভিক, অভিক, টেডিটা হাত নাড়ছে।
-কি যা তা বলছো কেয়া?
-আমি সত্যি দেখেছি।
কেয়ার কান্নার দমক, তীব্র ভয়ের সঙ্গে আর যা ঘটে গেল সেই পরিস্থিতির জন্য অভিক মোটেই প্রস্তুত ছিল না। ব্লিডিং শুরু হল কেয়ার। সকাল তখন সাতটা, ডোরবেল বাজছে, নাস্তা বানানোর জন্য বোধহয় রহিমা খালা এসেছে।
-খালা, আজ আর নাস্তা বানাতে হবে না, আমরা সবাই এখন হাসপাতালে যাচ্ছি, তুমি একটা কাজ করো, গ্যারেজের ময়লার ড্রামে এই পুতুলটা ফেলে দিয়ে যাও।

____________________________________________
তুমি পড়ে গিয়ে পায়ের শক্তি হারিয়েছ তুরাগ, আর দোষ দিচ্ছ একটা প্রাণহীণ পুতুলকে। একটা টেডি, যার নিজের এক ফোটা ওজন নেই, সে তোমার মতো একটা ত্রিশ কেজির ছেলেকে ঠেলে ফেলে দেবে, তাও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে?
____________________________________________

দুই. 

এক মাস আগে গ্রাম থেকে সপরিবারে ঢাকা এসেছে রহিমা। সপরিবার বলতে রহিমার স্বামী, পাঁচ বছরের শিশুকন্যা পরী এবং রহিমা নিজেই। স্বামী ঢাকায় রাজমিস্ত্রীর যোগালের কাজ নিয়েছে। সে নিজেও একটা কাজ পেয়েছে, যাকে ঢাকা শহরের লোকে বলে বুয়ার কাজ, কেয়া ভাবিদের বাসায় সেই কাজ করে রহিমা। কেয়া ভাবির সামনে অবশ্য তাকে ভাবি বলে না সে, ম্যাডাম সম্বোধন করে। কেয়া-অভিক কেন যে রহিমাকে খালা বলে ডাকে, তা তার মাথাতেই আসে না। রিক্সাওয়ালাকে ‘মামা’, কাজের সহকারীকে ‘খালা’ সবাই কেন ডাকে তা ভাবার অনেক চেষ্টা করেছে রহিমা, মামা-খালা না বলে চাচা-ফুফুও তো বলতে পারত? মামা-খালা কি খুব ‘আপন’ নাকি অনেক দূরের? এই ডাকের রহস্য খুজে পাওয়া যেমন হল না তার, তেমন করেই বুঝতে পারে না সমবয়সী হলেও সে খালা কেন? বয়সে কেয়ার চেয়ে ছোটই হবে রহিমা। কেয়ার মেয়ের বয়স ছয়, রহিমার মেয়ে পরীর বয়স পাচ। তাও রহিমা শুধু কেয়ার খালাই নয়, অভিকেরও খালা। মাত্র দশদিন হয়েছে কাজ নিয়েছে এই বাসায়। সব কিছুই বড় আজব এদের, যা রহিমার মোটা মাথায় একদম ঢোকে না। আজ যেমন ঢুকতেই একটা লাল টুকটুকে নরম পুতুল দিয়ে স্যার বলেছে ময়লার ড্রামে ফেলে দিতে। পুতুলটা একদম নতুন, চকচক করছে, এটাকে নাকি ফেলে দিতে হবে! রহিমা পুতুলটা তার মেয়ে পরীর জন্য নিয়ে যাচ্ছে, আর কল্পনা করতে চেষ্টা করছে এটা পেয়ে পরীর মুখটা কেমন দেখাবে তা।
মা, কি নরম পুতুলডা, কি সোন্দর! কি সোন্দর!
খেল মা, এমন জিনিস তোরে তো কুনোদিন দিবার পারি নাই।
সারাদিন পরী এই পুতুলের সঙ্গেই লেপ্টে রইল।  পুতুলকে খাওয়ালো, ঘুম পাড়ালো, আরও কত কি! বাবা কাজ থেকে ফেরার পর তার সঙ্গে পুতুলের আলাপ-পরিচয় করিয়ে দিল। বস্তির সব বাচ্চাদের আলোচনায় আজ ঠাঁই পেল শুধু লাল টুকটুকে নরম এক টেডি বিয়ার, যা এদের কাছে এক অতীব বিস্ময়। সারাটা দিন খুব হুল্লোড় করেছে মেয়ে, তাই সন্ধ্যা রাতেই ঢলে পড়ল ঘুমে।
-জানো মা, পুতুলডা আমারে ঘুমের মইধ্যে খামচায়
পরী, তোর গা পুইড়া যাইতাছে, চুপ কর মা।
রহিমা এবং তার স্বামী পরীর মাথায় বালতির পর বালতি পানি ঢাললো, দু’জনের হাত অবশ হয়ে গেলেও মেয়ের জ্বর তারা কিছুতেই নামাতে পারলো না। হাসপাতালে নেওয়ার পর জানা গেল পরী ডেঙ্গু জ্বরে ভুগছে।

আরও পড়ুন : Ira Khan-Nupur Shikhre Marriage : অতিথিদের থেকে একটি জিনিস চাইলেন ইরা

কেয়ার গর্ভের সন্তানকে ওরা বাঁচাতে পারেনি। ডাক্তারের ভাষায় এটা মিসড অ্যাবরশন। হার্টবিট তেমন ভালো না থাকায় অ্যাবরশন হয়ে গেছে। কেয়া যতটা না শারীরিক তার চেয়ে বেশি দূর্বল হয়ে পড়েছে মানসিকভাবে। যদিও টেডিটা নেই তবু এক অজানা আশঙ্কায় গত রাতেও অলিভা, কেয়া দু’জনেই কেঁপে কেঁপে উঠেছে। সারাটা রাত ঘুমহীন কেটেছে অভিকেরও। কীভাবে যে কি ঘটে গেল! সকাল এখন দশটা, বাসার এই পরিস্থিতিতে রহিমা খালা এখনও কেন যে এল না!
কেয়া, খালা তো আসছে না, নাস্তা কি বানাবো?
আমার ফোনটা দাও, খালাকে ফোন করি একটা।
দূর্বল হাতে রহিমার নম্বরে ডায়াল করে কেয়া। ওপাশে রিং হতে হতে এক সময় কান্না ভেজা গলা ফিরে আসে।
খালা, কাঁদছো কেন? আজ এলে না এখনও? জানতে চায় কেয়া।
ম্যাডাম, আমার মাইয়াডা বিয়ান বেলা মইরা গেছে। বিলাপ করতে করতে জানায় রহিমা।
রহিমা, সত্যি কথা বলো, পুতুলটা তুমি কি বাসায় নিয়ে মেয়েকে দিয়েছিলে?
হ আপা
ফেলে দাও, ফেলে দাও।
তীব্র শোকে কেয়াকে ম্যাডাম থেকে আপা সম্বোধন করে ফেলেছে রহিমা, দু’জনের কেউ তা খেয়াল করল না।
তিন. 
পথ শিশু, ঢাকায় টোকাই নামেই যারা বেশি পরিচিত। তবে টোকাই হলেও, জন্মসূত্রে এদের একটা নাম থাকে। এমন একটা নাম জন্মের সময় পেয়েছিল আরিফা, এখন অবশ্য টোকাই নামের আড়ালে হারিয়ে গেছে সেই নাম। ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরে এটা-সেটা টোকাতে গিয়ে আরিফা আজ পেয়েছে এক লাল টুকটুকে পুতুল। এই পুতুলকে কোনও মতেই বিক্রি করবে না সে, নিজের জন্য রেখে দেবে। আজ আর আরিফার অন্য কিছু টোকাতেও ইচ্ছা করছে না, পুতুলটা কোলে নিয়ে নিজের আস্তানায় চলে যাচ্ছে সে। প্রতিদিনের মতো বউবাজারের বস্তিতে ফেরার জন্য প্রধাণ সড়ক পার হতে থাকে আরিফা। প্রাইভেট কারের ধাক্কায় রাস্তায় পড়ে যায় আরিফা। সঙ্গে সঙ্গেই জমে যায় মানুষের জটলা। গাড়ি থেকে বাইরে বের হয়ে আসেন ডাক্তার ইভানা এবং তার ড্রাইভার ইকবাল।
প্লিজ, আমাকে দেখতে দেন, আমি ডাক্তার। তেমন কিছুই হয়নি, শুধু কপাল কেটে ব্লিডিং হচ্ছে। আমি আমার ক্লিনিকে নিয়ে যাচ্ছি ওকে। ইকবাল, মেয়েটাকে গাড়িতে তোলো।
হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ব্যান্ডেজ করা হল আরিফাকে। রক্তক্ষরণ খুব একটা না হলেও আরিফার গায়ে তখন তীব্র জ্বর। জুনিয়র ডাক্তাররা ইভানাকে বাসা থেকে লাঞ্চ করে আসার অনুরোধ করেন। প্রয়োজন হলে তারাই ম্যাডামকে ফোন দেবে।
তার নিজের পর্যবেক্ষণ বলছে, মেয়েটির সমস্যা জটিল কিছু নয়, তাই ক্লিনিকে আরিফাকে রেখে বাসায় ফেরেন ইভানা।
মাম্মা, তুমি আবার লাল টেডি বিয়ার নিয়ে বাসায় এসেছো? চিৎকার করে ওঠে ইভানার দশ বছরের ছেলে তুরাগ।
তুমি চিৎকার করছো কেন? আজ আমার গাড়িতে একটা টোকাই অ্যাক্সিডেন্ট করেছে, ওর কোলে এই টেডিটা ছিল। মেয়েটাকে ক্লিনিকে ভর্তি করেছি। সুস্থ হলে এটা ওকে ফিরিয়ে দেবো।
তুমি ক্লিনিকেই এটা রেখে আসতে, বাসায় নিয়ে এলে কেন?
এটা গাড়িতেই রয়ে গিয়েছিল, তাড়াহুড়ায় তখন খেয়াল করিনি। তাছাড়া এমন উত্তেজিত হবার কি আছে তুরাগ?
উত্তেজিত হবার কারণ, এটাও লাল রঙের।
তো কি হয়েছে?
মাম্মা, তুমি জানো, আমি আজ হুইল চেয়ারে বসে আছি শুধু এমন একটা লাল টেডি বিয়ারের কারণে, যে আমাকে চিমটি কাটতো কিন্তু তুমি বিশ্বাস করতে না।
আমি ডাক্তার, এমন অদ্ভূত কথা আমি বিশ্বাস করতে পারিনা।
তাহলে আমার পা? টেডিটা আমাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল তা তুমি আজও মানতে পারলে না!
তুমি পড়ে গিয়ে পায়ের শক্তি হারিয়েছ তুরাগ, আর দোষ দিচ্ছ একটা প্রাণহীণ পুতুলকে। একটা টেডি, যার নিজের এক ফোটা ওজন নেই, সে তোমার মতো একটা ত্রিশ কেজির ছেলেকে ঠেলে ফেলে দেবে, তাও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে? আমি তোমার কথা সেদিন বিশ্বাস না করলেও, শুধু তোমার মানসিক অস্থিরতার কারণে নিজে গিয়ে দোকানে পুতুলটা ফেরত দিয়ে এসেছিলাম।
মোবাইল ফোন বেজে ওঠে ইভানার, ক্লিনিক থেকে ফোন এসেছে।
ম্যাম, মেয়েটা এখন ভালো আছে, আপনি চিন্তা করবেন না।
চিৎকার করে ড্রাইভার ইকবালকে ডাকেন ইভানা। রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াতে দৌড়াতে আসে ইকবাল। চোখে অপার বিস্ময়।
ইকবাল, এটা এক্ষুণি বুড়িগঙ্গার পানিতে ফেলে দিয়ে আসো।
বুড়িগঙ্গা ম্যাডামের বাসা থেকে খুব বেশি দূরে নয়। গাড়ি নিয়ে ইকবালের আসতে বড়জোর দশ মিনিট লাগল। বুড়িগঙ্গার পানিতে পুতুলটা ফেলতে গিয়েও ইকবাল থেমে গেল, চোখে তার চার বছরের শিশুকন্যার মুখটা ভেসে উঠল। পুতুলটা পেলে রিক্তা অনেক খুশি হবে। মাত্র তিন দিন ম্যাডামের ড্রাইভার হিসাবে কাজ পেয়েছে ইকবাল। ম্যাডামের নিজস্ব ড্রাইভার মাসুদ গ্রামে গেছে, তাই বদলী হিসেবে তিন দিনের জন্য দিয়ে গেছে তাকে। শেষ দিনে আজ একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলেছে সে, বাচ্চা মেয়েটাকে দুপুরে ধাক্কা দিয়েছে। তবু যে ধাক্কা দেওয়ার জন্য ম্যাডাম মুখের উপর ঠাস করে একটা চড় কষেনি এটাই ইকবালের ভাগ্য। ইভানা ম্যাডামের কাজ-কর্ম অদ্ভূত  তিন দিনে বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। তা না হলে এমন সুন্দর একটা পুতুল কেউ বুড়িগঙ্গায় ফেলতে বলে!
পুতুলটা ঝটপট রিক্তাকে বাসায় দিয়ে জলদি ম্যাডামের বাসায় চলে যেতে হবে। পুতুলটা কি একটু বাঁকা চোখে তাকাল ইকবালের দিকে? ধূর, গাড়ি চালাতে চালাতে আজকাল চোখেও ধান্দা দেখছে ইকবাল, নইলে দুপুরে এই অঘটনটা ঘটত না, মেয়েটার গায়ে কীভাবে যে ধাক্কা লেগে গেল। স্টিয়ারিংয়ে হাত রাখে ইকবাল, স্টার্ট দেয় গাড়ি, বাসায় পুতুলটা নামিয়ে ঝটপট ম্যাডামকে পিক করতে হবে। ম্যাডাম ক্লিনিকে যাবেন, খুব তাড়া আছে তার।

অলঙ্করণ : প্রীতি দেব 

[সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ, গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, ভ্রমণ কাহিনী…। ই-মেল: sasrayanews@gmail.com ]

Sasraya News
Author: Sasraya News

Leave a Comment