Sasraya News

Article : এই সময়ের যুবসমাজের অবক্ষয়

Listen

এই সময়ের যুবসমাজের অবক্ষয়

মমতা রায় চৌধুরী

সমস্যা যেন আজ এক দুরারোগ্য করাল ব্যাধির বিভীষিকা। সমাজ দেহে ছড়িয়ে পড়ছে সেই আতঙ্ক দিকে দিকে শুধু হতাশ জীবনের দিন বেঁচে থাকার তীব্র ছটফটানি। আর সেটা যদি হয় আমাদের দেশের যুবসমাজের তাহলে তো অবাক হতেই হয়। ক্লান্ত হতদ্যম যুবকপ্রাণ। সর্বাঙ্গে জীবন-যুদ্ধে পরাভবের গ্লানি। দেশ ও জাতির জীবনের যে দুর্বার প্রাণশক্তি, সেই প্রাণশক্তি যদি অকালে ঝরে যায়। ফুল হয়ে ফোটার আগেই ঝরে যাওয়ার সেই বেদনা খুবই কষ্টকর। আজকের সমাজকে ভাবায় বিশ্বাসের ভূমি তাদের কাছে যেন বিধ্বস্ত। আশ্বাস তাদের কাছে ছলনার ছদ্মবেশ তাই তারা হতাশায় অসহিষ্ণতায় ফেটে পড়ে। যুব-শক্তির এমন অপচয় আর অবক্ষয়ের মর্মান্তিক চিত্র আজ সর্বত্র।

অবক্ষয় শব্দটা শুনলেই বুকের ভেতরে কেমন হাতুড়ি পিটতে থাকে। হতাশা, গ্লানি, বিশ্বাসভঙ্গতা বিপন্নতার এক প্রতিচ্ছবি যেন অবক্ষয়ের মধ্যে লুকিয়ে আছে আর সেটা যদি হয় যুবসমাজের তাহলে তো সমাজ গড়ার কারিগর যারা ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের মূল কাণ্ডারী তাদের এহেন পরিণতি দেখে সত্যি ভেতরে ভেতরে শিহরিত হতে হয়। এরা আমাদেরই ঘরের সন্তান অথচ তাদেরকে দেখব একটু সুস্থ সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠতে মানবিক আদর্শ মূল্যবোধ নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হয়ে উঠতে কিন্তু আজ যেন তা তলানিতে। কেন এরকম হচ্ছে কেনই বা এত দ্রুত যুব সমাজ অবক্ষয়ের দিকে চলে যাচ্ছে? কারণ হয়ত অনেক আছে কিন্তু আমার মনের ভেতরে যেখানে আঁকিবুকি কাটে তুলির ক্যানভাসে তাকে ফুটিয়ে তুলতে তখন সত্যি প্রশ্ন ওঠে মনের ভিতরে এর জন্য কি দায়ী নয়? সমাজ পরিকাঠামো দায়ী নয় কি শিক্ষা ব্যবস্থা? অর্থনৈতিক পরি কাঠামো, বিপথগামী রাজ নৈতিকতা, প্রশাসনিক দূর্বলতা, বেকারত্ব, মাদকাসক্তি, পারিবারিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা, সহানুভূতি ও সংবেদনশীল মনোভাব, মতপ্রকাশ করার ও সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠা করার অক্ষমতা, সোশ্যাল মিডিয়ার দাপট, অপসংস্কৃতির বাড়বাড়ন্ত, সংবাদপত্রে অতিরিক্ত ধর্ষণ, অপরাধ ক্রিয়া কলাপের দাপা দাপি, পর্ণগ্রাফী, পারিবারিক অস্থিরতা, অশিক্ষা, নিরক্ষরতা এসব বড্ড ভাবায়। পরিবেশের ভূমিকার কথায় অস্বীকার করি কি করে! ধরণীর বুকে শিশু তো পরিবেশের মাঝেই ভূমিষ্ঠ হয় পরিবেশের মাঝেই মানুষের জন্ম বৃদ্ধি ও বিকাশ দু’চোখে তার কত-শত স্বপ্ন আবার পরিবেশের মাঝেই স্বপ্ন বিভোর মানুষের অপমৃত্যু।

সুতরাং পরিবেশ হল মানব জীবনের এক তাৎপর্যপূর্ণ উপাদান। মানব জীবনের বিকাশের ক্ষেত্রে এই উপাদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব-সমাজের রীতিনীতি সংস্কৃতি মূল্যবোধ তাই প্রতিটি মানুষ বিশেষত যুবক বা শিক্ষার্থীদের জীবন বিকাশের সহায়ক। সমাজ ও শিক্ষার্থীদের পারস্পরিক বন্ধনের ফলশ্রুতিতে গড়ে ওঠে তার ব্যক্তিগত বিকাশ সামাজিক বিকাশ তথা জাগতিক বিকাশ। সমাজের আঙ্গিনায় থাকে বিদ্যালয়, বিভিন্ন ধর্মীয় সংস্থা…।  প্রতিটি সমাজের যাত্রাপথ তার নিজস্ব রীতিনীতি, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ এইসব বৈশিষ্ট্য দিয়ে গড়া।তাই প্রতিটি সমাজের আনাচে-কানাচে থাকে কত শত বৈচিত্র্যময় ইতিহাস। এসবের মধ্যে প্রভাবিত হয়ে প্রতিটি নাগরিকের মধ্যে নৈতিক, অধ্যাত্মিক, প্রাক্ষোভিক প্রভৃতি গুণের বিকাশ ঘটে, বিশেষত যুবকেরা যখন শিক্ষা গ্রহণ করে তাদের মধ্যে শৃঙ্খলাবোধ, মূল্যবোধ প্রভৃতি গুণের প্রকাশ ঘটে। সমাজের মধ্যে থেকেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে সামাজিক মেলবন্ধন তৈরি হয় আর এই মেলবন্ধনের সহযোগিতা সমবেদনা, সহনশীলতা, সৌজন্য এর মত মহৎ গুণ তার ভিত্তি। পরিবারের সদস্যরা তাই তাদের কোমল প্রাণ শিশুদেরকে যদি সঠিক সুশিক্ষা দান করতে পারেন তাহলে তাদের জীবন গড়ে ওঠে সুন্দরভাবে। আর সেই পরিবারের ভেতরেই যদি দেখা যায় যে তাদের রীতিনীতি, ধ্যান -ধারণা মূল্যবোধগুলো সম্পূর্ণটাই জনসাস্থ্যের পরিপন্থী তাহলে সেই পরিবারের শিশুদের কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছানো ভীষণই দূর হ ব্যাপার। আজকের যুবকদের ছাত্র জীবন হল মানুষের প্রস্তুতি পর্বের ওপর নির্ভর করে তার পরবর্তী জীবনের সফল্য ব্যর্থতা নির্ভর করে তার ভবিষ্যৎ জীবনের গতি প্রকৃতি। আলো- হাওয়া তার জীবন। তার ভবিষ্যতের সার্থকতা। তার পুষ্পিত মহিমা।
ছাত্র জীবন ভবিষ্যতের প্রস্তুতি তার সৌন্দর্যের অস্ফুট পটভূমি। এ হল তার শিষ্টাচার ও সৌজন্য আহরণের যথার্থকাল। তার উন্মেষ লগ্ন। সৌজন্য ও শিষ্টাচারের ছোঁয়াতেই সে হয় বিনীত ভদ্র। নতুন প্রাণ সম্পদে হয় গৌরবান্বিত। ছাত্র অবস্থাতেই সে গুরুজনদের শ্রদ্ধা করতে শিখল না। যার উদ্ধত অবিনত ব্যবহারে শিক্ষক বিরক্ত যার রূঢ় ও মার্জিত আচরণে সহ বন্ধুরা ক্ষুব্ধ বেদনাহত। পরবর্তী জীবনে ও তাই তার একই আচরণের পুনরাবৃত্তি ঘটে তখন সে হয় অশুভ শক্তি অকল্যাণের মুহূর্ত প্রতি হতাশা ব্যর্থতার তিল তিল দংশন জ্বালায় সে নিজেকে নিঃশেষ করে আর সমাজের বুকে ছড়িয়ে দিয়ে যায় অমৃতের বদলে গরল। তার সুপ্ত সুকুমার বৃত্তিগুলো অচিরেই হয়ে যায় কলুষিত। শিষ্টাচার সৌজন্য মনুষ্যত্ব অর্জনের সোপান এর মধ্যে আছে নিজেকে সুন্দর সার্থকতাই পরিপূর্ণ করে তোলার মহাশক্তি, শিষ্টাচার সৌজন্য প্রকাশের জন্য তাই তাদেরকে কিছু হারাতে হয় না। কোনও অর্থ ব্যয় করতে হয় না বরং এক মহৎ অঙ্গীকারে তার ছাত্র জীবন গড়ে ওঠে। বিনয় ভদ্র ছাত্র শুধু শিক্ষকের স্নেহই কেড়ে নেয় না ,সে পায় শিক্ষকের আশীর্বাদ তাঁর সাহায্য। আর এগুলোর অভাব তাকে অবিনত, স্বার্থপর, নিষ্ঠুর করে তোলে ধ্বংস করে দেয় তার প্রেম, মমতা, সহানুভূতি, দয়া, সুকুমারবৃত্তি। আর এর অভাবই তাকে ঠেলে দেয় অন্যায় অসত্যের চোরা অন্ধকারে। সেই অন্ধকার শুধু ব্যক্তিকেই আচ্ছন্ন করে না। গ্রাস করে গোটা সমাজকে। আজ সমাজে নানা ক্ষেত্রেই যুবকদের ক্ষেত্রে সেই অভাবটাই অক্টোপাসের মতো চেপে বসেছে। দিন দিন তাদের মধ্যে উশৃংখলতা বাড়ছে। বাড়ছে তার সীমাহীন দৌরাত্ম। আজ তাই বার্ধক্যকে সম্মান করে না। শ্রদ্ধেয়দের করে অবজ্ঞা,  পুরাতনের প্রতি অশ্রদ্ধা। সৃষ্টি হচ্ছে তাই নিজেদের মধ্যেই বিরোধ। আজ এই শিষ্টাচার সৌজন্য দুর্বলের ভীরুতারই যেন অসহায় প্রকাশ মাত্র। মানুষকে অপমান করতে পারলেই বুঝি তৃপ্তি। তাই তো শিক্ষককে অপমানিত হতে হয় অবিনয় আজ আর তার লজ্জা নয়। দুর্ব্যবহার দুর্মূখতা আর গৌরবের নয়, দুর্ভাগ্য এখন বাচন অলংকার। তার ভেতরে নৈতিকতা মূল্যবোধ শিষ্টাচার সৌজন্যবোধের সৌন্দর্য হারিয়ে আজ নিঃস্ব হৃদয়হীন অন্তরের পুষ্পিত শতদল আজ তাই ছিন্নভিন্ন কিন্তু কেন তার জীবনে আজ এই নির্দয় অভিশাপ? কেন তারা আজ নিঃস্ব, দেউলে?

গৃহ পরিবেশ স্কুল কলেজ সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান এগুলো হল তার যথার্থ ক্ষেত্র। যেখান থেকে সে যথার্থ রূপে তার শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। শৈশব থেকে তার সহজাত শক্তির মত এগুলোকে সে আয়ত্ত করতে পারে কিন্তু আজকে সেগুলোরই অভাব। রাজনৈতিকতা তার মুখ বন্ধ করে দেয়। গণতন্ত্রের গলা টিপে মারা হয়। তাই যুবকেরা দিশাহীন। তারা যথার্থ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে না বেকারত্ব তাদের গ্রাস করে। তার পারিপার্শ্বিক জীবনে আসে বিশৃঙ্খলা।
জীবন-পথ পরিক্রমণের অন্যতম আর এক হাতিয়ার হল নৈতিক মূল্যবোধ গঠ।, যার কল্যাণ স্পর্শে শ্রীহীন জীবন, রুক্ষ জীবনে হয়ে ওঠে সুন্দর আর লাবণ্যময়ভূমি। আসে নতুন ছন্দ। অফুরন্ত প্রাণ সুষমায় ভরে উঠবে তার দীর্ণ প্রাণের পাত্র। আজ সেগুলিরই বড্ড অভাব। তাই তো চারিদিকে শুধু অপসংস্কৃতির মিছিল।

যে সংস্কৃতি হল জাতির সামগ্রিক পরিচয়পত্র, যার মধ্যে থাকে মার্জিত মানসিকতা। থাকে পূর্ণতার সাধনা। যুগ -যুগান্তর ধরে জাতির বিশিষ্ট হয়ে ওঠার যে স্বপ্ন সাধ, যে স্বতন্ত্র সাধনা, যে আধ্যাত্ম্য আকুতি। আচার অনুষ্ঠান দার্শনিক ভাবনায় তার সফল গৌরবময় প্রকাশ সেই সংস্কৃতি আজ অপসংস্কৃতি। সংস্কৃতি তাই জাতির সমন্বয়ে চেতনা, পরমত সহিষ্ণ তা আর তত্তানু সন্ধিংসার বিচিত্র ভাবপুঞ্জের যোগফল। সংস্কৃতির মধ্যেই জাতির ন্যায় দৃষ্টি, সহানুভূতি, মৈত্রীবোধের প্রকাশ। সত্য শিব সুন্দরের আবাহন। এর মধ্যেই তার অভিব্যক্তি। আজ সেগুলো তলানিতে। অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়-এর কথায় বলতে পারি,  “সংস্কৃতি জীবনের সঙ্গে জড়িত সেই জন্য এর চরম রূপ কোন এক সময়ে চিরকালের জন্য বলে দেয়া যেতে পারে না জীবনের সঙ্গে সঙ্গে সভ্যতার সংস্কৃতি ও গতিশীল ব্যাপার।” সেই গতিশীলতার প্রকাশ আমরা দেখতে পাই শুধুমাত্র মুঠোফোনে। আমরা জানি বিজ্ঞানের এক অবিস্মরণীয় আবিষ্কার এটি কিন্তু এর দৌলতেও আজ যুবসমাজ অবক্ষয়ের দিকে এগিয়ে চলছে ছোট ছোট ছেলমেয়েদের হাতে ঘুরছে। তার ভালো দিকটিকে তারা গ্রহণ করতে পারেনি সর্বত্রই শুধু মরীচিকার মতো তাদের সঙ্গে খেলা করে চলেছে। শুধু মুঠোফোনে নয় রয়েছে বিজ্ঞানের আরও কিছু আবিষ্কার যেগুলোর দৌলাতে গতিপ্রাণ জীবনে এনেছে অভিশাপ। কিন্তু তাই বলে কি আমরা থেমে থাকব? কবি নজরুলের ভাষায় যদি বলি, “তবুও থামে না যৌবন- বেগ, জীবন উল্লাসে/ চলেছে চন্দ্রে মঙ্গল গ্রহে স্বর্গে অসীমা আকাশে।” মানুষ অনন্ত পথের মহাপ্রতিক সে চিরচঞ্চল সুদূরের পিয়াসী অজানা অধরা রহস্যদের হাতছানি চিরকালই মানুষকে উদবেল অস্থির করেছে। আর তাকে পেতে তাই মানুষের রয়েছে নিত্য-নতুন অভিযান। বিজ্ঞান তো মানুষের কল্যাণের জন্যই নিযুক্ত কিন্তু মানুষই তাকে ব্যবহার করছে অকল্যাণের দিকে বিশেষত যুব সমাজ তাদের বয়স কম তারা ভুল করে বসে, বিজ্ঞানের যথার্থ দানগুলোকে তারা সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারে না।

যথার্থ শিক্ষার অভাবও এর জন্য দায়ী। শুধু ডিগ্রি অর্জনের দিকেই তারা ছুটে চলে, জ্ঞান সেখানে তাদের কোথায়? জ্ঞান সর্বত্রই ধোঁকা। স্বামী বিবেকানন্দের মতে, “এডুকেশন ইজ দ্য ম্যানিফেস্টেশন অফ পারফেকশন অলরেডি ইন ম্যান “। অর্থাৎ শিক্ষা হল,  মানুষের অন্তর্নিহিত সত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন। আজ সেই শিক্ষা কোথায়? যুবসমাজের অবক্ষয়ের আরেকটি প্রধান কারণ নৈতিক অবক্ষয়। যে চিন্তাভাবনার লক্ষ্য উদ্দেশ্য মানুষ আত্মস্থ করে তার কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রিত করবে, পরিচালিত করবে, সেই মানবিক মূল্যবোধ ন্যায় -পরায়ণতা, সততা ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। সেই মূল্যবোধের আজ অবক্ষয়।
অশিক্ষা, দুর্নীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অসম বন্টন ব্যবস্থা, সঙ্গ দোষ এগুলো আমাদের মূল্যবোধের অভাব ঘটছে। এই মূল্যবোধের অবক্ষয়ের পেছনে রয়েছে আমাদের পারিবারিক সামাজিক কৃষ্টি, সংস্কৃতি, নীতি- নৈতিকতা মূল্যবোধ, অনুশাসনের অবক্ষয়ের দিন দিন সেটা তীব্র হয়ে উঠছে। নৈতিক মূল্যবোধের এই অনুপস্থিতি অবক্ষয়ের ব্যাপক বিস্তৃতির কারণ। এজন্যই যুবসমাজ ক্রমশ হতাশাগ্রস্থ বিপথগামী হয়ে উঠছে। মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। যে জন্য দেশের গণমুখী উন্নয়ন ও সুস্থ ধারা আজ বড্ড অভাব।
এছাড়াও সংবাদ অনলাইন আধুনিক জীবনের চাহিদার সঙ্গে বর্তমান মূল্যবোধের সংঘাত সৃষ্টি করছে। প্রতিদিন আমরা উন্মুখ হয়ে থাকি সুখবরের প্রত্যাশায় কিন্তু সেটা কতটুকু পাব তা নির্ভর করছে দুর্বল পারিবারিক ব্যবস্থার এবং সামাজিক ব্যবস্থার ওপর। আমাদের জীবনে এখন অন্ধ মোহাবরণ। সামাজিক ভ্রষ্টাচার, অত্যাচার অব্যাহত। ক্ষুদ্রতায় সংকীর্ণতায় আমাদের চলার পথ আজ শ্লথ মন্থর। কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় যদি বলি, “বল তোরা নবজীবনের ঢল। হোক ঘোলা, তবু এই সলিল / চির -যৌবন দিয়েছে ধরারে, গেরুয়া মাটিরে করেছে নীল।”
যৌবন দূত তরুণের দল যেখানে জরাগ্রস্ত পৃথিবীর বুকে আনে নব যৌবনের ঢল। যেখানে মৃত্যু তোরন দুয়ারে দুয়ারে জীবনের আহ্বান। যেখানে তারা তিমির রাত্রির অবসানে রক্ত রাঙ্গা প্রভাতের জীবন বন্দনা, যেখানে স্থবির স্থবিরত্ত্বের শাসন না মানার শপথ উচ্চারণ। সেখানে অমিত শক্তি উৎস তরুণ সমাজ যদি হয় স্বধর্মচ্যুত, ব্রতভ্রষ্ট তবে তা হবে জাতির জীবনে অন্ধকারাচ্ছন্ন অধ্যায়। আজ জীবন বিকাশের পূর্ণ মুহূর্তে দুর্বার প্রাণশক্তির অধিকারী তরুণ সমাজ তার জীবন্ত আদর্শের সন্ধান না পেয়ে মহৎ জীবন ভাবনায় অনুপ্রাণিত হওয়ার কোন অবলম্বন না পেয়ে তাই তাদের সামনে সীমাহীন নৈরাচার, হতাশা নিরন্তর দেয় হাতছানি। তবে কে তাদের অধঃপতন রোধ করবে? তাই তো তারা অনিবার্য বিপদগামীতার চোরাবালিতে ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে সর্বত্র। কে তাদের উদ্ধার করবে অনিবার্য বিপদগামীতার চোরাবালি থেকে? তারা উশৃঙ্খলাতার স্রোতে গা ভাসাচ্ছে, লিপ্ত হচ্ছে সমাজ বিরোধী কাজে। আজ তাদের সামনে নেই কোনও অনুপ্রাণিত করার মতো কোনও মহৎ প্রাণ মানুষ। ঘরে বাইরে সর্বত্রই আজ মনুষ্যত্বের দীনতার চিত্র। তাদের সামনে এখন দলীয় সংকীর্ণতা, আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপরতার গুনধরা ছবি। সেখানে রাজনীতির নামে সীমাহীন মিথ্যাচার। সমাজ সেবার ছদ্মবেশে নির্মম স্বেচ্ছাচার। এর মধ্যে তরুণ সমাজ খুঁজে পায় না মহত্তর কোন জীবন বোধ। শিক্ষা এখন তাদের কাছে চাকরি পাওয়ার শর্ত মাত্র। নয় মনুষত্ব অর্জনের বোধন মন্ত্র ।উন্নতির অর্থ এখানে টাকা ও প্রতিপত্তি নয়। নয় আত্মশক্তির জাগরণ। এছাড়া রয়েছে আরও নানা উপকরণ। সিনেমা টেলিভিশন, ভিডিও, সংবাদপত্র, বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া। সিনেমার কাহিনীতে, নাচে- গানে ,চলনে- বলনে, পোশাকে -আশাকে মার্জিত রুচির অভাব তাছাড়া অবাস্তবতার পিছনে ছুটে ছুটে তারা হয় ক্লান্ত। নিঃশেষিত হয় প্রাণ শক্তি। বাস্তবের পুরো কঠিন আঘাতে তাদের স্বপ্নের পৃথিবী টুকরো টুকরো হয়ে যায়। দুঃসহ বেদনা আর সীমাহীন দীর্ঘশ্বাসে ভরে ওঠে সেই জীবন। অধিকাংশ ছায়াছবিতেই আমরা দেখি খুন, যখম, রাহাজানি ডাকাতি, স্বাধীনতা বর্জিত নাচ গান। তাছাড়া রয়েছে নায়ক নায়িকার উদ্দাম প্রণয় চিত্র। তরুণ মনে এর দীর্ঘ বিস্তারী ছায়া। টেলিভিশন সম্পর্কেও সেই একই কথা সস্তা চিত্ত বিনোদনের আয়োজন। সংবাদপত্র গুলোই বা কম কি? সত্য সংবাদ পরিবেশন যেখানে সংবাদপত্রের প্রধান শর্ত ধর্ম সেখানে অনেক সময় বিক্রির প্রয়োজনে কেচ্ছা কেলেঙ্কারি খুন খারাবি ধর্ষণ সত্য মিথ্যার কাহিনী পরিবেশিত হয়। অশ্লীল বিজ্ঞাপন পরিবেশনেও তারা কুন্ঠাহীন। সমাজে যারা সমাজ বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত তাদের প্রভাব তরুণ মনে প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে গভীর প্রভাব বিস্তার করে তরুণ সমাজ তাদের আকর্ষণ দুর্নিবার। তারা প্রত্যক্ষ করের সমাজবিরোধীদের যে সম্মান যে প্রতিপত্তি সেখানে একজন জ্ঞানী সৎ মানুষের মূল্য তুচ্ছ সততা সেখানে লাঞ্ছিত অসহায় বিবেক সেখানে বিবর্জিত। জ্ঞানীগুনিরাও তাদের খাতির করে রাজনৈতিক নেতাদের তারা ডান হাত। জঘন্য নিষ্ঠুর কাজকর্ম করে আইনের চোখে তারা নিরপরাধ। প্রশাসন ওদের ব্যবহার করে। এই মূলধনকে নিয়েই সমাজের বিশিষ্ট মানুষ। তারা তাই শিক্ষা শেষে তরুণ মনে যখন বেকারত্বের জ্বালা হতাশা তখন সে সেই পথকেই বেছে নেয়। আবার ধর্মের নিছক আচার অনুষ্ঠান ও অনেক সময় তরুণ সমাজকে বিপথে টেনে নিয়ে যায় ধর্ম যখন পরিণত হয় অর্ধ উপার্জনে আমদ আহাদের উপকরণ। ভক্তির বদলে প্রধান হয়ে উঠে চাঁদা প্যান্ডেল আলোর রোশননাই ।যাত্রা জলসার হৈ হুল্লোড়। রাজনীতির মোহও তরুণ সমাজের কাছে অপ্রতিরোধ্য। তারুণ্যের ধর্মে তারা অনেক সময় দেশ সেবার কাজে নিযুক্ত হয়,  উদ্দীপিত হয়। কিন্তু নেতাদের অদূরদর্শিতায়, যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে তরুণ সমাজ নানা আঘাত প্রতিঘাতে সংকীর্ণ হানাহানিতে মেতে ওঠে রক্ত নেশায়। শিক্ষা ক্ষেত্রে নৈরাজ্য অনেক সময় তরুণ সমাজের বিপথগামীতার কারণ হয়ে দাঁড়ায় স্কুল-কলেজে ভর্তি সমস্যা। তাদের মনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে শেষ নয় যথাসময়ে বই পাওয়া যায় না। সময় মতো পরীক্ষায় ফল বেরোয় না, ভুল ভ্রান্তিতে ভর্তি। টোকাটুকি সবমিলিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রেও আজ অব্যবস্থা শৃঙ্খলাহীনতার চিত্র। শিক্ষার মধ্যেও জীবন বিকাশের পথ রুদ্ধ। এগুলো তরুণ মনে হতাশা ছড়ায় মূল্যবোধ নষ্ট করে শিক্ষা সম্পর্কে অশ্রদ্ধার ভাব জন্য এর ওপর অপসংস্কৃতির হাতছানি অসুস্থ বিকৃত মানসিকতা আজ তরুণ মনের সুকুমার বৃত্তিগুলোকে গ্রাস করছে।

দেহ ও মন উচ্ছেদ্য সম্পর্কে যুক্ত খেলাধুলা ও দেহচর্চার অভাবে তরুণ সমাজের অধঃপতন হয় আরো ত্বরান্বিত এর অভাবে দেহ মনের স্বাভাবিক বিকাশ কুণ্ঠিত। বঞ্চিত হয় এক অনাবিল আনন্দের ছোঁয়া থেকে। মনের প্রসারতা হয় সংকুচিত।
যে অগ্নিতেজে তরুণ সমাজ আবার জ্বলে উঠতে পারে, পারে পৃথিবীকে নতুন করে জঞ্জাল মুক্ত করতে তারা এখনো উদাসীন। তারা আজ ভুলে গেছে তাদের অতীত গৌরবের স্পন্দিত দিনগুলোর কথা ।ভুলে গেছে দেশে দেশে নব ইতিহাস রচনার অগ্রগতি আবার অধঃপতনের পথ বিলাসী হয়ে তারাই জাতির কলঙ্ক। এই দুর্বার যৌবন শক্তির অপচয় গোটা দেশেরই বিরাট ক্ষতি। তাই যে করেই হোক এই তরুণ সমাজকে বিপথগামীতার সর্বনাশা পদ থেকে অর্থাৎ অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের প্রত্যেকে ওদের সামনে তুলে দিতে হবে একটা সুস্থতার পরিবেশ। সুশিক্ষা, মহৎ ভাবনায় ওদের উজ্জীবিত করতে হবে। বর্তমান সমগ্র দেশ ও জাতির সম্মিলিত কর্মসূচি এটাই হওয়া উচিত।

 

(তথ্য সহায়ক : সরকার মজুমদার-এর বই)

ছবি : প্রতীকী 

Sasraya News
Author: Sasraya News

Leave a Comment

Also Read