Sasraya News

Friday, March 28, 2025

জীবনানন্দ দাশ: আমার বাবা | লিখেছেন মঞ্জুশ্রী দাশ

Listen

🍂জীবনানন্দ দাশ প্রসঙ্গে

‘মজলিসী মানুষ যখন কেউ আমাদের বাড়িতে আসতেন সেসব উপচে পড়া সময়ে বাবার চলাবলায় হাসির ঝিলিক দেখেছি। ‘সুবিনয় মুস্তফীর কথা মনে পড়ে, এই হেমন্তের রাতে। এক সাথে বেড়াল ও বেড়ালের মুখে ধরা ইঁদুর হাসাতে-এমন আশ্চর্য শক্তি ছিল ভূয়োদর্শী যুবার’। এ কবিতায় বাবার বিশেষ পরিচিত একজনের প্রতিফলন আছে। অন্তরঙ্গ আলো-হাওয়ায় উচ্ছল সময়ে বাবা ঝরনার মত শব্দ করে হাসতেন। কখনো মজার কথা বলতেন। আমাকে নানা মানুষের মজার মজার পদবী নিয়ে গল্প করেছিলেন। কিন্তু বাবার প্রকাশভঙ্গি ছিল অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত, অনেকটা জাপানী কবিতার মত।’ কবি জীবনানন্দ দাশ-এর কন্যা মঞ্জুশ্রী দাশ-এর লেখায় কবির স্মতিচারণ…

 

 

কবি জীবনানন্দ দাশ। ছবি : আন্তর্জালিক

 

 

জীবনানন্দ দাশ : আমার বাবা

মঞ্জুশ্রী দাশ

খন আমরা ল্যান্সডাউন রোডে থাকতাম। এধারে দেশপ্রিয় পার্ক ওধারে রাসবিহারী এভেনিউ। বাড়িটি তিনতলা। আমরা ছিলাম একতলায়। সামনে এক টুকরো উঠোন। সেখানে একটি নিমগাছ। এই বাড়িতে খেলা করত ‘চিনেবাদামের মত বিশুষ্ক বাতাস।’ বাবা, হয়ত স্তব্ধ হয়ে কিছু লিখছেন, হঠাৎ একটি মোটরকার ‘গাড়লের মতো গেল কেশে…।’
অথচ বরিশালে আমরা ছিলাম ছড়ানো ছিটানো প্রান্তরে। সেখানে মসৃণ ঘাসে ছিল শিশিরের স্বাদ। অনেক গাছ গাছালি পাখি পাখালির পরে এক টুকরো মাটির কাছে এসে মনে হল বাখারির বেড়া দেওয়া আঙিনায় সীমিত হলাম। ‘রূপসী বাংলা’ ছিল বাবার অত্যন্ত প্রিয়। বলেছিলেন- ‘তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও, আমি এই বাংলার পরে রয়ে যাব, দেখিব কাঁঠালপাতা, ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে দেখিব খয়েরি ডানা শালিখের….’

 

অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের সঙ্গে কবি জীবনানন্দ দাশ। ছবি আন্তর্জালিক

 

কোথায় গেল সেই সবজে পাতার ঝরে পড়া আর শালিখের পালকের খয়েরি আমেজ। বাবা কিন্তু খুব কম কথা বলতেন। জীবনের রূঢ় রোদ কবিতায় ছবি হয়েছে। কিন্তু চলা বলায় প্রকাশ পায়নি।
বাবা ছিলেন অত্যন্ত প্রচার বিমুখ। রবীন্দ্র পুরস্কার পেলেন। পুরস্কারের ছোটখাট জিনিস নিঃশব্দে খাটের নিচে রাখলেন। দেখতে পেয়ে বলেছিলাম এসব কি? তিনি বলেছিলেন ‘ওই…।’ কোন বিজয়ীর চিহ্ন কোথাও নেই, শুধু একরাশ নিস্তব্ধতা। রেডিও বা সেনেটের কবি সম্মেলনে বাবা কবিতা বলেছেন। দেখতাম বাবার ঘরের দরজা বন্ধ। মৃদুস্বরে কবিতা পড়ছেন। মনে হত কোথাও কবিতা বলবেন। এসব মুহূর্তে কখনো সোচ্চার হননি। এসময়ে কোন রোশনাই বা আলোর ফিনকি ছিল না।
তানসেনের গুরু হরিদাস স্বামী বনেই তপস্যা করেন। রাজদরবারে যাননি। বাবার জীবনের তপস্যা ছিল কিছু লেখা কিছু পড়া। এই তপস্যার জন্যে সেই ‘মৌরীর গন্ধমাখা ঘাস আর আঁকাবাঁকা সবুজ শাখা’- আমাদের বরিশালের বাড়িটি ছিল তপোবন।
শেষ বেলায় মুঠো মুঠো রূঢ় রোদ আর বিপন্ন বিস্ময়ে চলেছেন আর অনুভব করেছেন ‘আমরা অঙ্গার রক্ত, শতাব্দীর অন্তহীন আগুনের ভিতরে দাঁড়িয়ে।…’ কিন্তু এই’ বেদনার আভাস পাইনি কখনো।

 

কবি জীবনানন্দ দাশ-এর কন্যা মঞ্জুশ্রী দাশ। ছবি : আন্তর্জালিক

 

আমার ঠাকুমা ছিলেন বাবার সবচেয়ে প্রিয়জন। ঠাকুমার মৃত্যুর সময়ে দেখেছি বাবার মুখে অফুরান বেদনা। কিন্তু চোখে জল নেই। নিঃশব্দে তিনি বহন করেছিলেন। পরিচিত কোন মানুষের বিচিত্র ব্যবহার ঠোঁটের কোণে দেখেছিলাম বিবর্ণ হাসি। কিন্তু বলেননি কিছু এ বিষয়ে। জিজ্ঞেস করেও উত্তর পাইনি। বাবা সমালোচনা করতেন না।
আমাদের বাড়িতে অনেকে আসতেন। জ্ঞানী গুণী মানী। লেখক কবি অধ্যাপক। সাধারণ অসাধারণ। বাবা কথা বলতেন হাসতেন আপ্যায়ন করতেন আন্তরিকভাবে। তিনি অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ ছিলেন। সৌজন্যবোধ ছিল অপরিসীম। কিন্তু কাউকে স্তবস্তুতি করেননি। বাবার মর্যাদাবোধ ছিল অত্যন্ত প্রখর।
তরুণেরা আসতেন, আমন্ত্রণ জানাতেন, সভা সমিতির জন্য। কিন্তু বাবা এ বিষয়ে অত্যন্ত উদাসীন ছিলেন।
বাবা ব্রাহ্ম সমাজের প্রার্থনা সভায় উপস্থিত থাকতেন। দেখেছি-সাধারণত সভা শুরু হলে প্রবেশ করতেন এবং শেষ হবার খানিকটা আগেই বেরিয়ে পড়তেন। ধর্ম বিষয়ে কোন হৈচৈ তিনি কখনই পছন্দ করতেন না। আত্মনিবেদনই বোধ হয় প্রাধান্য পেত তাঁর কাছে।
বাবা প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়েছেন। অত্যন্ত ভাল ছাত্র ছিলেন। কিন্তু তাঁর তরুণ দিনগুলি গোলাপের পাঁপড়ি ছড়ানো ছিল না। পরে মধ্যাহ্ন সূর্য যখন আকাশে জ্বলছে সেই রূঢ় রোদে পথে চলেছেন। অনেক কারণে অনেক যুদ্ধ করে বাঁচতে হয়েছে।

আরও পড়ুন : 

https://sasrayanews.in/leh-ladakh-লেহ-লাদাখ-প্রকৃতির-সঙ্/

 

পরিবারের সঙ্গে কবি জীবনানন্দ দাশ। ছবি : আন্তর্জালিক

 

আমাদের বরিশালের বাড়িতে প্রত্যূষের প্রথম আভায় দাদু উপনিষদ পাঠ করতেন। ঠাকুমা উপাসনার গান গাইতেন। আমার দাদু ঠাকুমার ছিল পুণ্যের জীবন।
কোন সময়ে বাবা বলেছিলেন, আমরা যখন তরুণ তখন ইংরেজ সরকারে ভাল কাজ পাওয়া সহজ ছিল। কিন্তু যখন অধ্যাপক হলাম তখন দেশের মানুষ ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। আমি তো সেই ইংরেজের দাস হতে পারি না।
একদিন এক বিশেষ পরিচিত মানুষ বাবাকে অনুরোধ জানালেন, আদালতে কোন বিষয়ে মিথ্যা সাক্ষী দিতে। বাবা এবিষয়ে তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। একদিন এক ভদ্রলোক বাবার একটি ভাল বই নিলেন। কিন্তু দিলেন না। বাবা নীরব রইলেন। এ সময়ে কাকামণি একটি বই পড়তে নিয়েছিলেন। আবার কদিন পরে বইটি রেখে গেলেন, যেখানে ছিল ঠিক সেখানেই। আমাদের বললেন, অশোকের দায়িত্বজ্ঞান খুব। বাবা, কাকামণি দুজনেই পিসিমণিকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন।

মজলিসী মানুষ যখন কেউ আমাদের বাড়িতে আসতেন সেসব উপচে পড়া সময়ে বাবার চলাবলায় হাসির ঝিলিক দেখেছি। ‘সুবিনয় মুস্তফীর কথা মনে পড়ে, এই হেমন্তের রাতে। এক সাথে বেড়াল ও বেড়ালের মুখে ধরা ইঁদুর হাসাতে-এমন আশ্চর্য শক্তি ছিল ভূয়োদর্শী যুবার’। এ কবিতায় বাবার বিশেষ পরিচিত একজনের প্রতিফলন আছে। অন্তরঙ্গ আলো-হাওয়ায় উচ্ছল সময়ে বাবা ঝরনার মত শব্দ করে হাসতেন। কখনো মজার কথা বলতেন। আমাকে নানা মানুষের মজার মজার পদবী নিয়ে গল্প করেছিলেন। কিন্তু বাবার প্রকাশভঙ্গি ছিল অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত, অনেকটা জাপানী কবিতার মত।

 

কবি জীবনানন্দ দাশ। ছবি : আন্তর্জালিক

 

বাবা খুব সাদাসিধে ছিলেন। অত্যন্ত সাধারণ ধুতি পাঞ্জাবী পরতেন। ঘরে শুধু বই আর বই। লেখার সরঞ্জাম। এক কোণে দু-একটি কাপড়-তাও বাক্সে বা আলমারিতে নয়। বাক্সে সযত্নে সাজাতেন শুধু বই। অনেক রাত পর্যন্ত পড়তেন লিখতেন। কখনো পেন্সিলে লিখতেন। জিজ্ঞেস করলে বলতেন, দেখছিস না কী রকম ইস্পাতের মতো নীলাকাশ।
বাবা আমাদের পরম বন্ধু ছিলেন। কোন সময়ে কিছুদিন আমি কাকামণি কাকিমার বাড়িতে ছিলেম। আমার বসন্ত হল। বাবা রোজ সকালে বিকালে আসতেন। আশীর্বাদের মত হাতখানি আমার মাথায় রাখতেন। আমার ছোটভাই বিছানায় বাবার পায়ের কাছে বসে গল্প করত।
একবার আমায় বললেন, ‘তোর বইয়ের লিস্ট দে, কিনে দেব। ভাল করে পড়ছিস তো? ফার্স্ট ক্লাশ পেতে হলে কিন্তু ভাল করে পড়তে হয়।’
একদিন ছিল ভিজে মেঘের দুপুর। নীলাঞ্জন আভায় বাবা লিখছেন। বললাম বাবা কালিদাসের মেঘদূত বড় সুন্দর না? মৃদু হেসে মেঘদূতের প্রথম কয়েকটি লাইন আবৃত্তি করলেন তিনি। কী মেঘের মত স্বর, কী সুন্দর উচ্চারণ।
বাবা ছিলেন এক তাপস। পান সিগারেট কখনো খেতে দেখিনি। সিনেমা দেখলেও হয়তো এক বছর পর। খেতে খুব ভালবাসতেন।
সন্ধ্যাবেলায় বাবা রাসবিহারী সাদার্ন এভেনিউ দিয়ে সামান্য হেঁটে আসতেন। আমাদের বরিশালে ছিল অফুরাণ গাছগাছালি চমৎকার বাগান সবুজ মাঠ।
সেই মস্ত মাঠে ছিল সবুজ ঘাস। শিশিরের স্বাদ। সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের সন্ধ্যের মত সন্ধ্যা আমরা বরিশালে দেখেছি। সেই হারানো কথা মনে রেখে হয়ত সন্ধ্যায় সামান্য হাঁটতেন।

 

 

কবি জীবনানন্দ দাশকে শেষ শ্রদ্ধা। ছবি : আন্তর্জালিক 

এমনি একদিন সন্ধ্যাবেলায় পৃথিবীর পথে চলতে গিয়ে কবি আর ঘরে ফিরলেন না। শুনলাম ট্রাম অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। আমরা দৌড়ে গেলাম শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে। দেখি, বাবার মলিন কাপড়ে রক্তের দাগ। দুদিন পরে ডাক্তারের হাত ধরে বলেছিলেন, ‘ডাক্তারবাবু, আমি বাঁচবো তো?’
বাবার শরীরের অনেক হাড় ভেঙে গিয়েছিল। হাসপাতালে হাজারো মানুষ আসতেন। শুভার্থী সুহৃদস্বজন। হাতে ফল, কণ্ঠে শুভেচ্ছা। হাসপাতালে সেবিকা ছিলেন। বাবাকে দেখতেন। তবুও কজন আত্মীয়, দু-তিন জন তরুণ কবি ও আমরা-সব সময় কাছে থাকতাম, পরিচর্যার জন্যে।
একদিন বাবার শিয়রে বসে আছি। আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ ছিল না। দেখলাম বাবার চোখ সজল। যে মানুষ কখনো ভেঙে পড়েননি, আজ সময়ের নির্মম আঘাতে সে চোখ সজল। আমি সামনে এলাম। আমায় দেখতে পেয়ে বাবা নিমেষে সহজ হলেন। বললেন, অমুক পত্র পত্রিকা এনে রাখিস।
হাসপাতালে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে চেয়েছিলেন। শেষদিকে ডাক্তার বিধান রায় দেখতে এলেন। ডাক্তার রায় খানিকক্ষণ বাবার মুখের দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলেন। কোন কথা বললেন না। শুধু বাবার জন্যে অনেক সুব্যবস্থা করে গেলেন। কিন্তু জীবনকে জানবার অবিরাম ভার বাবাকে আর বইতে হল না।
সেটা ১৯৫৪-এর, ২২ অক্টোবর। রাত প্রায় সাড়ে এগার। আমার সবচেয়ে প্রিয়জনের সবচেয়ে ধূসর সময়।
বাবা সজোরে নিশ্বাস নিচ্ছিলেন। বিছানার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম আমরা সবাই। অনেক স্বজন-ক্রমে জীবনের স্পন্দন থেমে গেল। 🍁

আরও পড়ুন : Sasraya News Sunday’s Literature Special | 16th February 2025 | Issue 52 || সাশ্রয় নিউজ রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল | ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | সংখ্যা ৫২

ছবি ও লেখা ঋণ : আন্তর্জালিক 

Sasraya News
Author: Sasraya News

Leave a Comment