



সত্যি কি আমরা নিজের মাতৃভাষাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসি প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে! আর যদি এইরকম অবস্থায় আমরা দাঁড়িয়ে যাই তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম হয়ত এই মাতৃভাষাকে ভুলেই যাবে আর এই মাতৃভাষাকে ভুলে যাওয়া মানেই আমাদের মাতৃভাষার অস্তিত্ব বিপন্ন। আজ আঁতকে উঠি ভেবে ভেবে। লিখেছেন : মমতা রায় চৌধুরী
আমার মাতৃভাষায় রয়েছে দগদগে ঘা
বসন্তের মাস সারা প্রকৃতি জুড়ে তারই আয়োজন, বসন্তে যাপিত মন প্রাণ উচ্ছ্বসিত। আর এই বসন্তের মাসেই ঝরে গেছে তরতাজা প্রাণ। আমার মায়ের আব্রু রক্ষা, আমার ভাব প্রকাশের হাতিয়ারকে বিনষ্ট করার যে চক্রান্ত তারই বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা একুশে ফেব্রুয়ারির যাপিত দিবস। এটি শোক দিবস যেমন তেমনি একটি বিজয় দিবসও বটে। মাতৃভাষা ও মাতৃ দিবস নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রথমেই যে গানটির কথা মনে পড়ে ‘মোদের গরব মোদের আশা
আমরি বাংলা ভাষা’ অথবা ‘আমি বাংলায় গান গাই…।’ মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধের সমান যে ভাষার মধ্যে দিয়ে সহস্র পাখির কলতান মুখরিত হয় যে ভাষায় বাউল জারি, সারির সম্মিলন, যে ভাষার মধ্যে দিয়ে আমরা মনের কথা খুব সুন্দর ভাবে পরিবেশন করতে পারি। অন্যের কাছে আত্মপ্রকাশ অনেক বেশি সহজ স্বচ্ছন্দে ভাবে গোলাপ ফুল ফুটিয়ে তুলতে পারি কিন্তু এই মাতৃভাষাকে বাঙালির কাছ থেকে ছিনিয়ে নেবার জন্য যে ষড়যন্ত্র পূর্ব পাকিস্তান করেছিল মায়ের ভাষাকে কেড়ে নেবার যে প্রচেষ্টা তার জন্য তৎকালীন আপামর বাঙালিরা যে সংগ্রাম করেছে তার জন্য ঝরেছে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনে অনেক তরুণ তাজা প্রাণ, রক্তাক্ত হয়েছে মাটি মাতৃভাষার আব্রুকে রক্ষা করার জন্য এই যে আত্ম বলিদান তাকে ভুলবার নয়। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’ একদমই তাই। মায়ের আব্রু রক্ষার জন্য যেভাবে বাঙালিরা মরিয়া হয়ে উঠেছিল এখন প্রশ্ন এই মাতৃভাষার অস্তিত্ব আমরা কতদিন ধরে রাখতে পারব। যদি ধরে রাখতে না পারি তাহলে যারা ভাষা আন্দোলনের জন্য শহীদ হয়েছিলেন তাদের সমস্ত কর্মই বৃথা। কথায় কথায় একটা ঘটনার কথা মনে পড়লো আমার জানাশোনা একটা বাড়িতে কাজের মেয়েকে মানুষ করছেন এবং তাকে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করেছেন। মেয়েটিকে ইংরেজিতে কথা বলানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। অথচ তার ফাস্ট জেনারেশন হিসেবে সে পড়াশোনা করছে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় মেয়েটির এখন থেকেই মনে বাংলা ভাষার প্রতি অবজ্ঞা, অবহেলা, আমি নিতে পারিনি। অবশ্যই একটি কাজের মেয়েকে ভালো স্কুলে ভর্তি করেছেন মানুষ করছেন তাকে সাধুবাদ জানাই কিন্তু তাই বলে নিজের মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা অবহেলা করে? কাউকে আঘাত করার জন্য কথাগুলো বলছি না, আজ মাতৃভাষা দিবসের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর দিন। শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে বারবার বুকের ভেতরে কোথায় যেন টনটন করে ব্যথাটা। সত্যি কি আমরা নিজের মাতৃভাষাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসি প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে! আর যদি এইরকম অবস্থায় আমরা দাঁড়িয়ে যাই তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম হয়ত এই মাতৃভাষাকে ভুলেই যাবে আর এই মাতৃভাষাকে ভুলে যাওয়া মানেই আমাদের মাতৃভাষার অস্তিত্ব বিপন্ন। আঁতকে উঠি ভেবে ভেবে। এরকম কত পরিবার বাংলা মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি না করে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করছেন। সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার এটাই যে স্কুলে ভর্তি করার জন্য নয় সব থেকে খারাপ লাগে যখন বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞার চোখে দেখে তাই ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের কবিতার কথা মনে পড়ে। ‘আমার বাংলাটা ঠিক আসে না’ একদম ঠিক আজ এরকমই আমাদের বাঙালি মানসিকতা এসে গিয়েছে বাংলা ভাষাকে নিয়ে লালন করার ক্ষেত্রে। যে ‘বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে নিকানো উঠানে ঝরে রোদ /বারান্দায় লাগে জোসনার চন্দন/বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে অন্ধ বাউলের এক তারা বাজে…।’
আজ সকলের হৃদয়ে অনুরিত হোক এ রকমই বার্তা।
বাংলা ভাষার মধ্যে দিয়ে বাংলার মাঠ- ঘাট, নদী- নালা, খাল- বিল, বাংলার প্রকৃতি, আম জাম কাঁঠাল বুনো চালতা, লাউ, মটরশুঁটি, কলমি শাকের গন্ধ এ যেন আমার মাযের গন্ধ পরতে পরতে। আজ বসন্তের গায়ে হলুদ পলাশ শিমুলে যখন আগুন রাঙা রঙের ডালি সাজিয়ে সকলকে ডাকে ‘ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে’… তখন শুধু আমার মনে মাতৃভাষার ফাগুন মাথাচাড়া দিয়ে উঠুক।
যতই আমার মাতৃভাষাকে কেড়ে নেবার চেষ্টা করুক না কেন যতই আমরা অন্য ভাষাতে পারদর্শী হয়ে উঠি না কেন বুকের ভেতরে শুধু একটাই দৃপ্ত প্রত্যয় থাকুক বাংলা ভাষা আমার বুকের ভেতর বাংলা আমার প্রাণের ভেতর। বাংলাকে ছাড়া আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন। তাই বাংলা ভাষার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য আমাদের আমরণ সংগ্রাম চলবে। তাই আজ একুশে ফেব্রুয়ারির স্মরণে বাংলা ভাষা অন্তরে আজ শুধু মর্মরিত হোক। আর এই ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল করার জন্য মাতৃভাষায় অনেক অনেক বেশি শিক্ষাতে ব্যবহার করা হোক।
ছবি : সংগৃহীত
