



পরাণ মাঝি সাম্প্রতিক সময়ের লেখক। জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ, এক শ্বাপদ সঙ্কুল পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করে জীবনে ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হতো, হতদরিদ্র ছোট্ট পরাণ মাঝি। বাগদার মিন ধরতে ধরতে নদী প্রেমে আত্মহারা, নদী তাই শৈশব থেকে টানে তাকে। আজও শহরের ব্যস্ততম জীবনে নদীর কলতানে মুগ্ধ কবি গঙ্গার পাড়ে সময় কাটান। লঞ্চের রাঁধুনির কাজ করতে করতে কলেজে পা, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় শিক্ষক কবি শঙ্খ ঘোষের কাছে কবিতা লেখার হাতে খড়ি। সাংবাদিকতা, সরকারী চাকরির সঙ্গে সঙ্গে ‘সাঁকো আন্তর্জাতিক সাহিত্য পত্রিকা’-র প্রতিষ্ঠাতা। কবির প্রথম কাব্য গ্রন্থ ‘সাঁকো’, দ্বিতীয় কাব্য গ্রন্থ ‘মন্দ বাসিনি তোকে’ এবং তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘সাদা আঁধারের কালো আলো’। এছাড়া জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক ক্ষেত্রে নানা পত্র-পত্রিকায় কবির অজস্র লেখা প্রকাশিত। সাশ্রয় নিউজ-এর ফেব্রুয়ারি মাসের পাতায় রইল তাঁর গুচ্ছ কবিতা।
🍁কবিতা
পরাণ মাঝি
সেই তো আমার ভালো
এত আলো। তারকা খচিত মিছিল। কথামালা ধারালো।
মেঘ কী কাটলো?
আঁধার কী ঘুচলো?
নাকি অনেকেই সেই তিমিরেই থাকলো? কারো কী ঘুম ভাঙলো?
বরং এসো ধরি হাত। মুছি আগে আঘাত। জেনেই নিই কার কোথায় কত ক্ষত্।
তারপর – পড়া যাবে। বোঝা হবে সব ইতিহাস
কচুশাক আর কুচো চিংড়ি – তাতেই বাজিমাৎ
অভাবের ঘরে স্বভাব নষ্ট
পিছিয়ে আছি কিম্বা এক পা বাড়িয়ে দিতে পারি না
ভাঙা ঘরে চাঁদের আলো সেই তো আমার ভালো।
ভাঙা বেড়া। হাতল ভাঙা কড়া। শান দেওয়া কাস্তে, কোদাল…
চাষের মাঠ। মাছের পুকুর। সবুজ সবজি ভরা ক্ষেত। স্কুল, কলেজ। সন্ততির সামান্য একটা কাজ। দু’মুঠো ডালভাত, সুস্থতা…
একচিলতে ঠিকানা – সেই তো আমার ভালো।
দাও দেখি একবার জুড়ে
ডানা কাটার পর দেশটা ঝিম মেরে শুয়ে আছে
ভাষাচ্ছেদ
সংস্কৃতিচ্ছেদ
নানান চ্ছেদে ধুকছে দেশটা আমার
অথচ বিছিয়ে রেখেছে অবারিত কোল
বড় ব্যথা কাঁটাতারের ল্যাটা
বুকের ওপর এভাবে পেরেক, খুঁটি পোঁতা কিছুতেই মেনে নিতে পারে কী কোনো মা?
জীবনের অসমাপ্ত রাস্তা জুড়ে যদি কাতরানি থাকে
তবে তো শুকিয়ে যায় বুকের দুধও
সন্তান আমরা তার
ঘর ভেঙে গেলে সবাই পর? না, না এমন হতে পারে না
তাইতো বারবার ডাকে, হাতছানি দেয়, ইশারা আঁকে
আয় ফিরে আয় মায়ের কোঁকে
আলাদিন!
তোমার আশ্চর্য যাদুবলে কাঁটাতার উপড়ে
তেড়েফুঁড়ে দাও দেখি একবার জুড়ে
আমরা মিলে যাই – ভাষা-সম্পদে, নদী-নালায়, গাছ-পালায়
মনের সেই চিরন্তন মিলন মেলায়…
কে আমাকে হারায়
পদার্থ কিম্বা অপদার্থ সবটাই আমি এবং বলতে পারো আমি অর্থহীনও বটে
পরমার্থের পথে পথে করি ফেরি। তাই বলতে পারো ব্যর্থ
শক্ত সামর্থ্য
রাতে দিনে খুঁজে ফিরি জীবনের সত্য
বর্ণমালার মালা গেঁথে গেঁথে পরাই কবিতার গলায়
বলো দেখি জননী – কে আমাকে হারায়?
অনাবিল আলপথ বেয়ে
স্মৃতির মাঝে আজও ঝরে পড়ে শীতের গাঙচিলের পালক
শান্ত নোনা নদী, তার তীরে শুয়ে আছে সোনাধান — পাটনাই, রুপশাল, দাদশাল, মরিচশাল
শালিক, বুলবুলি, চড়াই আর ইঁদুরের ভুরিভোজের ডট.কম..
পেশা নয় নেশা ছিল — শীতের রাতে কাঁকড়া আর কচ্ছপ তেড়ে ধরার, লাফা দিয়ে শোল শিকারের
বাতাসে মঁ মঁ নলেন গুড় আর মুড়ি -মোয়ার সুবাস সাথে পিঠেপুলি, বনবিবির মেলা আর রেডিও ছেড়ে ক্রিকেটের ধারা বিবরণী…
কত ঝগড়া, বিবাদ, প্রীতি ভুলেছি অবলীলায়
তবু সাপলার খাল, ধানের মাঠ আাজও ঠক্কর মারে আর ঘুরে ঘুরে বেড়ায় সেই সব কষ্টকর আনন্দের অনাবিল আলপথ
এই কোলকাতায় জোয়ার ভাটায় জীবন চলে ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায়
তবু যেন মনমুকুর ঝুলে থাকে অতি কষ্টে বোনা বাবুই পাখির ঝুলন্ত বাসায়
না বলবি না
প্রেমিকা নেমে আসছে। সবুজ পাহাড়ের গা বেয়ে; দুধ সাদা তার শরীর রঙ। ছুটছি। তাকে ছোঁবো বলে। ছুঁতে যদি না পারি কাছাকাছি তো একবার দাঁড়াতে পারবো….
প্লিজ কাম শুন-
যন্ত্রণার সন্তান। আরো চাই। দাও। পারলে আরো। আরো…
নতুবা তোমার শরীরে ভেজাও। শান্ত করো। শান্ত; করো…
এই তো- সারা বছর ধরে ছুটে ছুটে এসেছি। মৃদুল হিমবন্ত বাতাসকে বলেছি – তাকে খবর দিতে।
সো, আসছে সে। পার্বত্য প্রদেশ থেকে। সেবাকর্মী হয়ে। সে এলেই তার মাথার সাপকে আদর করে বলবো- ফণা তুললেই তোর শাঁখে ফুঁ দিয়ে দেবো। তার চেয়ে ঠোঁট বাড়িয়ে দে, আমাকে চিবিয়ে চিবিয়ে খা।
তোর অন্তর রঙ বুকে মাখিয়ে দে। না বলবি না!
দু-হাতে আতর। পারস্য থেকে আানা। তুই আদর আঁক, তুই বাঁদর বল কিন্তু না করবি না।
বিকজ-
তোকে কখনো মন্দবাসি না।
ঝর্ণা!! ও ঝর্ণা!!
তোর দুধ সাদায় একবার ভেজা না।
অ-শোক বনে
সুনশান হলদি নদীর ঘাট। সুদীর্ঘ পরিতাপ মিশিয়ে ছায়া দীর্ঘতর। এমনি নির্জন আঁধারে শ্রেয়সী সুরের সাথে মালা বদল করি রোজ…
উচ্ছ্বাসের কোকিল ডাকে। প্রজাপতি ওড়ে। অগুনতি তারাদের বাসর ঘর। ছাঁদনা তলায় জোনাকি পাখি জ্বলে।
জল থেকে উঠে আসে পাপিয়া শীতলতর বাতাস…
এই অ-শোক বনে কে তুই মনাসর ঘাঁটিস। আয়। বিবসনা হ’য়ে শুয়ে পড়।
তোর নরম হাড়ের স্পর্শ পাবে বলে বিছানা সেজে কে আছে একবার দ্যাখ
ঠুঁসি খুলে দ্যাখ
আর অজন্তার গুহাচিত্র আঁক।
সুখ যেখানে সুখ নয়
অতপর ডিসেম্বরের ২ তারিখ আসবে
হালকা শীতে আবার মনে পড়বে-
কবে তুমি অন্তরাল থেকে বাইরে এলে
কবে তুমি কাঁদতে শিখলে
ভাবনা হলেও চরম সত্যি
আাসলে সুখ যেখানে সুখ নয়
সেখানেই পাঠানো হয়েছে তোমাকে
শীতল শান্ত হলে, সেবা দিলে
কেবা মিলিয়ে যাবে
কেবা মিলিয়ে দেবে
এসব সত্যের থেকে
এসব কল্পনার থেকে অনেক বেশি বাস্তব তুমি
নান্দনিক
প্রবল প্রেমালু বিকেলে
কাঁপছিল ঠোঁট চারটি
সন্ধ্যের দিকে এল সেই
মাতাল বাঁধ ভাঙা বৃষ্টি
পুটুস গ্রাম
ঝোপের ভেতর একা সেই মোরগ ডাকে
ঘাম ঝরছিল পরাগের তিতলি সোহাগে
শহরতলি
ভাঙা রঙের বাড়ি আর জোড়াতালির গাড়ি
শারীরিক সুখের পরেও জেগে থাকে আড়ি
স্মরণিকা
চারিদিকে আঁধার জমে উঠেছে আলোর মতো সে উৎসব সুন্দর
রহস্যময় স্তবের ভেতর কেন জেগে ওঠে পিছনে ছেড়ে আসা বন্দর
অন্তস্থলী
শরীর পোড়া গন্ধের রুটি এঁকে দেয় নৈবেদ্যের খুনসুটি
রাষ্ট্র , সভ্যতা না ঈশ্বরের বলো — এ কার একনিষ্ঠ ভ্রুকুটি
পরামর্শ
বেমালুম শারীরিকতার পর সুখ-শান্তি না এলে
বাঁচার ভেতর ঘুমিয়ে থেকো প্রশান্ত মহাসাগরে
গোপন-গাথা
প্রেমের শ্রেয়সী তলায় মাঝে মাঝে কু-আশা ডেকে যায়
নরম পাথর
রাতভোর নীল স্বপ্নের সোহাগময় ডেরায়
কামনার দু-হাত নরম পাথর খুঁজে বেড়ায়
চাঁদ-পালা
এখনো কাত হয়ে আছে সেই রহস্যতলায়
প্রজ্ঞান প্রেম কেমন আছে চাঁদের খেলায়
টোটকা
ডাক এলেই হঠাৎ ছুটে যাই সুখ ও দুঃখ বরাবর
যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ছুঁতে হয় পরশপাথর
ঝরা পাতা
মুখ থুবড়ে পড়ে আছে শুকনো ঝরা পাতা
উদলা বুকের মাঝে স্পষ্ট শিরা- উপশিরা কথা
বলিহারি– বাতাসটাও যা তা
অসভ্যতা
এক গোছা আঁধারেও মাথা ছাড়া সব দেখা যায়
মরমীয়া
মরে গেছি মরমে
বাঁচার সমস্ত অর্ঘ্য কে যেন থালা উল্টে ফেলে দিয়ে গ্যাছে
তা কুড়িয়ে আবার সাজাবো তেমন শক্তি কই
আধোরাতে
তুমি যদি আসো
এমনি আলো আঁধারিতে এসো
না ফুলের মালা গেঁথে ভগ্নাংশ চাঁদ তলায় না হয় একটু ব’সো
না কবিতা
কী হবে পড়ে এসব উদ্ভট না কবিতা
সঞ্চিত শব্দের যা আছে দেখেছো তো সবি তা
দান
প্রেম !
সে তো খরচ হচ্ছে দৈনন্দিন কারাগারে
বাকি যা, তা তো দিতে হবে এই সংসারে
তবে
আর কী দিতে পারি কাঙ্খিত রে !!
আছি
আছি তো সেই কত যুগ আগে থেকে
সেই মানুষের কথা বলতে শেখার আগে থেকে ।
মনে নেই শব্দের পুকুরে একসাথে ডুব দিয়ে আর ভেসে উঠতে পারিনি
আছি তো সেই কত যুগ আগে থেকে
থমকে কেন যাও
থমকে কেন যাও চলো এগিয়ে
সোনালী শিশিরের মতো টলোমলো স্তন
কমল হাত আর সরু কোমর দুলে উঠুক আবার
থমকে কেন যাও
শরীর-মন সমান্তরাল তালে হোক আত্মহারা
সুডৌল সেই সব ঊর্বশী দৃঢ়তা ভাঙাক ধ্যান
মুখ, বুক আর মসৃণ পা নটরাজ হলে
শেকল পরেও পান করি চিরন্তন সেই সুধারস
যৌবনাবতী !! থমকে কেন যাও?
অঙ্কন : প্রীতি দেব
👉সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ, গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, ভ্রমণ কাহিনী… ই-মেল : sasrayanews@gmail.com
