



সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়ের প্রথমেই বাংলা ভাষাভাষী মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রণাম জানাই যাঁরা এই ভাষা নিয়ে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। এবং আজ এই ভাষা চর্চার মধ্যদিয়ে নিজেদের মৌলিক সৃষ্টি করে চলেছেন তাঁদেরও প্রতি বিনম্র ভালোবাসা শ্রদ্ধা জানাই। ভালোবাসা জানাই আজ ‘সাশ্রয় নিউজ’এ যাঁরা ভাষা নিয়ে কলম ধরেছেন সেই সমস্ত গুণীজন কবি লেখক সাহিত্যিকদের।
বাংলাভাষা আমাদের মাতৃভাষা। প্রাণের ভাষা। রক্তের ভাষা। যে ভাষার জন্য প্রাণ ত্যাগ করেছেন বীর যোদ্ধারা। ভাষা মানেই মা। আর মা আমাদের শক্তি। আজ বাংলা ভাষা নিজেস্বতা তৈরী করেছে, ক্রমশই এই ভাষা বিশ্ব ভাষা হয়ে উঠছে। বিশ্বের বৃহত্তম শ্রুতি মধুর ভাষা হিসেবে চিহ্নিত। অথচ এই ভাষা কোথাও বলতে বা পড়তে গেলে কেন আমাদের কিন্তু কিন্তু মনে হয়! কারণ আমরা যতই আমাদের ভাষাকে ভালোবাসি দেখাই না কেন আসলেই আমরা আমাদের ভাষাকে শ্রদ্ধা প্রাধান্য না করে দ্বিতীয় কোন ভাষাকে প্রাধান্য বা গুরুত্ব দিয়ে থাকি। কারণ এতোটাই স্বচ্ছ যে তার প্রমাণ স্বরূপ অফিস-কাচারী বা আদালতের বিষয়বস্তুর উপর নজর রাখলেই তা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে উঠবে। আসলে বাংলা ভাষার টান ও গুরুত্ব এতটাই তাৎপর্যপূর্ণ যে আপামর বাংলা ভাষাভাষী জনসমাজ সেটা জানে। বাংলা ভাষার দেশে বাংলা ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং সমাজিক পটভূমিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
স্বাভাবিকভাবে বলা যেতে পারে যে বাংলা ভাষার আন্দোলন মূলত ১৯৪৮ এবং ১৯৫২ সালের মধ্যে ঘটে, যা পরবর্তীকালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি গঠন করে ছিল। ভাষার টান ও ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব এতোটাই প্রভাব বিস্তার করেছিল যে বিশ্ব পরিচিতি ও বিশ্ব ভাষা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে এক প্রকার বাধ্যই হয়েছে ইউনেস্কো। কারণ আমরা জানি প্রায় ভারতবর্ষ এবং বাংলাদেশ মিলে প্রায় ৫০ কোটি বাঙালি বাংলা ভাষায় কথা বলেন। এমন কি গোটা পৃথিবী ধরলে হয়ত সংখ্যাটা এতটাই বেশি হয়ে যাবে যে অনেকেই কল্পনাও করতে পারেনি। আর এটা সম্ভব হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের কারণেই। এটা কেউই অস্বীকার করতে পারবেন না।
ভাষার প্রয়োজনে যদি ক’য়েকটি বিষয়ে এই ভাবে বলি যে—
জাতীয় পরিচিতি ও সাংস্কৃতিক স্বত্তা
বাংলা ভাষার ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাভাষী মানুষ তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষা করেছে। ভাষার মাধ্যমে তাঁরা নিজেদের ইতিহাস, গীত, সাহিত্য এবং সংস্কৃতি সৃষ্টি ও পালন করেছে।
রাজনৈতিক মুক্তি
১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকারের বাংলা ভাষাকে দ্বিতীয় শ্রেণির ভাষা হিসেবে ঘোষণা করার ফলে বাংলাভাষী মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সূচনা হয়। এই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদের সূচনা করে, যা পরবর্তীতে বৃহত্তর রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নেয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন
ভাষার আন্দোলন বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের একটি প্রথম পদক্ষেপ। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষাসৈনিকদের রক্তাক্ত সংগ্রাম পরবর্তীকালে স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রেরণা যুগিয়েছে এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় এই আন্দোলনের ইতিহাসকে স্মরণ করা হয়েছে।
ঐক্যবদ্ধতা সৃষ্টি
বাংলা ভাষার আন্দোলন সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষকে একত্রিত করেছে। বিভিন্ন ধর্ম, জাতি ও সম্প্রদায়ের মানুষ এই আন্দোলনে অংশ নিয়ে নিজেদেরকে বাঙালি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
সাহিত্য ও সংস্কৃতি
ভাষার আন্দোলনের পটভূমিতে বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছে। তা থেকে নতুন সৃষ্টিশীলতা জন্ম নিয়েছে, যা বাঙালি জাতির আত্ম-পরিচয়কে মজবুত করেছে।
আন্তর্জাতিক গুরুত্ব
২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়, যা বাংলার ভাষার প্রতি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করে। এটি ভাষা ও সংস্কৃতির গুরুত্ব বোঝাতে বাংলা ভাষা বিশ্বকে উৎসাহিত করে। ফলে বিশ্বের বৃহত্তম পাঁচটি ভাষার একটি ভাষা এই বাংলা ভাষা।
বাংলা ভাষার টান ও আন্দোলন কেবল একটি ভাষা রক্ষার সংগ্রাম নয়, বরং এটি একটি জাতির আত্মমর্যাদার লড়াই, যা তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, রাজনৈতিক অধিকারের এবং স্বাধিকারের প্রতীক। এই আন্দোলন আমাদের শিক্ষা দেয় যে, ভাষা শুধু একটি যোগাযোগের মাধ্যম নয়, বরং এটি একটি জাতির আত্মা ও অস্তিত্বের পরিচায়ক। আমাদের বাংলা ভাষার প্রতি যতটাই শ্রদ্ধা ভালোবাসা রয়েছে তেমনি অন্য ভাষার প্রতিও ঠিক ততটাই গুরুত্ব রয়েছে।
বাংলা ভাষা আমাদের নাড়ির ভাষা, আমাদের মায়ের ভাষা। নিজেদের প্রকাশ করবার ভাষা। তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।🍁
🍂ভাষা দিবসের কবিতা
সুনীল মাজি-এর কবিতা
যে আমার হিরন্ময়ী
১
মা আমার জলে ডুবে গেল— অশ্রুর গভীরে ভাষাশহিদ
মা আমার সাগরের গভীরে সঞ্চয়ন করল ঋষি পাণ্ডুলিপির গল্প : জান দেব জবান দেব না।
যে একবার শ্রীসূর্যোদয় দেখেছে তার অস্ত বলে কিছু নেই।
যে একবার স্পর্শ পেয়েছে বালার্ক সে তো চিরকালের অরুণোদয়।
মা আমার রামধনু রঙের শাড়ি পরেছে— আল্লাহর হাওয়ায় আঁচল উড়ছে
সাতভাই চম্পা রফিক সালাম বরকতরা আলোর আঁচল— মুখে মুখে গাইছে মেঘনা পদ্মার গান
আকাশ থেকে আকাশে ছড়িয়ে পড়ছে রৌদ্র পরাগ, বৃষ্টির সুর
অধরে মন্ত্র ওষ্ঠে আজান ধারণ করে বাংলা ভাষা হয়ে উঠছে চেতনার তপোবন।
২
এই যারা স্থাপত্যের উপর আঘাত করছে— এই যারা ধ্বংস করতে চায় স্বর, অক্ষর
এই যারা নালন্দার বুকে আগুন লাগিয়েছিল—এই যারা লুঠ করার নামে ধ্বংস করেছিল সোমনাথ, বিগ্রহ
মনে করো এরা তাদের প্রেতজন্ম
বোধ হয় এদের জন্ম শূন্য-গর্ভগৃহ
সেখানে বসন্তে প্রবেশ করেনি কোকিলের সুর—বর্ষায় রজনীগন্ধার গন্ধ
এরা লুলুর রক্তজাত—ভগবান ওমরের বুকে বসিয়ে দিতে পারে চাকু
এরা জরার বংশধর—ভগবান কৃষ্ণের শ্রীচরণ বিদ্ধ করে তির
শোনো, বর্ণ আহত হলেও অক্ষর মরে না—মেঘের বজ্র ধ্বংস করতে পারে না গগন গগন নৈঃশব্দ্য!
ষাঁড়টি শুয়ে আছে—নটরাজ নৃত্য থেমে গেলেই শিবকে নিয়ে সে পরিক্রমায় যাবে।
স্বপন দত্ত-এর কবিতা
স্বাধীনতা একটি খণ্ড হর : ভাষা একটি পরচুলা
অমিতা, এই বানানটা ঠিক করতে করতে
একটি খণ্ড হর মানে অমিতা
একটি নারী, আবার চণ্ডী, একটি মেয়ে মানুষ, একটি পরচুলা
যাইহোক বানানটা ঠিক করতে করতে
আমি কবিতাটা শুরু করি হুঁম, তারপর দেখা যাচ্ছে…
হ্যাঁ, চিনতে পারি না— চিনতে পারিনা
কথাকলি হেঁটে যাওয়া ঠোঁট
ঘন সাদা পোশাক পরা পাঁজর স্বপ্নরা হাসে
শুকতারা শিখা দেখেছি… শুকতারা… হ্যাঁ…
শিস দিতে থাকা— চিনতে পারি না— বুক
খাবার জন্যে ভরপেট হয়ে ওঠা সময়
চিনতে পারি না কেননা কেবলই দেয়াল
বোবা নির্জন নকশাকাটে
সেই কবেকার শ্যাওলা ধরা ভাঙা পৈঠায়
আদা, কাঁচালঙ্কা, ধনেপাতা, রঙিন বেঁচে থাকা
সদস্যপদও দিতে পারে না
আহ্… আজকের কোরান, উপনিষদ, বেদ, বাইবেল
শুধু কেবল ঘুঙুর শব্দ মাখা
একুশ আযোজন প্রলাপ
আসে— আসে আর যায়
কোথায় মাটিতে হৃদয় থৈ থৈ অপেক্ষায়
লাঙল যে বলে গেছে, হ্যাঁ, অপেক্ষায় লাঙল যে বলে গেছে
ঠিক আসব আমি গলিঘুচি ছলাৎছল
সাক্ষাৎকার নিয়ে ঝুঁকে পড়া মাথার
হ্যাঁ হ্যাঁ— ঝুঁকে পড়া মাথার —এয়্যাহ—ভারে
গুঁজে পড়া প্রাণযুদ্ধ ধ্বনি মিটমিট মিটমিট মিটমিট…
তৈমুর খান-এর কবিতা
ভাষার সাম্রাজ্যে ওড়ে দৃপ্ত পতাকারা
আমার কান্নার শব্দ, আমার মর্মরিত প্রেম
সমূহ শ্রদ্ধার গান, চেতনার নব উত্থান
সব লিখে রাখি
সব বেদনার পরাভব, অজর অক্ষর
নীলাভ আকাশ আর নিরুচ্চার অভিমান
বিশ্বাস আর বিস্ময়, কাঙ্ক্ষিত মুক্তির সোপান
দূরদৃষ্টি জেগে ওঠা দুর্বার কাছে
নিজেকে পাঠাই আমি নিরন্তর মুখর আলোকে
এই নাও ফেব্রুয়ারি,সোনালি সকাল
বিনম্র মহিমার
একটি সুচারু ত্যাগ, উষ্ণ উল্লাস
প্রাচুর্যের অন্তহীন ব্যাপ্ত ক্রিয়ায়
মগ্ন যাপনের দিন ফিরুক আবার
রক্তে পা ভিজে যায়, তবু দাঁড়ায় ভাষা
ভাষার সাম্রাজ্যে ওড়ে দৃপ্ত পতাকারা
স্নিগ্ধ তরবারি হাতে ভাষার যুবক যুবতীরা
ঘোষণা করে জয়
আমিনা তাবাসসুম-এর কবিতা
চোখের জলের মাতৃভাষা
নিমেষের দূরারোগ্যে বর্ণের কোনো বিকল্প নেই
তাই গল্পের নায়িকা বলতে ক্ষুধার রাজ্যে কিছু শব্দ।
ক্রোয়েশিয়া কিংবা সুইডেনে যেসব পতিত বুকের ভালোবাসা ছিল
তাতে এখন মিশিয়ে দিয়েছি লুডুর ছক্কা।
সেই কারণে এখন এক থেকে তিন অথবা চন্দ্রবিন্দুর চাঁদ
সবকিছুতেই মুক্তির উল্লাসে হামাগুড়ি দেয় বালির শহর।
তারপর জার্মানি রাশিয়া ঘুরে ঘুরে ক খ গ ঘ খুঁজি,
একটা চেনা সিম্বল জোয়ারের থেকেও ভয়াবহ শক্তিশালী আমার কাছে।
চেনা চোখ, চেনা মুখ এমনকি চেনা ঠোঁট ভোলার শিরোনামে
বুকের কাছে আগলে রাখি চোখের জলের মাতৃভাষা।
অমিত কাশ্যপ-এর কবিতা
রিমঝিম
রিমঝিম নামে ছোট মেয়েটি বাংলা বোঝে, বলে
লিখতে পারে না, থাকে সিডনি, মা-বাবা বাঙালি
মাতৃভাষা কি, কি বলবে
অষ্টমীর অঞ্জলিতে করজোড়ে, লালপাড় সাদাশাড়ি
আহা, ওখানের পুজো দেখেনি, ছবি দেখেছে, এখানেরও
এখানে এসে বাংলা বলা, ফুচকা খাওয়া
ওখানে গেলে আবার পড়া, মাতৃভাষা…
মিহি রোদ, দক্ষিণায়ন থেকে সরে আসছে
রক্তপলাশে ঢেকে যাচ্ছে গাছ, ২১ ফেব্রুয়ারি
বাংলা ভাষা, মাতৃভাষা
সৌমিত বসু-এর কবিতা
মাতৃভাষা
হয়তো তোমার ভাষা ঠিক
হয়তো আমার ভাষা ভুল
তুমি পাও জোর হাততালি
আমি দেখি অপার অকূল।
কাঁটাতার সব ভাগ করে
জমিজমা হিসেব নিকেশ
স্বপ্নও চুরমার হয়
ভাঙে নীল আকাশের দেশ।
হাতানিয়া দোয়ানিয়া দিয়ে
ভেসে যায় দূর মহাকাল
তোমার ভাষার কাছে আমি
ঋণী থাকি সন্ধ্যা সকাল।
হৈমন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়-এর কবিতাগুচ্ছ
অমর একুশে…
বহুকথা বলে যায় ভাবের গভীর দেশে
সময়ের পরতে পরতে বহু শোক উদ্বাস্তু যাপনের মতো
একদিন ম্লান হয়ে যায়।
জীবনের কথকতা লিখতে বলেছো
দাবদাহ স্রোতের মতো যে পথটি
আগুনের হলকা দিয়ে গ্যালো
তাকে তুমি পুনরায় জীবনের মধ্যে যেতে বলো!
আজ বিজয়ের মাস
চারিদিকে কতো পলাশ ফুটেছে দেখো,কতো শিমূল
রক্তের বন্যার মতো জীবন্ত হয়ে আছে
প্রেমের কথা আজ থাক ,
আজ আগুনের কবিতা হোক।
এই বিজয়ের মাসে যারা চিরতরে চলে গ্যালো
তাদের শপথগুলো আজ আবার জীবন্ত হোক।
চারিদিকে বেদনার রোল বড্ড বেশী
বিদীর্ণ করেছে বুক
আজ মাতৃত্বের বন্দনা হোক।
হে চেতনা তুমি জীবন্ত হও
হে শপথ তুমি আগুনের প্রেরণা হও
যারা চলে গ্যালো চিরতরে তারা যেন অমরত্ব প্রাপ্ত হয়…
একটি জীবনের-গল্প
দূরে একটি মানুষ হেঁটে যাচ্ছে তার পোশাকে ব্যবহারে
গ্রামের ছাপ স্পষ্ট
একটি কবির দৃষ্টি এখন গ্রামের মধ্যে চলে গেছে
কাছেই একটি পানাপুকুর
ঝপ্ করে সুবোধ কাকার জাল জলে পড়লো
আজ তাদের বাড়িতে মাছের পদ হবে।
একটি গভীর মন খারাপ নিয়ে লেখা কবিতা
একসময় পাখিদের উড়ে চলে যাওয়া আওয়াজের
মতো নিঃস্ব হয়ে যায়।
আমি মানুষ, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম জীব
সময়ের কাছে হেরে যাওয়া আমাকে মানায় না।
কাগজ ফুল…
মন খারাপের প্রহর থেকে অনেকটা দূর
সুখ কাঁপানো বুকের মতো শুদ্ধ বাতায়ন
চলো একটা কবিতা লিখি মনের মতন
প্রভাত সে কি এমনি আসে স্বপ্ন কারিগর
মন কেমনের ডাক আসলে ধূসর প্রহর
তবু আমি খুব জানি গো ভালোবাসার টান
অন্ধ সে তো নয় এখন ও সবুজ প্রমান
এই কথাটি বলতে গিয়ে ভুলের উপর ভুল
জীবন যেন মূর্ত প্রতীক প্রবাদ হুলুস্থুল
ভালোবাসি এই কথাটি বলা তো নয় সহজ
মনের ভিতর মস্ত তুফান আগুন ও ফাগুন।
বিনিদ্রকালীন…
ভাবতে ভাবতেই ভোর হয়ে যায়
সমস্ত দীনতা , হীনতা , জীর্ণতা মুছে দিয়ে ফের
পায়ে পায়ে চলে যায় জীবনের দিকে
এক বুক অভিমানের মতো জেগে আছো তুমি
একটি আকর্ষের ইতিহাস লিখতে গেলে বোধহয় অনেক টা
গভীরে যাওয়া উচিত , অনেক টা…
এক একটি নির্ভরতার হাত
রাত খসার মতো উবে যায়
এক একটা মন প্রাপ্তি সমূহের দিকে অবারিত হয়
যাপনের মেলা থেকে হৃদয় খুঁজতে গিয়ে ভিখিরি হলাম
এখন বুকের বামপাশে শুধু কবিতার ওম টুকু ছাড়া , ব্যথাদের আনাগোনা ছাড়া, একটি বাষ্প কালের মতো নির্যাস বয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট নেই।
দেবাশিস লাহা-এর কবিতা
একুশে ফেব্রুয়ারি
“মামি ,তুমি লুক করো! ইয়েলো ইয়েলো রোজে কেমন ব্লাক ব্লাক বি’জ বসেছে!”
পাশের বাড়ির জানালা থেকে বাপানের গলা
ভেসে আসতেই আবার আত্মঘাতী হল ছড়ার কাঠবেড়ালিটা!
ঘুমের মধ্যেই আর এক বার ককিয়ে উঠল রাম গরুড়ের ছানা!
“জানো পিসি আমার ছেলেটা একটুও বাংলা বোঝে না”
পলির গলা থেকে সেই পরিচিত সুর ভেসে আসতেই
রাস্তার দিকে চোখ ঘোরালাম।
সকাল হতে না হতেই হিসু করা শুরু করেছে
যিশুর হরেক রকম চেলা!
সেন্ট পলস, সেন্ট অগাস্টিন, সেন্ট জোসেফ
স্টিকার মারা বাস গিলে নিচ্ছে বাপান ও তার বন্ধুদের!
আর বোতলবন্দী বাংলার মতই ব্রাত্য হয়ে যাচ্ছে রফিকের রক্ত!
এক রাশ মন খারাপ নিয়ে ডান দিকে তাকাতেই গুলিয়ে উঠল গা ! লুঙ্গির মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে আস্ত একটা বস্তি!
আওয়াজ উঠেছে “লুঙ্গি ডান্স, লুঙ্গি ডান্স! লুঙ্গি ডান্স!”
প্রতিবাদে ফেটে পড়লাম আমি!
লিখে ফেললাম আরও একটা কবিতা!
রফিক, সালাম, বরকতদের রক্ত ঠেলতে ঠেলতে পৌঁছে গেলাম
মঞ্চে! এই তো জ্বলজ্বল করছে
২১ শে ফেব্রুয়ারি!
আহ কী শান্তি! এবার জড়িয়ে ধরব মাকে!
কিন্তু এ কী! হাত বাড়াতেই কেঁপে উঠল শরীর!
ভয়, ভীষণ ভয় পেলাম আমি-
কী জবাব দেব—
বাপানও যদি পাল্টা প্রশ্ন করে ওইদিন বাংলা তারিখটা কত ছিল?
বিশ্বজিৎ মণ্ডল-এর কবিতা
অনিশ্চিত
প্রতি রাতে আমার ঘুমের মধ্যে জেগে ওঠে
একদল লোমশ সরীসৃপ
ঘরের নীলচে অন্ধকারে খেলা করে, ওদের অদৃশ্য ফণা
আমি চাতুর্য জানি না, নীরবতায় খুঁজিনি
আত্মগোপনের গোপন খোলস
কেবল আহত হতে হতে ঘুমিয়ে পড়ি
ভগ্ন অবয়বের ভেতর
অজ্ঞাত ইচ্ছার দ্বার প্রান্তে দাঁড়িয়ে কখনও খুঁজিনি
উড্ডয়নের অপরূপ ডানা
আমি তো চেরা আলজিভের দু-টুকরো নালিপথ
গন্তব্য ভুলে মিশে গেছি, জান্নাত কিংবা জাহান্নামের
চোরা রাস্তায়
আবদুস সালাম-এর কবিতা
আমার ভাষা
এখনো অতৃপ্ত আত্মারা ঘুরে ঘুরে আসে
রোজ দেখতে পায় দিন বদলের কানামাছি খেলা
পলাশ বনে উঁকি মারে রক্তাক্ত অভিসার
ভাষার আফিম খেয়ে নাচে কৃষক মজুর
ভাটিয়ালীর সুরে পূজা হয় বাঙলা মায়ের
ভাষার সন্তানেরা রোদ জলে ভিজে
ভাষালুটেরা গুলি চালায় নির্বিচারে
আবেগের পাখিরা ডানা ঝাপটায়
রোদ জমা হয় আলোর প্রান্তরে
ভাষার নগ্নডানায় জড়ো হয় অমানবিক -ক্ষত
কুটিল আবর্তে পাক খায় ভ্রষ্ট বিবেক
সারা পৃথিবীর মুখে মাখালো চুনকালি
নিকানো উঠোনে পুঁতে দিচ্ছি ভাষার- ফনিমনসা
লালন করছি যতনে
ভাষার কাঁটা গাছে নাকি খাদ্য শষ্য ফলে
সুচিতা সরকার-এর কবিতা
মাতৃভাষার লড়াই
লড়াইটা ঠিক কবে থেকে শুরু?
হ্যাঁ, আপনাকেই জিজ্ঞেস করছি!
খবর রাখেন,
একটা যে আগুন জ্বলছে?
আধুনিকীকরণের আগুনে
জ্বিভে রাখা অক্ষরগুলি
পুড়ে যে ছারখার হচ্ছে,
অনুভব হয়েছে তার তাপ কখনও?
চোখে পড়ে
সে রক্তমাখা জন্মগত শব্দগুলি
সম্ভ্রমের নেশায় যা
পায়ের নীচে পিষে চলেছে?
শিক্ষালয়ের পাতা থেকে বেড়িয়ে
কার্যালয়ের টেবিল;
টেলিফোন থেকে মুঠোফোন;
বাড়ির ঝুলবারান্দা,
ছোটো-গলি, বড়ো-গলি পেরিয়ে
চৌরাস্তা;
বুঝতে পেরেছেন
ঠিক কবে নিজস্বতা হারিয়েছি?
ঠিক কোথায় এসে আজ দাঁড়িয়েছি?
একটু যদি মা’য়ের কথা ভাবি রোজ,
একটুও কি গর্বিত হব না আমরা?
আধুনিকীকরণ
প্রতিপত্তি
বিশ্বায়ন
খুব কি কষ্ট পাবে?
লড়াইটা কি সত্যিই লড়াই না?
লড়াইটা কি সত্যিই লড়া যায় না!!
মুন চক্রবর্তী–এর কবিতা
একুশের কথা
বলিদানের সুদীর্ঘ শহীদ পথ থেকে তুলে রেখেছি
সংগ্রামী বাংলা ভাষা
যেখানে দাঁড়িয়ে আছে ঐশ্বর্য্যের ভূমণ্ডল
ভুলিনি ইতিহাস, পাতায় পাতায় রক্ত করবী
দম্ভের বাঙালি শহিদ মিনারে ফুল রেখে যায়
বাংলা ভাষার পূজারীরা বুক পেতে ছিল একুশে, উনিশে।
যে ভাষা বাংলাদেশর জন্ম দিয়েছে, অজান্তেই নত হয়নি ভাষার কাছে,
কেবলই আস্ফালনে তাণ্ডব করছে, ত্রিশ লক্ষের বলিদানে,
কঠিণ কঠোর পথ পাড়ি দিয়ে শহিদ একুশ,মানচিত্রে
বেড়েছে কষ্ট,তবুও মহান বলিদানের বিপ্লব।
একুশের কথা স্মরণে বাংলার জয়গান বিপ্লবী মহান।
জয়দেব বেরা-এর কবিতা
মাতৃভাষা
২১-শে ফেব্রুয়ারি মানেই
বাঙালির একবুক আশা;
এই দিনে স্বীকৃতি পেয়েছিল
আমার মায়ের মুখের ভাষা।
বাঙালির কাছে বাংলা ভাষা
অমূল্য এক রত্ন;
তাইতো রক্ত দিয়ে হলেও
করবো আমরা মাতৃভাষার যত্ন।
২১-শে ফেব্রুয়ারি মানেই
বাঙালির একবুক আবেগ ও প্রাণ;
মাতৃভাষার জন্য লড়াই করে, বাঙালি’রা –
তাই দিয়েছিলেন নিজেদের প্রাণ বলিদান।
মায়ের সৌন্দর্যে ভরা
আমাদের এই মাতৃভাষা;
তাই এই ভাষার প্রতি রয়েছে
বাঙালির একসাগর ভালোবাসা।
তাই ২১-শে ফেব্রুয়ারি ফিরে আসুক
আমাদের মাঝে বার বার;
এই মহৎ দিনটি যে সমস্ত
বাঙালির এক আকাশ অহংকার।
বাণীব্রত-এর কবিতা
আমার ভাষা
বাংলা আমার মাতৃভাষা
বাংলা আমার মা,
যার জন্য রক্তের ক্ষয়
তার জন্যই জয়,
বাংলা যখন দ্বিতীয় ভাষা সুদূর ইংল্যান্ডে
জয়ী হবে মা যে আমার
এই ধরণীতে।
কত রক্ত ঝড়ল যে ২১ শের দিনে,
আজও তা আছে সকলের স্মরণে।
মমতা রায় চৌধুরী-এর কবিতা
বাংলা ভাষার গন্ধ
বাংলা ভাষার কথা শুনলেই বুকের ভেতরে বেজে ওঠে বর্ণমালার সাজানো বাগানে সেতারের শব্দ
টুং টাং করে মায়ের আঁচলের গন্ধ ঝরে পড়ে সর্বত্র।
বাংলা ভাষার কথা শুনলেই দেখি বাংলা মায়ের
আদরের সবুজ গাছপালার ভেতরে থরে থরে বর্ণমালা সাজানো।
সজনে ফুল, বুনো চালতা, শুষনি শাক, ছোলা মটর, কলমি শাকের গন্ধ
চাঁদা, সরপুটি, খাল-বিল, আম, জাম, কাঁঠাল
বুনো ভাট ফুলের গন্ধ
প্রবাসে বসে ও আমি শুনতে পাই শিশিরের শব্দ হেমন্তের বিষণ্নতা আর শীতের রুক্ষতায় ঘেরা কুয়াশাচ্ছন্ন অস্পষ্ট ভোরের আভাস।
বাংলা ভাষার কথা শুনলেই থমকে দাঁড়াই
পুলকিত হই ,প্রসন্ন হৃদয়ে পলাশ শিমুলের আগুন রাঙা বসন্তের গান আবার জেগে ওঠে মনে প্রাণে।
বাংলা ভাষার কথা শুনলেই নতুন করে বেঁচে উঠি
ভালবাসতে শিখি, ভালবাসাতে ভরিয়ে রাখতে জানি।
বাংলা তাই আমার বুকের ভেতর, বাংলা আমার বুকের পাঁজর, বাংলা আমার পরশ পাথর।
বাংলা ভাষার কথা শুনলেই প্রাণে পাই ফিরে ভরসা জাগানো হেম, মধু, বঙ্কিম, রবি, জীবনানন্দ।
বাংলা ভাষার কথা শুনলেই বর্ণমালারা নির্ভয়ে গান হয়ে ওঠে প্রতুলের কণ্ঠ
তাই দীপ্তকণ্ঠে প্রতিবাদে শামিল হতে পারি।
বাংলা ভাষার কথা শুনলেই
আবার শূন্য হৃদয়ে আশা জাগাতে পারি
বিরহে মিলনে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখি।
বাংলা ভাষাতে কথা বলতে পেরে গর্ব বোধ করি—
আমি বাংলাতে কথা বলি, আমি বাংলাকে ভালোবাসি, আমি বাংলা ভাষাতে যাপন করি।
ডালিয়া মুখার্জী-এর কবিতা
মাতৃভাষা
বাংলা আমার মাতৃভাষা,
বাংলা আমার প্রথম ভালবাসা।
বাংলা আমার প্রাণস্পন্দন ,
বাংলা আমার মনের বন্ধন।
বাংলা আমার মনের আশা,
বাংলায় আবেগ ভালোবাসা।
বাংলা মনের কল্পনা,
বাংলাতে দিই আল্পনা।
বাংলায় দেখি স্বপন,
বাংলায় সৃষ্টির বীজ বপন।
বাংলা আমার প্রাণ,
বাংলার বাড়ুক মান।
🍂ছবি : আন্তর্জালিক
