Sasraya News

Friday, March 28, 2025

21 February : যেভাবে সূচনা হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের 

Listen

মিঃ জিন্নাহ যেদিন কার্জন হলে ভাষণ দেন — সেদিনই বিকেলে তার সঙ্গে দেখা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের একটি দল। এ সময় ভাষা নিয়ে তাদের মধ্যে তীব্র বিতর্ক প্রায় ঝগড়াঝাঁটির স্তরে পৌঁছে যায়। মিঃ জিন্নাহকে একটি স্মারকলিপি ও দেয় ছাত্রদের দলটি। তাতে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা‌ করার দাবি জানানো হয় এবং কানাডা, বেলজিয়াম ও সুইজারল্যান্ডের মত একাধিক রাষ্ট্রভাষা আছে এমন কিছু দেশের উদাহরণ দেওয়া হয়। লিখেছেন : হৈমন্তী ব্যানার্জী 

 

 

যেভাবে সূচনা হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের 

মিঃ জিন্নাহ তখন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গণপরিষদের সভাপতি এবং মুসলিম লীগের ও সভাপতি। নয়দিন পূর্ববঙ্গের সফরে তিনি ঢাকা ও চট্টগ্রামে কয়েকটি সভায় বক্তৃতা দেন। ঢাকায় প্রথম সভাটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ, ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে- যা এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। এই সভায় তিনি স্পষ্ট করেই বলেছিলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা হবে উর্দু- অন্য কোনো ভাষা নয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দেখা যায়, নতুন দেশের ডাকটিকিট, মুদ্রা, মানি – অর্ডার বা টাকা পাঠানোর ফর্ম, ট্রেনের টিকিট, পোস্টকার্ড এগুলোতে শুধু উর্দু ও ইংরেজি ব্যবহৃত হচ্ছে। এর প্রতিবাদে ঢাকায় ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীরা বিক্ষোভ সমাবেশ ও করেছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত উর্দুভাষী সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বাঙালি কর্মকর্তাদের বিরূপ আচরণের অভিযোগ ওঠে। একই রকম মনোভাবের শিকার হন পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত বাঙালি কর্মকর্তারাও।

পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ও সরকারি চাকরিতেও ছিল অবাঙালিদের প্রাধান্য। পরে দেখা যায়, পূর্ব পাকিস্তান থেকে নৌবাহিনীতে লোক নিয়োগের ভর্তির পরীক্ষাও হচ্ছে উর্দু ও ইংরেজিতে। মিঃ জিন্নাহ যেদিন কার্জন হলে ভাষণ দেন — সেদিনই বিকেলে তার সঙ্গে দেখা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের একটি দল। এ সময় ভাষা নিয়ে তাদের মধ্যে তীব্র বিতর্ক প্রায় ঝগড়াঝাঁটির স্তরে পৌঁছে যায়। মিঃ জিন্নাহকে একটি স্মারকলিপি ও দেয় ছাত্রদের দলটি। তাতে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা‌ করার দাবি জানানো হয় এবং কানাডা, বেলজিয়াম ও সুইজারল্যান্ডের
মত একাধিক রাষ্ট্রভাষা আছে এমন কিছু দেশের উদাহরণ দেওয়া হয়। এরপর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বই লিখলেন বাংলাদেশের বামপন্থী রাজনীতিবিদ এবং লেখক বদরুদ্দীন উমর।

 

 

‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’! উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথাবার্তা শুরু হবার সাথেই পূর্ব বঙ্গের ছাত্র, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ, বুদ্ধিজীবী আর রাজনীতিবিদরা বুঝেছিলেন যে এটা বাঙালিদের ‌জন্য চরম বিপর্যয় ডেকে আনবে। তারা বুঝলেন, এরফলে পাকিস্তানে উর্দু ভাষীদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে, বাঙালিরা সরকার ও সামরিক বাহিনীতে চাকরিবাকরির সুযোগের ক্ষেত্রে উর্দু জানা জনগোষ্ঠীর তুলনায় পিছিয়ে পড়বেন। অথচ পাকিস্তানের বাস্তবতা ছিল এই যে সে দেশের পূর্বাংশে এবং গোটা দেশ মিলিয়েও‌ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষাই ছিল বাংলা পশ্চিম পাকিস্তানে ৪০ শতাংশ কিছু বেশি লোকের ভাষা ছিল পাঞ্জাবী, মাত্র চার শতাংশের ভাষা ছিল উর্দু। ঊনিশ’শ সাতচল্লিশ সালের আগস্টে পাকিস্তান স্বাধীন হবার পর পরই এ সংঘাত শুরু হয়ে গিয়েছিল। রাষ্ট্রভাষা ‌প্রশ্নে সংঘাত থেকেই‌ কি তাহলে স্বাধীন বাংলাদেশের ভাবনার জন্ম হয়েছিল? রওনক জাহান বলেছিলেন ভাষা— সংস্কৃতি ভিত্তিক একটা
জাতীয়তাবোধ বাঙালিদের মধ্যে ছিল, তবে কেন্দ্রীয় সরকারে গিয়ে পাকিস্তান শাসন করার আগ্রহ খুব একটা ছিল না। তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস প্রকল্পের গবেষক ও ইতিহাসবিদ আফসান চৌধুরী ‌বলেছেন, ১৯৫২ – র ভাষা আন্দোলন একটা বড় ঘটনা এবং এটা ১৯৪৮ থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। “তবে যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসকে সাংস্কৃতিক ‌ দৃষ্টিকোণ থেকে বেশি দেখেন— তারা ভাষা আন্দোলন ‌থেকেই এর শুরু এরকম মনে করেন,” মিঃ চৌধুরী ‌বলেন।

“কিন্তু ইতিহাসটা একটা ধারাবাহিকতার বিষয়। পূর্ববঙ্গের মানুষের স্বাধীনতা বা আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকারের আকাঙ্খা অনেক আগেই সৃষ্টি হয়েছিল। এই ধারাবাহিকতার একটা অংশ। ইচ্ছে ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন। তবে মধ্যবিত্ত ছাড়া তো আন্দোলন হয় না— আর ভাষা আন্দোলন ‌সেই‌ মধ্যবিত্তকে সংহত করেছে। মিঃ চৌধুরী বলেন। মিঃ দত্তের যুক্তি ছিল — পাকিস্তানের ৬ কোটি ৯০ লক্ষ লোকের মধ্যে ৪ কোটিরও বেশি লোকের ভাষা বাংলা —
অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষাই বাংলা। তাই বাংলাকে পাকিস্তানের একটি প্রাদেশিক ভাষা হিসেবে দেখা উচিত নয় বাংলারও হওয়া উচিত অন্যতম রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু মিঃ দত্তের এ সংশোধনীর প্রস্তাব গণপরিষদে টেকেনি। এমনকি গণপরিষদের বাঙালি সদস্যরাও সংসদীয় দলের। আপত্তির কারণে তাকে সমর্থন করতে পারেননি। এর প্রতিবাদে ঢাকায় ছাত্ররা ক্লাস বর্জন ও ধর্মঘট করে। ১১ মার্চ ১৯৪৮ সালে পূর্ব বাংলায় পালিত হয় ‘ভাষা দিবস’।‌
প্রতিবাদ – বিক্ষোভ, চুক্তি, স্মারকলিপি, পার্লামেন্টে বিতর্ক- এসবে দৃশ্যত: তেমন কোন কাজ হয়নি। মিঃ জিন্নাহ’র মৃত্যুর পর রাষ্ট্রভাষা নিয়ে ক’য়েক বছর ধরে নানারকম প্রস্তাব – পাল্টা প্রস্তাব, সংবাদপত্র – সভাসমিতিতে বিতর্ক চলতে থাকে।

উনিশ’শ বায়ান্ন সালের ‌শুরু পর্যন্ত বাঙালি রাজনীতিবিদদের বড় অংশই জোরালভাবে রাষ্ট্রভাষা উর্দুর বিরুদ্ধে মনোভাব ব্যক্ত করতে থাকেন। থেমে থেমে আন্দোলন চলছিল। পরবর্তীতে পাকিস্তানের ‌ কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন পূর্ব বঙ্গের অধিবাসী হওয়া সস্ত্বেও বলে উঠলেন— পাকিস্তানের ‌
রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু এবং দুটি রাষ্ট্রভাষা নিয়ে কোনও রাষ্ট্র সমৃদ্ধির পথে এগুতে পারে না’,  এরফলে নতুন করে শুরু হয় ছাত্র বিক্ষোভ, ধর্মঘট, হরতাল গঠিত হয় সর্বদলীয় একটি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে স্থানীয় প্রশাসন। আজকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন।  সেখানে ২১ শে ফেব্রুয়ারি বিক্ষোভকারীরা ১৪৪ ধারা ভাঙতে‌ গেলে পুলিশ ছাত্রদের গ্রেপ্তার করে, পরে কাঁদানে গ্যাস ও নিক্ষেপ করে। দুপুরের পর বিক্ষোভরত ছাত্রদের একটি দল গণপরিষদ
ভবনের দিকে যাবার চেষ্টা করলে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। উনিশ’ শ বায়ান্ন সালের সেইদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র হিসেবে হাসপাতালের জরুরী বিভাগে কর্মরত ছিলেন মুহাম্মদ মাহফুজ হোসেন। বছর তিনেক আগে বিবিসি বাংলাকে (BBC Bangla) দেওয়া সাক্ষাৎকারে তার বর্ণনায় ফুটে উঠেছে সেদিনকার চিত্র। সেই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “একুশে ফেব্রুয়ারি দুপুরে গুলিবিদ্ধ তিনজনকে হাসপাতালে গ্রহণ করি আমি। কপালে গুলিবিদ্ধ রফিককে দেখেই মৃত ঘোষণা করা হয় আর ঊরুতে গুলিবিদ্ধ আবুল বরকত মারা যান রাতে, তার চোখের সামনেই।” পরদিন ২২শে ফেব্রুয়ারি ঢাকার ক’য়েকটি জায়গায় আবার পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। সরকারি হিসেবে চারজন নিহত হবার কথা বলা হয়। কিন্তু দু’দিনে ঠিক কতজন আসলে নিহত হয়েছিল তার সঠিক সংখ্যা এখনও
অজানা।

ভাষা আন্দোলনে নিহতদের স্মরণে শহীদ মিনার
নির্মাণ, তা ভেঙে ফেলা ও পরে পুনঃ নির্মাণ একুশে নিয়ে গান ও কবিতা রচনা, এগুলোর মাধ্যমে কয়েক বছরের মধ্যেই বাঙালির এক প্রতীকী সাংস্কৃতিক ঘটনায় পরিণত হয় একুশে ফেব্রুয়ারি। শেষের কথা বলি — “একুশ মানে শেকলে বাঁধা শ্যামল রূপসী, তুমি – আমি, দুর্বিনীত দাসদাসী- একই শেকলে বাঁধা পড়ে আছি শতাব্দীর পর শতাব্দী। আমাদের ঘিরে শাঁই শাঁই চাবুকের শব্দ, স্তরে স্তরে শেকলের ঝংকার। তুমি আর আমি সে গোত্রের যারা চিরদিন উৎপীড়নের মধ্যে গান গায়— হাহাকার রূপান্তরিত হয় সঙ্গীতে শোভায়। লকলকে চাবুকের আক্রোশ আর অজগরের মতো অন্ধ শেকলের মুখোমুখি আমরা তুলে ধরি। কখন ও” মাগো, ওরা বলে– ‘ কুমড়ো ফুলে ফুলে নুয়ে পড়ছে লতাটা, সজনে ডাঁটায় ভরে গেছে গাছটা, আর আমি ডালের বড়ি শুকিয়ে রেখেছি— খোকা তুই কবে আসবি! কবে ছুটি? চিঠিটা তার পকেটে ছিল ছেঁড়া আর রক্তে ভেজা।’ মাগো ‘ওরা বলে , সবার কথা কেড়ে নেবে তোমার কোলে শুয়ে গল্প শুনতে দেবে না। বলো, মা, তাই কি হয়? শেষের কথায় আসি… “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি…” ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু ঝরা এ ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি! আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি। জাগো নাগিনীরা,জাগো নাগিনীরা, কাল বোশেখীরা, শিশু হত্যার বিক্ষোভে আজ কাঁপুক বসুন্ধরা, দেশের সোনার ছেলে খুন করে রোখে!
মোদের মাতৃভাষা…🍁

ছবি : সংগৃহীত 

আরও পড়ুন : Sasraya News Sunday’s Literature Special | 16th February 2025 | Issue 52 || সাশ্রয় নিউজ রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল | ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | সংখ্যা ৫২

Sasraya News
Author: Sasraya News

Leave a Comment