Sasraya News

Saturday, February 15, 2025

Article : সুশান্ত কুমার দে -এর গদ্য পিছন পানে মন যে টানে

Listen

🍂গদ্য
আম -কাঁঠালের বাগ বাগিচা, খেজুর, তাল লিচু, বেল গাছের ছায়া পড়ত। বিদ্যুতের পাখা ছিল না তবুও গরমের অনুভূতি ততটা অনুভব করতে পারেনি। এখন পৃথিবীর তাপমাত্রা রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে, কলকারখানার ধোঁয়া, নিত্য নতুন যুদ্ধের মহড়া, নির্বিচারে বৃক্ষ নিধনের ফলে বায়ু দূষণের মাত্রা ক্রমশই বেড়েই চলেছে। লিখেছেন : সুশান্ত কুমার দে

 

 

নেক দিন আগের কথা আজও মনের ভেতর প্রতিধ্বনিত অনু কম্পিত।
ক্ষণে ক্ষণে হৃদয়ের গভীরে মোচড় দিয়ে ওঠে, গাঁয়ের ফেলে আসা দিনগুলোর কথা, মাটির দেয়ালের ঘর গোল পাতার ছাউনী, নারা পলগুঁজে চালের মটকা মেরে ঘরটিতে থাকতে হতো।
অভাব অনটনের সংসার, তবুও সুখের ঘাটতি দেখা দেয়নি কখনও। ঘরের আসবাবপত্র আলমারি,আলনা, টিভি, ফ্রিজের কোনও বালাই ছিল না।
মাটির তৈরি কালো রং করা মাটিয়ার মধ্যে নতুন কাপড় চোপড় রাখতে হতো। ঘরের খোলা বারান্দায়ে একটা মাদুর পেতে ঘুমাতে হতো। তীব্র গরমের সময় একটা তালপাতার পাখায় ছিল যথেষ্ট। রাতের বেলা গরম নিবারণের একমাত্র পথ দরজা, জানালা খুলে রেখে ঘরের ভেতর ঘুমাতে হতো, কিংবা দক্ষিণের বারান্দায় একটা পাটি পেতে হিমেল হাওয়ায় কী যে প্রশান্তির ছোঁয়া।

তবে এখনকার দিনের মতো, তখনকার দিনে গরমটা অনেক কম ছিল। বাড়ির চারপাশে আম -কাঁঠালের বাগ বাগিচা, খেজুর, তাল লিচু, বেল গাছের ছায়া পড়ত। বিদ্যুতের পাখা ছিল না তবুও গরমের অনুভূতি ততটা অনুভব করতে পারেনি। এখন পৃথিবীর তাপমাত্রা রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে, কলকারখানার ধোঁয়া, নিত্য নতুন যুদ্ধের মহড়া, নির্বিচারে বৃক্ষ নিধনের ফলে বায়ু দূষণের মাত্রা ক্রমশই বেড়েই চলেছে।
দাদুর কথাগুলো শুনে, কণা যেন একেবারেই থ মেরে গেল।
তুমি সত্যিই বলছ দাদু?
তখনকার দিনে তোমরা খুব ভালো ছিলে, তাই না দাদু?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, দিদি ভাই, আমরা খুবই ভাল ছিলাম।
তখনকার দিনে কত আরাম -আয়েশে দিন কাটত, খেলার সময় খেলা, পড়ার সময় হলে পড়তে বসতাম।
রাতের বেলা সবাই মিলে যাত্রা গান শুনতে যেতাম।
ছুটির দিনে সকালে -বিকালে ঘুরে ঘুরে বায়োস্কোপ-এ সিনেমা দেখা, বেদেরা সাপ- বানরের খেলা দেখাত।
বাড়ির আনাচে কানাচে আরও কত অজানা খেলায় সারাটাবেলা কেটে যেত।
এছাড়াও হাডুডু, কানামাছি, গোল্লা ছুট, বুড়ির ছুঁ ইত্যাদি খেলার আয়োজন হতো।
মেঠো পথের ধারে ছেলেরা ডাংগুলি খেলত।
এবার আরেক কথায় আসি, তোরা পালকি দেখেছিস কণা?
কণা হেসে বলল, না, না- ওটা কেমন দেখতে দাদু?
তবে বইতে পড়েছি, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের -পালকির গান কবিতা পড়েছি,
“পালকি চলে, পালকি চলে, গগন তলে আগুন জ্বলে।”
কি সুন্দর!
ঐ কবিতাটির পাশে পালকির ছবি আছে।
আর বেহারাগুলো গান গেয়ে গেয়ে হেঁটে যাচ্ছিল, দাদু?
ওরা কোথায় যায় দাদু?
দাদু হেসে বলল, বর বিয়ে করে বৌকে নিয়ে বাড়ি যায়।
তোরা এখন বইতে পড়ছিস, আর ঐ পালকিতে চড়েই -তখনকার দিনে আমাদের বিয়ে হয়েছে!
হ্যাঁ, হ্যাঁ তাই নাকি দাদু?
দাদু, আমাকে একটু পালকিতে চড়ে ঘোরাবে?
দূর বোকা, পালকি কি- এখন আর দেখা যায়?
এখন পালকি দেখতে গেলে যাদুঘরে যেতে হবে?
আমিও যাদুঘরে যাব দাদু?
আমাকে একদিন যাদুঘরে নিয়ে যাবে?
হ্যাঁ, অবশ্যই নিয়ে যাব।
আরও শোন, আগে আমরা খবর শুনতাম রেডিওতে,
তাও আবার, অনেক লোক এক সাথেই বসে।
কেন, কেন দাদু?
রেডিওর তখন অনেক দাম ছিল, যে কেউ কিনতে পারত না।
দাদু, রেডিও কেমন দেখতে ছিল?
তোরা, বোধহয় রেডিও টাও দেখেসনি, তাই না কণা দি?
না, না দাদু, আমি রেডিও টাও দেখেনি?
আমাকে ওসব দেখাতে পারবে?
হ্যাঁ, হ্যাঁ তোকে সব দেখাবো?
আর চিঠি পত্রের মাধ্যমে আমরা আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে যোগাযোগ করতাম।
চিঠি পৌঁছাতে কতদিন সময় লাগতো দাদু?
তা প্রায় এক সপ্তাহের বেশি।
আমরা চিঠি লিখে খামের ভেতর ঢুকিয়ে পোস্ট অফিসে গিয়ে পোস্ট করে আসতাম।
রানার সেই চিঠির বোঝা, ব্যাগে ভরে রাত-দিন ঘুরে ঘুরে বেড়াতে।
তারপর সেই চিঠিপত্রের নাম ঠিকানা দেখে দেখে পিয়ন বাড়ি বাড়ি দিয়ে বেড়াত।
তখন কতো কষ্ট করতে হত -তাই না দাদু?
হ্যাঁ ঠিকই, তবে আনন্দ কষ্ট দুটোই ছিল ।
আমরা সাত আট মাইল পথ পায়ে হেঁটে স্কুলে যেতাম।
স্কুলের পড়া না করলে মাস্টার মশাই ভীষণ জোরে মারধোর করতেন। আর এখন তোরা দিব্যি আরামে রাত দিন মোবাইল ফোন নিয়ে সময় নষ্ট করিস।
এখন শুনছি, অনলাইনে ক্লাস করতে ইন্টারনেট ল্যাপটপ লাগবে। হায়রে আমার কপাল, এই শেষ বয়সে এসে কত কিছুই নতুন করে দেখছি, শিখছি?
আগের দিনে আমাদের অসুখ-বিসুখ হলে কোনও এলোপ্যাথি ওষুধ খেতে পারতাম না। এক হোমিওপ্যাথি এক ফোটা ওষুধের সাথে দশ ফোটা জল মিশিয়ে ঢক ঢক করে গিলে খেতাম।
কখনও কবিরাজের গাছ-গাছড়ির রস, বিভিন্ন পুরিয়া খেতে হত। সর্দি কাশি, জ্বর হলে -মা, শিকড় বাকড় জোগাড় করে তার রস করে খেতে দিতেন। তাতেই যাদুর মতোই সর্দি কাশি সেরে যেত।
অনেকেই ঝাড় -ফুঁকে বিশ্বাসী ছিল।
আগের দিনে মানুষের বিশ্বাস ঝাড় ফুঁক দিয়ে অসুখ বিসুখ সারানো যায়।
আবার ভূত-প্রেত ও তাড়ানো যায়।
দাদু, তখনকার দিনেও কি ভূত ছিল?
ভূত প্রেত নিয়ে আমি দ্বিধা দ্বন্দ্বে আছি, দিদি ভাই?
তবে আমি অনেক বার ভূতের মুখোমুখি হয়েছি।
আমি ভূত বলে কখনও বিশ্বাসী ছিলাম না, তবু ও আমাকে অনেকবার ভূতে তাড়া করেছে।
দাদু, এবার আমার কিন্তু ভীষণ ভয় করছে?
ভূতের গল্পটা এখন থাক?
ও তাই নাকি, আচ্ছা ঠিক আছে- আমি আর বলছি না?
এবার তাহলে, স্কুলে যাও?
স্কুলের সময় তো হয়ে গেছে, আরেক দিন না হয়, বাদবাকিটুকু বলব?
হ্যাঁ, ঠিক আছে -দাদু!
তবে তোমাদের অন্ধকার জগত থেকে বেরিয়ে আমরা আজকে আলোর সন্ধানে ছুটে চলেছি, তাই না দাদু?
কত কষ্টে তোমাদের অতীতের দিনগুলো কেটেছে।
এখন আমরা কতটা সুখী, বল দাদু?
না না কণা, তখনকার দিনে আমরা সব সময় টাটকা শাকসবজি, ফলমূল খেয়েছি, আনন্দ ফূর্তি করে ঘুরে বেড়িয়েছি।

কোনও খাদ্য দ্রব্যে ভেজাল কিংবা কীটনাশক ওষুধ প্রয়োগ করতে হয়নি।
বিনা সারে হয়তো-বা অল্প স্বল্প জৈব সার প্রয়োগ করে ভালো ফসল পেয়েছি।
আর এখন তোরা বিষাক্ত রাসায়নিক যুক্ত ভেজাল খাদ্য খেয়ে যাচ্ছিস?
তাতেই নিত্য নতুন অজানা রোগ এসে শরীরের ভেতর বাসা বাঁধছে। নানান অসুখ বিসুখে, কত মানুষ অকালে ঝরে যাচ্ছে।
এখন দূষিত ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসছে।
কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রা ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাতাসে রোগ জীবাণু ঘুরে বেড়াচ্ছে।
তারপর, এখন উন্নয়নের জোয়ারে শিশুরা ফেসবুক, ইউটিউব ভিডিও গেমের প্রতি আসক্ত হয়ে উঠেছে ।
এতে করে উঠতি বয়সী ছেলে -মেয়েদের চোখের বারোটা বেজে যাচ্ছে।
এসব কি ভালো লক্ষণ মনে করেছিস কণা?
তোরা এখন এতটুকু বয়সে মোবাইল থেকে কিছুটা দূরে থাকার চেষ্টা কর?
হ্যাঁ দাদু ,তোমার কথায় , আমি চলব?
আমি আর মোবাইল ফোনে গেম খেলব না, কার্টুন দেখব না?
আমি এখন নিয়মিত পড়াশোনা করবো, খাওয়া দাওয়া করবো।
এই তোমার মাথা ছুঁয়ে দিব্যি কাটছি।
তবে, দাদু -তুমি আমাকে কিন্তু যাদুঘর দেখাবে?
আমি যাদুঘরে গিয়ে পালকি, ঢেঁকি, বায়োস্কোপ সহ অনেক কিছুই দেখবো।
আর একদিন অলির বাঁশ বাগানে ভূত দেখতে যাবো?
সঙ্গে আমার বন্ধুদের ও নিয়ে যাব?
দাদু বলল, ঠিক আছে কণা দিদি, আমি যতটা পারি তোমাকে সবই দেখাব?🍁

ছবি : প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত 

আরও পড়ুন : Sasraya News | Sunday’s Literature Special | 2 February 2025 | Issue 50 || সাশ্রয় নিউজ | রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল | ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | সংখ্যা ৫০

Sasraya News
Author: Sasraya News

Leave a Comment