



এ সময়ের প্রতিশ্রুতি সম্পন্ন কবি সুচিতা সরকার। থাকেন কলকাতার বাঘাযতীনে। প্রাত্যহিক অফিস ও সংসার সামলে যে অবসর সময় মেলে, ওই সময়টুকু লেখক লেখালেখি ও বই পড়াতে ব্যবহার করেন। সৃজনশীলতার প্রতি আন্তরিক ভালোলাগাই তাঁকে প্রতিটি লেখা লিখতে অনুপ্রাণিত করে। বেশ কিছু পত্রিকায় বিভিন্ন সময় লেখা প্রকাশিত হয়েছে। মূলত কবিতা লিখলেও ছোটগল্প লিখতেও ভালোবাসেন। তেমনি কবিতা পাঠ লেখকের একটা ভালোলাগার জায়গা।
সুচিতা সরকার-এর গুচ্ছ কবিতা
চোরাগলি
বহুদিন হয়,
পায়ের নুপুরটা আর আওয়াজ করে না।
বুঝতে পারিনি তখনও,
কেন যে ওগুলো আর আগের মতো বাজে না।
চোখে পড়েনি, কবে যে পা দুটো আটকে গেছিল চোরাবালির স্রোতে।
বাঁচার তাগিদে, আজ যতই হাত-পা ছুড়ি,
জীবন ধ্বসে যায় আরও, ভাগ্যের চোরা গলিতে।
নোনাজলে ভিজে যায় হলুদ বালিয়ারী।
সবুজের ঘরে প্রত্যহ হাহাকার শুনি।
এ যেন চার দেওয়ালের ভেতর বন্ধ এক সীমাহীন অনন্ত, ক্রমাগত যার দূরত্ব মেপে চলি।
আবার দেখা
তুই কি বলতে পারিস,
ঠিক কতোদিন পর আবার মুখোমুখি হলাম?
আমি তো সেই কবেই ভুলে গেছি হিসেব কষতে।
তোকে দেখেই, গভীর নীরবতা আমার গলা টিপে কণ্ঠরোধ করল।
অব্যক্ত কথাগুলি শ্বাসরোধ হয়ে দলা পাকিয়ে বুকের ভিতরেই মৃত্যু পেল।
শুধু মনটাকে ধরে রাখতে পারলাম না। ওকে অবশ্য বশ মানাতে পারিনি কোনওদিনই।
একছুটে পৌঁছে গেল সে স্মৃতির ঘুম স্টেশনে।
ঘন মেঘের আস্তরণ ভেদ করে এগিয়ে যাওয়া টয়ট্রেনটার জানালা দিয়ে, মুখ বাড়ালাম।
চেষ্টা করলাম অতিক্রান্ত পথটা খুঁজে পাওয়ার।
নাহ্! ব্যর্থ হলাম।
সাপের মতো পাহাড়টাকে বেষ্টন করে রেখেছে যে সরু পথটা, ওতে ফেরার কোনও উপায় নেই।
ফিরতি পথ আবার নতুন করে গড়তে হবে।
আসলে ফিরতি পথ বলে কিছু হয়না।
যা একবার হারিয়ে যায়, তা আর আগের মতো করে পাওয়া যায় না।
ভাঙা আয়না যতোই জোড়া লাগাই, দাগগুলো যে খুব স্পষ্ট। মুখটা ভালো করে চেনাই যায় না।
ভালোবাসায় কি আর আপস চলে? চলে না!
তাই পা বাড়ালাম।
তুই কি বলতে পারবি, আবার কবে মুখোমুখি হব? আসলে, হিসেব কষতে যে আমি আজও অপারগ।
কিছু চেনা দীর্ঘশ্বাস
কিছু দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়,
আমার বন্ধ চিলেকোঠার ঘরে।
অবাক আমি। ওরা কারা যারা শব্দ করে?
জ্বলন্ত পেট তো আর আওয়াজ করে না ক্ষুদায়!
তৃষ্ণার্ত চোখও তো আর ভাসে না তৃষ্ণায়!
তবে কেন কেউ আমায় কান্না শোনায়?
চোখ বন্ধ হয়ে আসে অজানা এক তীব্র টানে।
উথাল-পাতাল হৃদয়ের ঘরের কোণ।
কেনও ডাক শুনি আমি, ওরা কি আমায় চেনে?
আশঙ্কার মেঘ ফেটে, হঠাৎ বুকের খাদে বৃষ্টি নামে ।
ভেসে ওঠে কিছু চেনা লাশ,
একদিন জীবন্ত পুড়েছিল যারা, মরেছিল প্রাণে।
সমাধিস্থ আজ ওরা,
আমার চিলেকোঠার বন্ধ দ্বারের ওপারে।
হ্যাঁ! ওদের আমি চিনি।
সাধের ‘ইচ্ছে’ বলে ওদের ডাকতাম এককালে।
কি এমন আছে আমার
জানিস্ নীল!
মাঝে মাঝে ভাবি, কি দেবো তোকে।
কি এমন আছে আমার, যা তোকে দিতে পারি?
রঙ রূপ? সে তো ওই চোরাবালি। প্রতিপলে নদীর স্রোতে ক্ষয়ে চলেছে।
একদিন তো পুড়ে ছাঁই হয়ে যাবে সব। কি হবে তাহলে ও দিয়ে বল?
দু’খানি কালো চোখ আছে। স্বপনে-জাগরণে সর্বক্ষণ শুধু তোর ছবিই এঁকে চলে। নিবি রে তুই ও-দুটো?
থাকার মধ্যে আর আছে, বুক ভরা শ্বাস।
তোর গন্ধে যারা বেঁচে আছে। ঘুরে ফেরে আমার প্রতিটা নিঃশ্বাসে।
ওগুলো তো রোজ, তোর নামেই জমা হয় বুকে।
যেদিন বলবি, সবটুকু দিয়ে দেবো তোকে।
আমার আর ওদের কি প্রয়োজন বল!
তুই তো আছিস্! তাই না?
শূন্যতা
আকাশটা আজকাল মেঘলাই থাকে।
ধূসর মেঘের ওপারে চাঁদ, সূর্য, তারা,
সবাই নিজেদেরকে আড়াল রাখে।
জমাট বাঁধা মেঘগুলি ঝড় তোলে, ঘণীভূত হয়,
তবু ঝরে পড়ে না আমার শহরের বুকে।
সে কি আর ফিরবে না এপানে তবে?
তাই কি ওরা, নীরব থাকে?
খোয়াই আজকাল বড্ড আওয়াজ করে।
মাঝি ভাইয়ের সুরে সুর মেলায় না আর,
হাওয়ার উল্টো স্রোতে, বয়ে চলে।
পলাশ ঝরায় না পাতা, ঝরায় না ফুল ওর ঘাটে।
হলুদে পরে না আর নীলের ছবি,
এ উন্মাদ শহরে, এক অচেনা জীবন হাঁটে।
সে কি আর গাইবে না গান তবে?
তাই কি খোয়াই, আর্তনাদ করে?
অঙ্কন : প্রীতি দেব
লেখা পাঠান 👉 স্থানীয় সংবাদ, স্বরচিত গল্প, স্বরচিত কবিতা, স্বরচিত প্রবন্ধ, স্বরচিত ভ্রমণ, স্বরচিত উপন্যাস। e-mail id : sasrayanews@gmail.com
